লেক মাগাডি- গোরোংগোরো ক্রেটার। অত্যধিক গরমে এই হ্রদের রং পাল্টে গোলাপি হয়ে যায়।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। নিস্তব্ধ চরাচর। মাঝে মাঝে অজানা পাখির ডাক নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে। বারান্দায় বেরিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। সবুজ কার্পেটে ঢাকা লন পেরিয়ে বিস্তৃত কফি বাগান। মৃদু কফির সুবাস বাতাসে। একটা খট্টাস জাতীয় প্রাণী হঠাৎ কোথা থেকে বেরিয়ে এসে এদিক-ওদিক চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ত্রস্ত পায়ে আবার গর্তে লুকিয়ে পড়ল। আমরা আছি গোরোংগোরো ফার্ম হাউস, তানজানিয়া। চারদিকে কফি খেত, তার মধ্যেই প্রায় ৫০০ একর জায়গা নিয়ে এই আবাস। পশ্চাতপটে ওলডিয়ানি আগ্নেয়গিরি, সামনে চোখজুড়ানো গাঢ় সবুজ উপত্যকা। আমাদের কটেজটি ‘কাকাকুয়ানা’ পাখির নামে। বেশ খোলামেলা, অত্যাধুনিক ব্যবস্থাসহ সাবেকি আসবাবে সাজানো। লাগোয়া বারান্দায় বসে আদিগন্ত সবুজ উপত্যকায় চোখ রেখেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। প্রায় ৫০০ প্রজাতির পাখি আছে আশপাশে।
প্রাতরাশের পর গেলাম গোরোংগোরো ক্রেটারে। ক্রেটার বা ক্যালডেরা, যা চলতি বাংলায় কড়াই, একাধারে ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক বিস্ময়। অনেক বছর আগে প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে এর সৃষ্টি। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পাহাড়চূড়ার ধ্বংসস্তূপ জ্বালামুখের ভিতরেই পড়লে তৈরি হয় ক্যালডেরা। গোরোংগোরো ক্রেটার পৃথিবীর বৃহত্তম ,অবিচ্ছিন্ন, অক্ষত, ৬০০ মিটার গভীর ফাঁকা ক্যালডেরা বা কটাহ। এটি ইউনেস্কোর ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মধ্যে পড়ে, আফ্রিকার সাতটি আশ্চর্যের একটি। স্থানীয় ভাষায় গোরোংগোরো অর্থাৎ ব্ল্যাক হোল। আবার কারও মতে এই শব্দের উৎপত্তি গরুর গলার ঘণ্টার আওয়াজ থেকে। মাসাইদের চারণভূমিতে দিনের শেষে ঘরে ফেরার পথে দলপতি গরুর গলার ঘণ্টার আওয়াজ তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। গেটের কাছে এসে প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র নিয়ে এগোতে থাকলাম ক্যালডেরার দিকে। বাইরে থেকে মনে হয় সবুজ গাছে ঢাকা পাথুরে পাহাড়। এখানে একপাল জিরাফের সঙ্গে দেখা, এরা কটাহের বাইরেই থাকে, চড়াই ভেঙে কড়াইয়ের ও-পারে যেতে পারে না। পাকদণ্ডী পথ দিয়ে গাড়িতে আস্তে-আস্তে উপরে উঠছি, একসময় কড়াইয়ের একেবারে কানার উপরে একটা ভিউ পয়েন্টে এসে দাঁড়ালাম। বেশ ঠান্ডা হাওয়া, মাটি থেকে প্রায় ২২০০ মিটার উপরে। চওড়া কানার উপর থেকে ভিতরে চেয়ে দেখি গাঢ় নীল পাহাড়ে ঘেরা সমতলভূমি, নীল আকাশের নীচে মাঝেমাঝে সবুজের আভা, কোথাও কালো মাটি, দূরে কোথাও পান্না সবুজ জলের রেখা। অসংখ্য ছোট ছোট কালো রঙের বিন্দু এখানে ওখানে। এ ছাড়াও সুতোর মতো একটা কালো রেখা এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে। এত বড় যে, তা আগ্নেয়গিরির গুহামুখ হতে পারে ধারণার বাইরে ছিল। ব্যাস প্রায় ১৯-২০কিলোমিটার। লক্ষ লক্ষ বছর আগে এই বৃহৎ কটাহ তৈরি হওয়ার পরে যখন প্রকৃতি ঠান্ডা হল তখন খনিজসমৃদ্ধ আগ্নেয়গিরির মাটি (স্থানীয়দের কথায় ব্ল্যাক কটন) থেকে জন্ম নিল বড় বড় ঘাস ও অন্যান্য উদ্ভিদ যা তৃণভোজী প্রাণীদের প্রিয় খাদ্য। আবার তারাই মাংসাশী প্রাণীর খাদ্য। এ ছাড়াও দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে আসা সমুদ্রের ভিজে নোনা হাওয়ায় কিছু বিশেষ উদ্ভিদ জন্মায় ও বেশ কিছু পোকামাকড়ের বাড়বৃদ্ধি হয়, যারা আবার বিশাল পক্ষীকুল ও বিচিত্র সরীসৃপ প্রাণীর বেঁচে থাকার রসদ। তা ছাড়াও আছে একাধিক জলাভূমি, মিষ্টি জল অথবা নোনাজলের। সব কিছু মিলে বন্যপ্রাণীদের স্বর্গরাজ্য। সেই জন্যই এ রকম একটি ঘেরা জায়গায় প্রাণিজগৎ এত সমৃদ্ধ। ক্যালডেরাটির ভিতরে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নিজস্ব বায়োসিস্টেম তৈরি হয়েছে।
এ বার কড়াইয়ের ভিতরে নামতে থাকলাম। বেশ উতরাই। একটা কালো চিতা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সামনে গাড়ি দেখেই আবার চলে গেল জঙ্গলে। এরা একটু লাজুক, চট করে মানুষের কাছে আসে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই কড়াইয়ের মেঝেতে চলে এলাম। ছোট ছোট কালো বিন্দুর রহস্য বোঝা গেল। সবুজ ঘাসে দলে দলে উইল্ডিবিস্ট, সঙ্গে জ়েব্রা আর গ্যাজেল হরিণ, অন্য দিকে কেপ বাফেলোর দল। ক্রেটারের মধ্য দিয়ে গাড়ি চলতে লাগল। দেখতে পেলাম জলার ধারে স্পটেড হায়না, সোনালি লোমওয়ালা শেয়াল, ক্রাউন ক্রেন, সেক্রেটারি বার্ড, মেছো ঈগল আরও কত কী! লম্বা লাইন করে দলে দলে উইল্ডিবিস্ট চলেছে, সঙ্গে জ়েব্রার দল। গাইড গাড়ি নিয়ে ওদের যাওয়ার পথের সামনে দাঁড়ালেন, দ্রুতগতিতে কয়েকটা জ়েব্রা আমাদের সামনে রাস্তা পার হতে থাকল। চালক বললেন “রিয়্যাল জ়েব্রা ক্রসিং”! উপর থেকে কালো সুতোর এঁকেবেঁকে চলার মানে বোঝা গেল। ওরা জলাশয়ের খোঁজে চলেছে আর এক দিকে সিংহ আর চিতার হাত থেকে বাঁচতে দল বেঁধে চলেছে। উইল্ডিবিস্টের তীব্র ঘ্রাণশক্তি আর জ়েব্রার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির জন্য ওরা একে অপরকে ভরসা করে চলে।
এখানেও আফ্রিকার বিগ ফাইভ অর্থাৎ সিংহ, চিতা, কেপ বাফেলো, গন্ডার ও হাতির দেখা পাওয়া যায়। তানজানিয়ার সিংহভাগ সিংহই এই ক্রেটারে আছে, কিন্তু তাদের দেখা মিলল না। এ বার চললাম গন্ডারের আবাসের কাছাকাছি। এরা বিরল প্রজাতির। গন্ডার নাকি এক সঙ্গে চার মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারে না, তাই ওরা ঘাসের আড়ালে বসে থাকে। এখানেও একজন বসে আছে, কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু কানজোড়া আস্তে আস্তে নড়ছে। গাইডের অভ্যস্ত চোখে ধরা পড়েছে কিন্তু আমরা অনেক চেষ্টার পর ঠাহর করতে পারলাম। আমাদের গাড়ি একটু এগোতেই গন্ডার মহাশয় উঠে দাঁড়ালেন। অভিজ্ঞ ড্রাইভার তীর বেগে গাড়ি ঘুরিয়ে নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়ালেন।
আর-একটু এগিয়ে দূরে দেখা যায় লেক মাগাডি, নোনাজলের লেক। এখানে গ্রেটার আর লেসার দু’রকমেরই ফ্লেমিঙ্গো দেখা গেল। হিপো পুলের হিরো হিপোরা স্নানে ব্যস্ত, কেউ আবার জল ছেড়ে ডাঙায়।
বেলা পড়ে আসছে, এমন সময় এক দাঁতালের সঙ্গে দেখা। কাছাকাছি কোথাও দলবল আছে, ইনি একটু দলছাড়া হয়ে একমনে গাছের পাতা খেতে ব্যস্ত। আমাদের সফরও শেষ। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে পা বাড়ালাম ফেরার পথে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy