ষাটের দশকে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কন্ট্রাসেপটিভ পিলকে ছাড়পত্র দেওয়ার ঘটনা মেয়েদের জীবনে একটা ছোটখাটো বিপ্লবই ঘটিয়ে ফেলেছিল। ছাড়পত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল জনপ্রিয়।
পরের যাত্রাপথটা অবশ্য খুব মসৃণ ছিল না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে কন্ট্রাসেপশনকে আক্রমণ করা হয়েছে। কখনও ধর্মের দোহাই দিয়ে, কখনও বলা হয়েছে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভয়ঙ্কর। কিন্তু এর পথচলা বন্ধ হয়নি। অবাঞ্ছিত প্রেগন্যান্সি রোধে এখন নানা উপায় আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মধ্যে প্রথম স্থানে কন্ট্রাসেপটিভ পিলই।
রকমভেদ
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় জানালেন, কন্ট্রাসেপটিভ পিল মূলত তিন ধরনের। প্রথমত, কম্বাইনড পিল, যাতে ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন— দু’ধরনের হরমোনই থাকে। এই পিলই সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত। পিরিয়ডসের সাইকেল অনুযায়ী খেতে হয় এটি। পিরিয়ডসের প্রথম দিন থেকে চতুর্থ দিনের মধ্যে খাওয়া শুরু করে ২১ দিন পর্যন্ত একটানা রোজ একটা করে খেয়ে যেতে হয়। দ্বিতীয়ত, ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপশন। ইন্টারকোর্সের পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খেতে হবে এই পিল। এতে হাই ডোজ় প্রোজেস্টেরন দেওয়া থাকে। তৃতীয়ত, শুধু মাত্র প্রোজেস্টেরন পিল, যেটি নিয়মিত একটি করে খেতে হয়। সাধারণত, যাঁরা বাচ্চাকে স্তন্যপান করাচ্ছেন, তাঁদের এই পিল দেওয়া হয়। ডায়াবিটিস, হার্ট ডিজ়িজ, মাইগ্রেনের মতো সমস্যা যাঁদের আছে, তাঁদের ইস্ট্রোজেন দেওয়া ট্যাবলেট দেওয়া যায় না। এই পিল তাঁদের জন্যও।
কী ভাবে কাজ করে
ডা. চট্টোপাধ্যায় জানালেন, কম্বাইনড পিল মূলত তিন ভাবে কাজ করে। এটি ওভিউলেশন আটকে দেয়। জরায়ুর মুখ বা সার্ভিক্সে থাকা মিউকাসের পর্দাটিকে মোটা করে দেয়, যাতে স্পার্ম তা ভেদ করে ঢুকতে না পারে। এবং জরায়ুর যে অংশে সন্তান থাকে, সেই লাইনিংকেও পাতলা করে দেয়। চিকিৎসকদের মতে, এটিই সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে প্রেগন্যান্সি আটকাতে পারে, যদি ঠিক ভাবে খাওয়া হয়। কম্বাইনড পিলের ব্যর্থতার উদাহরণও খুবই কম।
শুধু মাত্র প্রোজেস্টেরন পিল, যা সদ্য মায়েদের দেওয়া হয়, তার প্রধান কাজ হল, জরায়ুর মুখ আটকে দেওয়া একটা শক্ত মিউকাসের পর্দা দিয়ে। আর ইমার্জেন্সি পিল হল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রোজেস্টেরন, যেটি খেলে পিরিয়ড হয়ে যায়।
খাওয়ার নিয়ম
কম্বাইনড পিল টানা তিন সপ্তাহ খেয়ে যেতে হয়। সাধারণত ডিনারের পর খাওয়াই নিয়ম। এখন লো ডোজ় পিল হয় বলে নির্দিষ্ট সময় মেনে খেতে হয়। সেটি না হলেই ব্রেকথ্রু ব্লিডিং হতে পারে। যদি কেউ রোজ রাত ১০টায় এই পিল নেন, তা হলে ১০টার এক ঘণ্টা এ-দিক ও-দিক করা যেতে পারে। কিন্তু তার বেশি না করাই ভাল। কোনও দিন নিতে ভুলে গেলে ১২ ঘণ্টার মধ্যে পিলটি খেতে হবে, আবার রাতের পিলটি নিয়ম মতো খেয়ে নিতে হবে। দু’দিন ভুলে গেলে পরবর্তী অন্তত সাত দিন কন্ট্রাসেপটিভ পিলের সঙ্গে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কন্ডোমও ব্যবহার করা উচিত। ২১ দিন টানা খেয়ে এই পিল বন্ধ করলে পিরিয়ডস শুরু হয়। আবার পিরিয়ডসের তৃতীয় বা চতুর্থ দিন থেকে অন্য প্যাকেটটি ব্যবহার করতে হবে। কিছু পিলের ক্ষেত্রে ২৮টি ট্যাবলেটের প্যাকেটও পাওয়া যায়। সেটি একটানা খেয়ে যেতে হয়। নির্দিষ্ট সময়মতো পিরিয়ডস হয়ে যায়।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি?
ডা. চট্টোপাধ্যায়ের মতে, এই ধরনের পিলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই কম। তাও কিছু ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, খিদে না পাওয়া, সামান্য স্পটিং বা ব্লিডিং দেখা যেতে পারে। সাধারণত পাঁচ-সাত দিনের মধ্যেই এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি কমে আসে। অবশ্য কারও ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিন পিল নিলে ভ্যাজ়াইনাল ড্রাইনেসের সমস্যা দেখা দেয়, যৌনমিলনে অনীহাও দেখা যেতে পারে। তবে, এই ধরনের সমস্যা খুবই কম। বরং নিয়মিত পিল নেওয়ার ফলে দেখা গিয়েছে, ওভারিয়ান ক্যানসার, কোলন ক্যানসার, ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। এমনকি পিল খাওয়া বন্ধ করার পরের পাঁচ থেকে দশ বছর ওভারিয়ান ক্যানসারের ভয়ও কম থাকে। শুধু মাত্র গর্ভনিরোধক হিসেবেই নয়, যাঁরা অনিয়মিত পিরিয়ডস বা অত্যধিক ব্লিডিংয়ের সমস্যায় ভোগেন, তাঁরাও চিকিৎসকের পরামর্শমতো পিল খেতে পারেন। পিরিয়ডসের সময়ে যাঁরা প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কষ্ট পান, তাঁদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা অনেক সময় ‘১০০ ডেজ় পিল’ খাওয়ার পরামর্শ দেন। অর্থাৎ পিরিয়ডসকে ১০০ দিন পরপর করার জন্য কোনও বিরতি ছাড়াই চার-পাঁচ প্যাকেট একটানা খেয়ে যাওয়া। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এই পিল কখনওই খাবেন না।
কিন্তু হাই ব্লাডপ্রেশার, ডায়াবিটিস, মাইগ্রেনের সমস্যা থাকলে পিল খাওয়া যায় না। হাই ব্লাডপ্রেশার থাকলে নিয়মিত প্রেশার চেক করতে বলা হয়। প্রেশার বেড়ে গেলেই পিল বন্ধের পরামর্শ দেওয়া হয়। যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও কম্বাইনড পিল বেশি দিন খাওয়া যায় না। কারণ, অনেক সময় তাঁদের ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস বা পায়ের শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে যায়। বিদেশে এই সমস্যা প্রায়ই দেখা যায়।
মনে রাখা জরুরি
অনেকে মনে করে, টানা পিল খেয়ে গেলে গর্ভধারণে সমস্যা হয়, যা ঠিক নয়। ডা. চট্টোপাধ্যায়ের মতে, যে মাসে পিল বন্ধ করা হচ্ছে, ওভিউলেশন তার পরের মাস থেকেই শুরু হতে পারে। সুতরাং, প্রেগন্যান্সিতে সমস্যা হয় না।
অনেকে ইমার্জেন্সি পিলে অত্যধিক ভরসা করেন। ঘটনা হল, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এই পিল নিলে তা যতটা কার্যকর, যত দেরি হবে, তার কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়।
দেখা গিয়েছে, ইমার্জেন্সি পিল খাওয়ার পর এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ইউটেরাস হয়তো প্রেগন্যান্সি আটকাচ্ছে, কিন্তু প্রেগন্যান্সি ফ্যালোপিয়ান টিউবে চলে আসছে। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। এবং এ ক্ষেত্রে প্রসূতির প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা থাকে। ফলে, ইমার্জেন্সি পিলে ভরসা করা উচিত নয়।
এই কারণেই এখনও চিকিৎসকরা প্রেগন্যান্সি রোধে সবচেয়ে নিরাপদ উপায় হিসেবে কম্বাইনড পিলের উপরেই ভরসা করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy