· অটিজ়ম এবং এডিএইচডি ছিল আয়ুষ্মানের। বিরল কিছু রোগ নিয়েই জন্মেছিল। ছেলে যত বড় হতে থাকল, বাবা-মায়েরা দেখলেন, না সে ঠিকমতো গুছিয়ে কথা বলতে পারে, না খাবার ঠিকমতো গিলে খেতে পারে। সমাজে মেলামেশা করতেও ভয় পায়। কিন্তু তার প্রতিভার বিকাশ ঘটছে সঙ্গীতে। সেখানে সে পারদর্শী।
· গুছিয়ে কথা বলতে পারত না সোহম। কিন্তু ক্যানভাসে রং-তুলি দিয়ে নিজের ভাবনার বিকাশ ঘটাত। বছর দুয়েক বয়স থেকেই বাবা-মা বুঝে গেলেন, ছেলে অটিজ়ম আক্রান্ত। আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা হলেও ছবি আঁকায় তার সমকক্ষ কমই আছে। সেখানে সে অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী।
দু’টি ঘটনাই সাম্প্রতিক সময়ের। কেউ ক্যানভাসে রং-তুলির ছোঁয়ায় শিল্পীমনের প্রকাশ ঘটায়। কারও গান এতটাই সঠিক সুর-তাল-লয়ে হয় যে, শ্রোতারা মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। সমাজ তাদের ‘বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন’ তকমা দিলেও তারা নিজের নিজের জগতে সত্যিই অসাধারণ। মানসিক অস্থিরতা, সমাজে মেলামেশা করার অক্ষমতা স্বভাবসিদ্ধ প্রতিভাকে ঠেকাতে পারে না। এমন শিশুরা সেই প্রতিভা নিয়েই জন্মায়, অথবা সঠিক পরিচর্যা ও সহযোগিতা পেলে প্রতিভাবান হয়ে উঠতে পারে। এরা অটিজ়ম আক্রান্ত। বিশ্ব অটিস্টিক দিবস উপলক্ষে এমন শিশুদের অসাধারণ কিছু ক্ষমতা নিয়েই আলোচনা করলেন পিয়ারলেস হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। বাস্তবে অটিজ়ম নিয়েও যে সেরা হওয়া যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন আরও অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিই।

বাস্তবে অটিজ়ম নিয়েও সেরা হওয়া যায়, শুধু প্রয়োজন আপনজনদের সাহচর্য। নিজস্ব চিত্র।
‘অটিজ়ম স্পেকট্রাম ডিজ়অর্ডার’ সে অর্থে কোনও অসুখ নয়, বিভিন্ন আচরণগত সমস্যাকে একসঙ্গে ওই নাম দেওয়া হয়েছে। অটিজ়ম বিষয়টি নিয়ে অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। তাই অনেক বাবা-মা তাঁদের শিশু অটিস্টিক জানলে দুঃখে ভেঙে পড়েন। কিন্তু অভিভাবকদের জেনে রাখা প্রয়োজন, অটিজ়ম নিয়ে জন্মানো শিশু গোড়া থেকেই সঠিক চিকিৎসায় থাকলে ও অনুপ্রেরণা পেলে আর পাঁচজন শিশুর মতোই বড় হতে পারে। সেই সঙ্গে উপরি পাওয়া তাদের বিশেষ প্রতিভা। এমনই নানা কথা উঠে এসেছে চিকিৎসকদের আলোচনায়। শিশুরোগ চিকিৎসক সৌমিক ধরের বক্তব্য, “কোন শিশুর মধ্যে কী প্রতিভা রয়েছে তা প্রকাশ্যে আনাই হল আসল থেরাপি। যে শিশুটি গান গাইতে পারে, তার অটিজ়মের চিকিৎসা হতে পারে মিউজ়িক্যাল থেরাপি দিয়েই। শিশুর সহজাত প্রতিভাই তার প্রতিবন্ধকতাগুলিকে প্রতিরোধ করতে পারে।”

অটিস্টিক অনেক শিশুই প্রতিভাবান, পাশে থাকতে হবে অভিভাবকদেরই। নিজস্ব চিত্র।
একই মত চিকিৎসক পাপিয়া খাওয়াশেরও। তিনি জানিয়েছেন, অটিজ়ম আক্রান্তদের সমাজ থেকে বিচ্যুত করে নয়, বরং সামাজিক মেলামেশা বাড়িয়ে, তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। চিকিৎসা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই হবে। আর এ ভাবেই রোগ সারানোর চেষ্টা চলছে।

অটিস্টিক ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা নিয়ে অনেক নতুন ভাবনাচিন্তা হচ্ছে। নিজস্ব চিত্র।
অটিজ়ম-এর নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে যেমন জিনঘটিত কারণ আছে, তেমনই অনেক অসুখ থেকেও অটিজ়ম হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রোমোজ়োমের সংখ্যার হ্রাস বা বৃদ্ধির কারণেও এই রোগ হয়। এই রোগের প্রকৃত কারণ নিয়ে এখনও অনুসন্ধান চলছে। আবার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ভ্রূণের বা জন্মের পরে শিশুর মস্তিষ্কে আঘাত লাগলেও সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত মদ্যপান ও ধূমপান, মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, প্রি-ম্যাচিয়োর ডেলিভারি, মায়ের উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিকেও বাদ দেওয়া যায় না। শিশুরোগ চিকিৎসক সংযুক্তা দে জানিয়েছেন, সমস্যা যত গভীরই হোক, সহমর্মিতা, ধৈর্যের মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুদের পাশে দাঁড়াতে পারলে তাদেরও বিকাশ স্বাভাবিক ভাবেই হবে। আয়ুষ্মান ও সোহমের মতোই আরও অনেক অটিস্টিক ছেলেমেয়ে রয়েছে, যারা কেবল কিছু ভ্রান্ত ধারণার কারণে সমাজ থেকে আলাদা হয়ে আছে। এমন ছেলেমেয়েদের চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছেন চিকিৎসকেরা। আগামী দিনে এই নিয়ে আরও বড় লক্ষ্যের পথেই হাঁটা হবে।