বদলে গিয়েছে বিয়ের ছবির ধরন। ছবি: সংগৃহীত
রোববার কাকভোরে ময়দানে ভিড়। জোড়ায় জোড়ায় সেজেগুজে হাজির অনেকে। প্রত্যেক জোড়ার সঙ্গে ক্যামেরা এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে ৪-৫ জনের দল। সুবিধা মতো জায়গার খোঁজে প্রত্যেকে। পছন্দের জায়গা যদি ইতিমধ্যেই দখল হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে অপেক্ষা— কখন ফাঁকা হবে।
প্রতি রবিবার এটাই চেনা ছবি হয়ে গিয়েছে কলকাতা ময়দানের। শীতের শেষে গরমের শুরুতে ভিড় কমলেও একেবারে বদলে যায়নি এই ছবি। যার উপলক্ষ বিয়ের ছবি তোলানো। বিয়ের ছবি মানেই, শুধু সাতপাক, অগ্নিসাক্ষী, বাবার কাঁধে মেয়ের কান্না, তার পরে বৌভাতে সিংহাসন-মার্কা চেয়ারে বসে বর-বৌয়ের উপহার নেওয়া নয়। এখন বিয়ের ছবি মানে, তার আগে-পরে-মাঝের একশো এক পর্যায়। প্রতিটার হাজারও পোশাকি নাম। সব মিলিয়ে একটা পুরোদস্তুর কর্মযজ্ঞে পরিণত হয়েছে ‘ওয়েডিং ফোটোগ্রাফি’ বা বিয়ের ছবি তোলা। একে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন নতুন প্রজন্মের অনেকেই।
কলকাতায় বিয়েবাড়ির ছবি তোলাকে পেশা হিসেবে নেওয়াটা কতটা সাহসের? এই পেশার সঙ্গে ৯ বছর যুক্ত সুতীর্থ বসু। গৌরব চট্টোপাধ্যায়, পাওলি দাম, রাজ চক্রবর্তী, দুই ভাই অর্জুন আর গৌরব চক্রবর্তীর বিয়ের ছবি তুলেছেন সুতীর্থ। বলছেন, ‘‘এখন বাঙালি বাড়িতেও বিয়ের ছবি তোলানোর জন্য আলাদা করে বাজেট রাখা হয়। হালে ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ করে বিয়ের ছবি তুলিয়েছেন কোনও কোনও পরিবার। তাঁরা মোটেই কোনও সেলিব্রিটি নন।’’ সুতীর্থর কথা থেকে পরিষ্কার, বর্তমানে আয় বেড়েছে এই পেশায়। এবং সেই কারণেই নতুনদের আসার প্রবণতাও বেড়েছে।
নতুনেরা আসায় প্রতিযোগিতা বেড়েছে। পুরনোরা কি চাপে? ৮-৯ বছর এই পেশায় কাটিয়ে ফেলা বিল্বনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘প্রচুর নতুন ছেলেমেয়ে কাজ করতে আসছেন। কিন্তু তাঁদের একটা বড় অংশই নকলনবিশির রাস্তা নিচ্ছেন। সেলিব্রিটিদের বিয়ের ছবি দেখে, সেগুলির মতো করে এখানে ছবি তোলার চেষ্টা করছেন। নতুনত্বের কথা ভাবছেন না। তাতে নান্দনিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। অনুকরণ কখনও কখনও হাস্যকরও হয়ে যাচ্ছে।’’ বেশ কয়েক বছর বিয়ের ছবি তুলছেন অভিষেক মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘‘নতুনেরা অনেক সময়ে কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি হয়ে যান। ফলে পুরনোদের সামনে প্রতিযোগিতা জোরদার হয়ে যায়।’’
নতুন প্রজন্ম অনেক বেশি পেশাদার। এটা মেনে নিয়েও সুতীর্থর বক্তব্য, ‘‘ইদানীং যাঁরা বিয়ের ছবি তুলতে আসছেন, তাঁদের অনেকেই কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে গিয়ে প্রতিশ্রুতি রাখতে পারছেন না। ফলে গোটা পেশার নাম খারাপ হচ্ছে। সেটার প্রভাব সকলের উপরেই আসছে।’’
অর্থ এসেছে, সে কথা মেনে নিচ্ছেন সকলেই। কিন্তু সম্মান? সুতীর্থর কথায়, ‘‘ছোট থেকে আলোকচিত্রী হতে চেয়েছি। ইচ্ছে ছিল বন্য প্রাণীদের ছবি তুলব। সবচেয়ে হতচ্ছেদা করতাম বিয়ের ছবি তোলা। ‘এই ফটোগ্রাফার, এ দিকে এসো’— এ রকম একটা অবমাননাকর ডাক শুনতে চাইনি কখনও।’’ একই মত বিল্বনাথেরও। ‘‘চাকরি ছেড়ে যখন এই পেশায় ঢুকে পড়লাম, অনেকেই বলতেন, এটা কোনও কাজ হল!’’
সম্মান দেওয়ার ছবিটাও গত কয়েক বছরে বদলেছে বলে মত সুদেষ্ণা সরকারের। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম যখন এই পেশায় আসি, একটি বাড়িতে আমাকে বলা হয়েছিল, ‘তুমি ছবি তুলবে, তোল। কিন্তু সঙ্গে একজন ছেলে চিত্রগ্রাহক রেখো।’’ সুদেষ্ণার দাবি, খুব রক্ষণশীল পরিবারেও মেয়েদের ছবি তোলার জন্য ছেলে আলোকচিত্রীর উপরে বেশি ভরসা রাখতেন অনেকেই। ‘‘এখনও আমার কোনও ছবি দেখে কারও ভাল লাগলে, তাঁদের বলতে শুনেছি, ‘ওটা তো সঙ্গের ছেলেটার তোলা’। তবে এখন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে।’’
একই মত বিল্বনাথেরও। ‘‘একটা বাড়িতে ‘প্রি ওয়েডিং’, ‘ওয়েডিং’-এর ছবি তুলতে গিয়ে এত ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল, আমাদের কারণেই ওঁরা ‘পোস্ট ওয়েডিং’-এর ছবিও তোলানোর কথা ভাবলেন। আমরা প্রস্তাব করেছিলেন, সেটা সিকিমে হোক। শুধু বন্ধুত্বের কারণেই ওঁরা নিজেদের খরচে আমাদের লাদাখে নিয়ে গিয়েছিলেন। এগুলিও তো পেয়েছি।’’
‘‘একটা সময়ে এই পেশাটাকেই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতাম। এখন এটা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারি না। সেটা শুধু টাকা বা সম্মানের কারণে নয়’’, বলছেন সুতীর্থ। এ প্রসঙ্গে জানালেন একটি ঘটনা। ‘‘একদিন সকালে ঘুম ভাঙল কনের মায়ের ফোন পেয়ে। তার আগের রাতে ছিল ‘বিদাই’-এর অনুষ্ঠান। একটা ছবি তুলে পাঠিয়েছিলাম। ফোন পেয়ে ভাবলাম, বৌভাতের ছবি তুলতে কখন যাব জি়জ্ঞাসা করতে ফোন করছেন। কিন্তু তিনি বললেন, কী করেছো সুতীর্থ! তোমার কালকের তোলা ছবিটা দেখে বাড়ির সবাই কাঁদছে!’’
অর্থ হোক, কিংবা কাজের স্বীকৃতি— তা সে যা-ই হোক না কেন, আপাতত তার মধ্যেই স্থায়ী এক পেশার সন্ধান করে নিচ্ছেন বাঙালি নতুন প্রজন্ম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy