প্রতীকী ছবি।
গর্ভাবস্থার মেয়াদ সাধারণত ৪০ সপ্তাহ ধরা হয়। একেবারে ভ্রূণ অবস্থা থেকে মাতৃজঠরে একটু একটু করে বেড়ে ওঠে শিশু, গড়ে ওঠে তার নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। তার পর নির্দিষ্ট সময় পার করে জন্ম নেয় ফুটফুটে সন্তান। কিন্তু সব শিশুই যে পূর্ণ সময়, অর্থাৎ ৪০ সপ্তাহ পার করে ভূমিষ্ঠ হয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের ঢের আগেই বাচ্চা জন্ম নেয়। নানা কারণ থাকে তার। ভারতে এখন প্রায় ২১ শতাংশ বাচ্চা অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেয়। দু’-এক সপ্তাহ এ দিক-ও দিকে বিশেষ ক্ষতি হয় না। কিন্তু ৩৭ সপ্তাহের আগেই যে শিশু জন্ম নেয়, তাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে ‘প্রি-ম্যাচিয়োর বেবি’। এই শিশুদের এবং তাদের মায়েদের তখন বিশেষ যত্নআত্তির প্রয়োজন। সেই নিয়েই আমরা কথা বললাম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে।
প্রি-ম্যাচিয়োর বার্থের কারণ
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বললেন, ‘‘সময়ের আগে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে। যদি কেউ আগে প্রি-ম্যাচিয়োর বেবির জন্ম দিয়ে থাকেন, তবে ফের একই সম্ভাবনা থেকে যায়। যাঁদের অনিয়ন্ত্রিত প্রেশার, সুগার বা কিডনির অসুখ আছে, তাঁরাও রিস্ক জ়োনের মধ্যে পড়েন। মায়ের সংক্রমণের কারণেও সময়ের আগে বাচ্চা জন্ম নিতে পারে। খুব অল্প বয়সে বা অনেক বেশি বয়সে যাঁরা মা হচ্ছেন, যাঁরা অপুষ্টিতে ভোগেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও প্রি-ম্যাচিয়োর বার্থ দেখা যায়। এবং যাঁরা অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে অভ্যস্ত, মাদক, ধূমপান বা অতিরিক্ত অ্যালকোহলে আসক্ত, তাঁরাও এই সমস্যায় পড়তে পারেন। মাল্টিপল প্রেগন্যান্সি অর্থাৎ টুইন বা ট্রিপলেট-এর ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে।’’
প্রিম্যাচিয়োর বেবির সমস্যা
শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ জানাচ্ছেন, সময়ের আগে জন্মানো বাচ্চার সকলকেই যে হাসপাতালে বেশি দিন থাকতে হবে, এমনটা নয়। ধরা যাক, কোনও বাচ্চা ৩৬ সপ্তাহে জন্ম নিল। কিন্তু সে খাওয়াদাওয়া ভাল করছে, শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল, শরীরের তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকছে, সে ক্ষেত্রে তাকে বেশি দিন হাসপাতালে রাখার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু প্রি-ম্যাচিয়োর বেবির ক্ষেত্রে অনেক সময় কিছু জটিলতা দেখা যায়, কারণ তাদের সিস্টেম ঠিক ভাবে কাজ করার মতো পরিণত হয়নি। অনেক সময় হাইপোথার্মিয়া, জন্ডিস, গ্লুকোজ় কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয় এই বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। আবার অনেক সময় ফুসফুস ঠিকমতো তৈরি হতে পারে না বলে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। লিভার ঠিকমতো কাজ না করায় জন্ডিস দেখা যায়। খাদ্যনালি অপরিণত অবস্থায় থাকায় সে সব রকমের খাবার সহ্য করতে পারে না। এবং শরীরে ইমিউন সিস্টেমও ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক গুণ বেড়ে যায়। এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে ‘নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট’ (নিকু) বা ‘স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিট’-এ বাচ্চাকে রেখে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেওয়া হয়। এখানে সাধারণত বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখা, পরিচ্ছন্নতা, দরকারমতো অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
বাড়িতে আনার পর
হাসপাতাল থেকে প্রি-ম্যাচিয়োর বাচ্চাকে ছাড়ার আগে দেখে নেওয়া হয় তার আর অক্সিজেনের দরকার পড়ছে কি না। সাধারণত অক্সিজেনের দরকার আর না পড়লে তখনই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে অন্য সমস্ত মাপকাঠি ঠিক থাকলে হোম অক্সিজেন থেরাপির ব্যবস্থা করেও বাচ্চাকে বাড়ি নিয়ে আসা যায়। সেটা চিকিৎসকেরাই স্থির করেন।
খাবারের ক্ষেত্রে মায়ের দুধের উপরেই সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয় বলে জানালেন ডা. ঘোষ। কিন্তু কখনও কখনও বাইরের দুধেরও দরকার পড়তে পারে। প্রি-ম্যাচিয়োর বেবির জন্য ফর্মুলা আছে, হিউম্যান মিল্ক ফর্টিফায়ার আছে, সেগুলোও দরকারমতো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দেওয়া যায়। আর দু’সপ্তাহ থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে দেওয়া হয় আয়রন, ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট।
তবে প্রি-ম্যাচিয়োর বেবির ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন দেওয়াতে কোনও সমস্যা নেই। নির্ধারিত সময়েই সেগুলি দেওয়া যায়।
পরিচ্ছন্নতা
প্রি-ম্যাচিয়োর বেবির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেটা মেনে চলা দরকার, তা হল পরিচ্ছন্নতা। ডা. অপূর্ব ঘোষ বলছেন, ‘‘বাচ্চার গায়ে ধাগা, তাবিজ, কালো সুতো-জাতীয় কোনও জিনিস পরানো একদমই উচিত নয়। এতে ময়লা হলেও চট করে বোঝা যায় না। বাচ্চাকে নিয়মিত বেবি সোপ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। নারকেল তেল, ময়শ্চারাইজ়িং লোশন বাচ্চাদের গায়ে লাগানো যেতে পারে। বাচ্চা যে যে জিনিস ব্যবহার করছে, সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে নিয়মিত ব্যবধানে। এবং শুধুমাত্র মা নন, বাচ্চা যার কাছে অনেকটা সময় থাকবে, তিনিও যাতে পরিচ্ছন্ন থাকেন, পরিষ্কার জামাকাপড় পরেন, সেই দিকে নজর দিতে হবে।’’
অপরিণত শিশুর চট করে সংক্রমণের শিকার হওয়ার ভয় থাকে। সুতরাং, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা তাদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি।
মায়ের যত্ন
ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্তের কথায়, ‘‘বাচ্চা নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম নিলে সাধারণত তার দিকেই সমস্ত মনোযোগ চলে যায়। কিন্তু মায়েদেরও যে এই সময় যত্নের প্রয়োজন, সেটা কারও মনে থাকে না। অথচ মায়ের সদ্য ডেলিভারি হয়েছে। শারীরিক দুর্বলতা যথেষ্ট। কিন্তু বাচ্চা যদি তখনও হাসপাতালে থাকে এবং মা বাড়িতে, তবে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম মা পান না। হাসপাতালে দৌড়োদৌড়ি করতে হয়। ফলে, পেটে, কোমরে, সেলাইয়ের জায়গায় ব্যথা থাকে।’’
মানসিক সমস্যাটিও অবহেলা করার নয়। বাচ্চাকে ঘিরে মায়ের উদ্বেগ, দুঃখ এ সময়ে খুব স্বাভাবিক। অনেক মা অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন। বাচ্চা হাসপাতালে থাকলে এবং মা’কে ছেড়ে দেওয়া হলে জন্মের পরেই তার স্পর্শ, তাকে বুকে নেওয়া— এই বন্ধনটাও গড়ে ওঠে না। ফলে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন মায়ের ক্ষেত্রে খুব বাড়ে। এই অবস্থায় দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
তখন মায়ের পাশে পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুদের থাকা দরকার। মা যতটা সম্ভব পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছেন কি না, ঠিক সময়ে ওষুধ, খাওয়াদাওয়া করছেন কি না, যতটা সম্ভব বিশ্রাম পাচ্ছেন কি না, এগুলো অন্যদেরও খেয়াল রাখতে হবে।
সন্তান হয়ে যাওয়া মানে সব
দৃষ্টি বাচ্চাটির দিকে চলে যাওয়া
নয়। বাচ্চার মা’কে শারীরিক ও মানসিক ভাবে ঠিক থাকতে হবে। তবেই তো মা-শিশুর সুন্দর বন্ধন
গড়ে উঠবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy