প্রথম দেখাতেই প্রেম, না কি আবেগের বন্যা? শুরুতে ভাল লাগলেও, মনের আগলখোলা কথা বলার ব্যাপারে সাবধান। এমন কি হয়েছে আপনার সঙ্গে? প্রথম সাক্ষাৎ হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্যের অবসাদ ও মনখারাপের কথা শোনার আসর? কখনও ভেবে দেখেছেন, এমন পরিস্থিতি আদৌ আপনার জন্য ভাল, না কি খারাপ?
প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে আরও সচেতন হচ্ছেন মানুষ। প্রত্যেক ধাপ বা কার্যকলাপকে খতিয়ে দেখার অভ্যাস শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন নতুন অভিধা তৈরি হচ্ছে। তেমনই এক নতুন ইংরেজি শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে— ‘ফ্লাডলাইটিং’।
কী এই ফ্লাডলাইটিং?
অনলাইন ডেটিং অ্যাপ হোক অথবা কোনও পরিচিতের মাধ্যমে আলাপ, প্রথম সাক্ষাতেই মনের আগল খুলে কথা বলার প্রবণতাকে ‘ফ্লাডলাইটিং’ বলা হচ্ছে। আর এই প্রবণতার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যা খুব ইতিবাচক নয়। ডেটিং অ্যাপ ‘সো সিংকড’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেসিকা অ্যালডরসনের পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রথম দেখাতেই ব্যক্তিগত ঘটনা অথবা খারাপ স্মৃতির কথা বলে দেওয়ার ভাল-খারাপ, দু’রকম কারণই থাকতে পারে। হয়, সত্যিই সেই মানুষটি উল্টো দিকের মানুষটির সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছেন। নয়তো, জল মেপে নেওয়ার জন্য অনেকে প্রথম ডেটে অতিরিক্ত ব্যক্তিগত কথা বলতে থাকেন। আসলে তিনি দেখতে চান, নতুন মানুষটি তাঁর এই সত্তাকে আদৌ সামলাতে পারবেন কি না। সে ক্ষেত্রে অত্যন্ত পরিকল্পিত পদক্ষেপ এটি। প্রাথমিক ভাবে সহানুভূতি জাগানোর জন্য, তার পর দ্রুত ঘনিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার জন্য।

আবেগ-অনুভূতির অতিরিক্ত প্রকাশের মধ্যে আনন্দ পান অনেকে। ছবি: সংগৃহীত।
কিন্তু আবেগের এই বন্যা উল্টো দিকের মানুষটিকে বিপদে ফেলে দিতে পারে। ফ্লাডলাইটিংয়ের ফলে খুব দ্রুত বিশ্বাস অথবা এক প্রকার মানসিক বন্ধন তৈরি হয়ে যায়, যা সহজে ভাঙা যায় না। উপরন্তু এর পর থেকে একটানা মানুষটির অতিমাত্রিক আবেগকে সামলে চলতে হয়। যেই মানুষটি এই ভার কাঁধে নিয়ে ফেলছেন, তাঁর নিজের কথা বলার পরিসর কমে যাচ্ছে। এই বন্ধন আদপেই ভরসাযোগ্য কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
ফ্লাডলাইটিং নিয়ে কী মনে করেন মনোবিদ?
আনন্দবাজার ডট কম-কে মনোবিদ ঝুমা বসাক বলছেন, ‘‘কাউকেই খুব সহজে খারাপ বা ভাল বলে দেওয়া যায় না। এক একটা সময়ের এক এক ধরনের প্রয়োজনীয়তা থাকে। এখন অনলাইন ডেটিংয়ের যুগে সময়ের এই চাহিদা আরও তীব্র হয়েছে।''
ফ্লাডলাইটিংয়ের কারণ কী?
ঝুমা জানাচ্ছেন, ফ্লাডলাইটিংয়ের পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন—
প্রথমত, মানুষের হাতে সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘনিষ্ঠতায় যেতে চান তাঁরা। যদি দেখা যায়, মনঃপূত বন্ধন তৈরি হচ্ছে না, তা হলে সময় খরচ না করে সেটিকে নাকচ করে পরেরটায় এগিয়ে যান।
দ্বিতীয়ত, মানুষ নিজেদের জীবনের অথবা অন্য কারও গভীরতম অভিজ্ঞতা বহন করতে পারেন না আর। সারা ক্ষণ দরকার পড়ে এমন কাউকে, যাঁর কাছে সবটা উগরে দেওয়া যায়। এর পর তাঁর নিজের দায়িত্ব কমে যায়। লিঙ্গ নির্বিশেষেই এই প্রবণতা দেখা যায়। আসলে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত আঘাতগুলিকে বহন করার মানসিক ক্ষমতা কমে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
তৃতীয়ত, এই সময়টায় মানুষ কেবল নিজেকে নিয়েই ভাবতে ভালবাসেন। নিজেরই প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। এই কালপর্বে নিজের বেদনা, আনন্দ, উদ্যাপন— সব কিছুই সকলের চোখের সামনে, প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে চান তাঁরা। ব্যক্তিগত পরিসর মেনে চলার প্রয়োজন কমে গিয়েছে।
চতুর্থত, আবেগ-অনুভূতির অতিরিক্ত প্রকাশের মধ্যে আনন্দ পান অনেকে। যার মানে হল, তাঁরা তাঁদের চরিত্রগত দুর্বলতাকে জাহির করার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন। সেই কারণেই ফ্লাডলাইটিংয়ের মতো প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে।
ঝুমা বসাকের কথায়, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দু’টি মানুষ অবশ্যই কাছে আসবেন, নিজের কথা বলবেন, অবসাদের কথা বলবেন। দু’জনের মানসিক আদানপ্রদানের জায়গা থাকবে। কিন্তু এই ফ্লাডলাইটিংয়ের সঙ্গে সেটির কোনও সম্পর্ক নেই। প্রথম সাক্ষাৎ কখনওই থেরাপি সেশন হতে পারে না।’’