বাড়ছে ওষুধ নির্ভর যৌনসম্পর্ক ছবি: সংগৃহীত
মাঝ দুপুর। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। উত্তর কলকাতার এক ছোট ওষুধের দোকান। দোকানের ভিতরে সাকুল্যে দু’জন ক্রেতা। কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন বছর তিরিশের এক যুবক। সোজা দাঁড়ালেন কাচের টেবিলের সামনে। বিক্রেতা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই যুবক হাত রাখলেন কাউন্টারের কাচে। ডান হাতের তর্জনি দিয়ে টেবিলের উপর আঁকলেন ইংরেজির ছোট্ট ‘ভি’। ব্যস! ওইটুকুই। আর কিছু বলতে হল না। দোকানদার এগিয়ে দিলেন এক পাতা ওষুধ। দামও দু’পক্ষেরই জানা। হিসেব করে পয়সা দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন যুবক।
প্রায় প্রতিদিন এ ভাবেই কলকাতা-সহ ভারতের অন্যান্য শহরে বিক্রি হচ্ছে গাদা গাদা যৌন বলবর্ধক ওষুধ। প্রচলিত নামে ‘ভায়াগ্রা’। যদিও প্রকৃত ভায়াগ্রা আমেরিকার ফাইজার কোম্পানির তৈরি একটি ওষুধ। যার দামও তুলনায় অনেক বেশি। ওষুধে থাকা যৌগটির নাম ‘সিলডেনাফিল সাইট্রেট’। ভারতে নির্মিত ‘সিলডেনাফিল সাইট্রেট’ গোত্রের ওষুধের দাম তুলনায় অনেক কম। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আসল ভায়াগ্রার দশ ভাগের এক ভাগও নয়। আর তাতেই নির্দ্বিধায় এই ওষুধের দিকে ছুটছে একটা প্রজন্মের পুরুষ।
কী বলছে পরিসংখ্যান? ‘অল ইন্ডিয়া অরগ্যানাইজেশন অব কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস’ বা ‘এআইওসিডি’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি বেড়েছে যৌন বলবর্ধক ওষুধের বিক্রি। ২০১০ সালে ভারতে এই ধরনের ওষুধের বাজারের আয়তন ছিল প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫৭ কোটি টাকায়। আর সেখান থেকেই চিকিৎসকদের অভিমত, একটা গোটা প্রজন্মের পুরুষ অন্য এক মহামারির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যার নাম ভায়াগ্রা।
‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘আইএমএ’-এর প্রাক্তন প্রধান কেকে অগ্রবাল মুম্বইয়ের এক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বহু রোগীই চান চিকিৎসকরা তাঁদের ‘ভায়াগ্রা’ গোত্রের ওষুধ দিন। কিন্তু পাশাপাশি এটাও চান না, সেটি প্রেসক্রিপশনে লেখা হোক। কারণ তাতে কাছের মানুষের কাছে সেই সব রোগীদের সম্মানহানীর আশঙ্কা থাকে। তাঁরা দোকান থেকে এমনিই কিনে নেন এই জাতীয় ওষুধ।’’ বহু ক্ষেত্রেই ‘সিলডেনাফিল সাইট্রেট’ গোত্রের ওষুধ কিনতে কোনও প্রেসক্রিপশন লাগে না। চেনা দোকান গিয়ে এমনি বললেই হয়। নচেৎ কাচের উপর অদৃশ্য ‘ভি’ অক্ষর লেখার মতো আরও হাজারো ইশারা তো আছেই।
কিন্তু কেন বাড়ছে এই জাতীয় ওষুধের বিক্রি? এ জন্য মনোবিদরা মূলত দায়ী করছেন মানসিক চাপকে। মনোরোগ চিকিৎসক সঞ্জয় গর্গ আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছিলেন, ‘‘উদ্বেগ, অবসাদ এবং মানসিক চাপ বাড়লে তার প্রভাব পড়ে যৌনস্বাস্থ্যে। অনেকে সেই মানসিক চাপ কাটাতে অন্য এক ধরনের ওষুধ খান। তার প্রভাবেও যৌন অক্ষমতা বাড়তে থাকে।’’ এর ফলে পুরুষের বন্ধ্যাত্ব, সঙ্গম কালে আকর্ষণ বোধ না করা এবং যৌনাঙ্গের শিথিলতার মতো সমস্যা বাড়ে। চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে বলে ‘ইরেকটাইল ডিসফাংশন’। আর এই ধরনের সমস্যা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে ‘ভায়াগ্রা’ গোত্রের ওষুধের বিক্রি। করোনাকালে তা আরও বেড়েছে। কারণ এই সময়ে তীব্র ভাবে বেড়েছে মানসিক চাপ।
পেশায় তথ্যপ্রযুক্তির কর্মী অর্ণব সরকার (নাম পরিবর্তিত)-এর গত তিন বছর ধরে স্থায়ী প্রেমের সম্পর্কে রয়েছে। কাজের চাপে যৌন সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল বলে, বন্ধুদের পরামর্শে অর্ণব এক সময় ‘সিলডেনাফিল সাইট্রেট’ গোত্রের ওষুধ খেতে শুরু করেন। তাতে কি সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে? অর্ণবের কথায়, ‘‘ওষুধটা ধরার প্রথম প্রথম শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টা সহজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারি, ওষুধের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। ওটা ছাড়া শারীরিক সম্পর্কের মধ্যে যেতেই পারি না। তাতে সার্বিক ভাবে সম্পর্কটা খারাপ হচ্ছে টের পাই।’’
কিন্তু অর্ণবের মতো অবস্থা নয় মধুমিতা এবং দেবাংশু (নাম পরিবর্তিত)-র। বেশ কয়েক বছর আগে বিয়ে হয়েছে দু’জনের। ‘‘এক বার গোয়া বেড়াতে গিয়ে শুধুমাত্র পরীক্ষানিরীক্ষার জন্যই আমরা ঠিক করলাম ভায়াগ্রা কিনব। আমি খেলাম। একেবারে অন্য রকম অনুভূতি,’’ বলছেন দেবাংশু। মধুমিতার কথায়, ‘‘এমনিতে আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে কোনও সমস্যাই ছিল না। কিন্তু দেবাংশু ভায়াগ্রা খাওয়ার পরে যৌনসম্পর্ক উপভোগের বিষয়টা দু’জনেরই বহু গুণ বেড়ে গিয়েছিল। অন্য বার যদি ১০ হয়, ভায়াগ্রা নিয়ে সেটা ১০০।’’ মধুমিতা আর দেবাংশু অবশ্য এর পরে আর মাত্র দু’বার এ ধরনের ওষুধের ব্যবহার করেছেন। কারণ তাঁদের দাবি অনুযায়ী, বিষয়টি খুব কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছিল। হারিয়ে যাচ্ছিল অনুভূতি। কিন্তু সকলে তাঁদের মতো থামতে পারেন না। সেই কারণেই বাড়ছে ভায়াগ্রার ব্যবহার। এর উপর নির্ভরশীলতা।
কিন্তু এর ফলে স্বাস্থ্যের কী হাল হচ্ছে? হালের বেশ কিছু গবেষণা বলছে, যাঁরা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভোগেন, ভায়াগ্রা বা ‘সিলডেনাফিল সাইট্রেট’ গোত্রের ওষুধ তাঁদের হৃদযন্ত্রের জন্য ভাল। কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া ভায়াগ্রার তেমন কোনও ক্ষতিকারক দিকও এখনও পর্যন্ত টের পাওয়া যায়নি। এর ফলে রক্তচাপ কিছুটা কমে যায়। তাই মদ্যপানের পরে এই জাতীয় ওষুধ খেলে শরীর খারাপ হতে পারে। এ তো গেল তাৎক্ষণিক বিষয়। কিন্তু দীর্ঘ দিন এই জাতীয় ওষুধ খেয়ে গেলে, যৌনসম্পর্কের চরম অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদের। এমন নির্ভরতা তৈরি হতে পারে, যাতে এই ওষুধ ছাড়া সঙ্গম আর হয়তো সম্ভবই হবে না অনেকের ক্ষেত্রে। ‘সিলডেনাফিল সাইট্রেট’ বিক্রি যে হারে বাড়ছে, তাতে একটা গোটা প্রজন্মের পুরুষের সঙ্গে এমন হতে পারে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy