মাস কয়েক হল শহরের মধ্যেই অফিসের কাছাকাছি আলাদা বাড়ি নিয়েছে ঝিমলি। মজা করে বলে, ‘আমার এখন দুটো বাড়ি, এ বাড়ি আর ও বাড়ি।’ মাঝেমাঝেই অফিসফেরত ও বাড়িতে, অর্থাৎ মায়ের কাছে চলে যায় সে। সে দিনও সন্ধেবেলা ও বাড়িতে পৌঁছে দেখে মা রান্নাঘরে, কিন্তু বসার ঘরে খুব জোরে টিভি চলছে। অবাক ঝিমলির প্রশ্নের উত্তরে মা বলেন, “তোরা বুঝবি না, টিভিটা চললে তাও মনে হয় কেউ আছে বাড়িতে। কথা বলছে।”
পরিসংখ্যান বলে, জীবনের সায়াহ্নে এসে বয়স্ক মানুষদের অন্যতম অবলম্বন হয়ে ওঠে টেলিভিশন ও বর্তমানে মোবাইল ফোন। বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে জীবনবোধ পাল্টায়, অভিজ্ঞতা বাড়ে আর পাল্লা দিয়ে বাড়ে একাকিত্ব। আজ যাঁদের বয়স ৫০ পেরিয়ে গিয়েছে, তাঁরা চোখের সামনে একটু একটু করে সমাজকে পাল্টে যেতে দেখেছেন। সঙ্গে অনুভব করেছেন মানুষের মূল্যবোধ, মানসিকতা ও বিশ্বাসের পরিবর্তন। ফলে, জীবনের সায়াহ্নে এসে নিঃসঙ্গ লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। আর এই একাকিত্ব থেকেই ধীরলয়ে আসতে থাকে মানসিক অবসাদ।
বয়স যত বাড়তে থাকে, বয়সজনিত দুর্বলতা ও অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পায়। এই অনিশ্চয়তার ফলেই প্রিয়জন, বিশেষ করে ছেলেমেয়েকে আঁকড়ে ধরতে চায় মানুষ। এর সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা, বন্ধুত্বের অভাবও রয়েছে। বিশেষ করে, দ্রুতগামী এই সমাজে হঠাৎ করে নিজের বিশ্বাস ও আদর্শকে ‘পুরনো’ হয়ে যেতে দেখা অনেকক্ষেত্রেই বেশ ধাক্কা দেয় মানুষকে।
বলা যায়, বিশ্বায়ন, সমাজের পরিবর্তন, আর্থ-সামাজিক ও পারিবারিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে বৃহৎ সমাজ থেকে আলাদা হয়ে পড়ছেন প্রবীণদের একাংশ। শুধু ছেলেমেয়ে দূরে থাকে বলেই যে অবসাদ ও একাকিত্বের সৃষ্টি হয়, তা নয়। বয়সজনিত অবসাদের কারণ একাধিক, সঙ্গীর মৃত্যুশোক, সাংসারিক অশান্তি, শারীরিক অসুস্থতা ও সমাজ ও পরিবারে নিজের গুরুত্ব কমে যাওয়ার অনিশ্চয়তা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে জার্নাল অফ এজিং অ্যান্ড হেলথে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সামাজিক ভাবে একা হয়ে পড়া ও পাল্টে যাওয়া পরিবেশের সঙ্গে মানাতে না পারলে ধীরে-ধীরে বাড়তে থাকে নিঃসঙ্গতা, তার ফলে কগনিটিভ ফাংশন কমতে থাকে। সুতরাং, বয়স হলে শরীরের সুস্থতার দিকে যেমন নজর দিতে হবে, সেরকমই একাকিত্ব যাতে গ্রাস না করে সে দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
কী ভাবে মুক্তি পাবেন একাকিত্ব থেকে?
প্রথমেই বলি, ‘আমার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে!’ এই ভাবনাটা মন থেকে সরিয়ে ফেলুন। যে অভিজ্ঞতার ভার আপনাকে ভারাক্রান্ত করে ফেলছে বলে মনে করছেন, আদতে সেই অভিজ্ঞতার ধারই আপনাকে সাহায্য করবে পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। ‘আমি ফুরিয়ে গিয়েছি’ মনোভাব নিয়ে থাকা এক্কেবারে কোনও কাজের কথা না। বরং ভাবুন, ছেলে-মেয়ে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, থিতু হয়েছে জীবনে... এ বার নিজের জীবনকে উপভোগ করা শুরু করুন।
বন্ধুত্ব করুন
কথায় বলে বন্ধুত্ব জীবনের সম্পদ। আর পরিণত বয়সের বন্ধুত্বকে তাই সহজেই বলা যায় সোনায় সোহাগা। যদি আপনি পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়ে থাকেন অথবা ষাটের কোঠায় পা রেখেছেন সদ্য, তা হলে সমাজের সঙ্গে আপনাকে বেঁধে রাখতে পারে বন্ধুত্বই। বন্ধুদের নির্ভেজাল সাহচর্য আপনাকে করে তুলবে সহজ, সতেজ ও হাসিখুশি। আপনার আয়ুতে বেশ কয়েকটা বছরও যোগ করে দিতে পারে আপনার বন্ধুরা।
বন্ধু মানে নিছকই হাসি-মজা নয়, তাঁরা হয়ে উঠতে পারে পরিবারও। সহজ-সরল বন্ধুত্ব মানে মনের কথার আদানপ্রদান। শারীরিক অসুস্থতা থেকে মনখারাপ সব জানানোর একটা জায়গা। বয়স হলে অবলম্বন হারানোর যে অনিশ্চয়তা শুরু হয়, তা কমাতে বন্ধুত্বের জুড়ি নেই। এমন নয় যে পুরনো বন্ধুদেরই খুঁজে বার করতে হবে বা সমবয়সিদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করতে হবে। বন্ধু হতে পারে আপনার চেয়ে বছর দশেকের ছোট, আবার আপনার চেয়েও প্রাজ্ঞ কারও সঙ্গে জমে উঠতে পারে রোজকার আড্ডা।
নিজের একাকিত্ব দূর করতে ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ করতেই হবে। সপ্তাহে একদিন পছন্দের রেস্তরাঁয় বা কারও বাড়িতে দেখা করুন সকলে। আড্ডায় কেটে যাক দিন।
নিজের শখে মন দিন
বন্ধুত্ব তো হল, কিন্তু মানুষের তো নিজের দিকেও মন দেওয়ার প্রয়োজন হয়। তার জন্য বেছে নিতে পারেন নিজের ভুলতে বসা শখগুলো। শেষ কবে রং-তুলি ধরেছেন মনে পড়ে? বসে পড়ুন, মনের মতো ছবি আঁকুন। দেখবেন, আপনার বন্ধুরাই হয়ে উঠবে আপনার সবচেয়ে বড় সমর্থক ও সমালোচক। একই কথা আপনার গান বা লেখার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে, অর্থাৎ জীবনের এক পর্যায় থেকে আর এক পর্যায়ে পা রেখেছেন। জীবনকে উপভোগ করুন ঠিক সে ভাবেই।
মডেল: মোনালিসা শতপথী, সুস্মেলি দত্ত
ছবি: জয়দীপ মণ্ডল
মেকআপ: চয়ন রায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy