সাধারণত ‘স্পন্ডিলাইটিস’ আর ‘স্পন্ডিলোসিস’ শব্দ দুটো একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকেন অনেকে, দুটোর মধ্যে পার্থক্য না বুঝেই। একই সমস্যার ভিন্ন অবস্থার নাম হলেও স্পন্ডিলাইটিস আর স্পন্ডিলোসিসের মধ্যে তফাত রয়েছে। তবে দু’টি ক্ষেত্রেই সমস্যার মূল উৎস ও তার সমাধানের উপায়গুলি এক ধরনের।
লড়াই যখন গ্র্যাভিটির সঙ্গে
দু’পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি বলেই মেরুদণ্ড নিয়ে আমাদের সমস্যার সূত্রপাত। চারপেয়েদের এ সমস্যা নেই, কারণ তাদের শিরদাঁড়া মাটির সঙ্গে সমান্তরাল। গ্র্যাভিটির বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়েই মেরুদণ্ড, ঘাড়, কোমর, ব্যাক মাসলের সমস্যা শুরু। হিপ জয়েন্ট বা নি জয়েন্টের মতো শুধু দুটো হাড়ের সন্ধিস্থল নয়, বরং মেরুদণ্ডে একাধিক অস্থিসন্ধি থাকে। বয়সজনিত কারণ, ওজন বৃদ্ধি, বসার ধরন বা কাজ করার ধরনে সমস্যা বা অন্য কোনও মেকানিক্যাল কারণে যদি তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং তা যদি রেডিয়োলজিক্যালি নির্ণয় করা যায়, তা হলে সেই সমস্যাকে স্পন্ডিলোসিস বলা হয়। হাড় বা হাড়ের সংযোগস্থলে ওয়্যার অ্যান্ড টিয়ার সংক্রান্ত ডিজেনারেশন বা ক্ষয়ই হল এর অন্যতম কারণ। আর এ ক্ষেত্রে যদি তার সঙ্গে যুক্ত হয় ইনফ্ল্যামেশন, তখনই তা স্পন্ডিলাইটিস। কোনও ব্যক্তির স্পন্ডিলোসিস থাকলে স্পন্ডিলাইটিসের লক্ষণ দেখা যেতেই পারে। যেহেতু সমস্যা দু’টিই পরিচিত এবং একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত, তাই অনেকে দু’টি টার্ম গুলিয়ে ফেলেন। এমনও হতে পারে, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান বা এমআরআই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে স্পন্ডিলোসিস রয়েছে, অথচ রোগীর কোনও উপসর্গ নেই, তখন কিন্তু সেটাকে স্পন্ডিলাইটিস বলা যাবে না। ইনফ্ল্যামেশন হলে তবেই তা স্পন্ডিলাইটিস। অর্থোপেডিক ডা. সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘স্পন্ডিলাইটিস মূলত অটো-ইমিউন কন্ডিশন। অনেকটা আর্থ্রাইটিসের মতো। আর ওয়্যার অ্যান্ড টিয়ার রিলেটেড হলে তবে সেটাকে আমরা বলি স্পন্ডিলোসিস। স্পন্ডিলাইটিসের উপসর্গ থেকে ধীরে ধীরে স্পন্ডিলোসিস ডেভেলপ করতে পারে। অর্থাৎ তখন তা ক্ষয় ও নষ্ট হওয়ার দিকে এগোবে।’’
ঘাড় ও কোমরে চাপ
স্পন্ডিলাইটিস অর্থাৎ ইনফ্ল্যামেশনের উপসর্গ সাধারণত ঘাড়, কাঁধ কিংবা কোমরের অস্থিসন্ধি সংলগ্ন জায়গায় বেশি করে দেখা যায়। যেহেতু মাটি থেকে ঘাড়ের দূরত্ব বেশি কোমরের তুলনায়, তাই ঘাড়ে চাপও পড়ে বেশি। একজন ২০-৩০ বছরের আইটি কর্মী এবং প্রায় ৫০-৬০ বছর বয়সি ব্যক্তির ঘাড়ের গঠনে বিশেষ তফাত পাওয়া যায় না, কারণ দীর্ঘ সময় ধরে মাথা ও ঘাড়ের উপরে প্রবল চাপ ফেলে কাজ করেন তাঁরা। কৃষিকাজ বা খেতের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা বেশির ভাগ সময়ে কোমর নিচু করে ঝুঁকে কাজ করেন। অন্য দিকে, যাঁদের কাজের সূত্রে ওজন তুলতে হয় বা মাথায়-ঘাড়ে ভারী জিনিস বইতে হয়, তাঁদেরও ঘাড়ের উপরে চাপ বেশি পড়ে। দেহে চর্বি বেশি কিংবা ভুঁড়ি থাকলেও চাপ পড়ে শিরদাঁড়ায়।
ব্যথার নানা ধরন
অ্যাঙ্কেলোজ়িং স্পন্ডিলাইটিস, সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস, রিঅ্যাক্টিভ আর্থ্রাইটিস-সহ বিভিন্ন ধরনের স্পন্ডিলাইটিস হতে পারে। ইনফ্ল্যামেটারি বাওয়েল ডিজ়িজ়ের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকতে পারে স্পন্ডিলাইটিসের সমস্যা। কোনও ক্ষেত্রে ঘাড়, কোমর, পিঠের পেশি সব একসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনও ক্ষেত্রে আবার শরীরের নিম্নভাগ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময়েই সমস্যার শুরু হয় শরীরের উপর দিক থেকে, অর্থাৎ ঘাড় ও কাঁধে যন্ত্রণা দিয়ে, যা পরে কোমর ও হাঁটু পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আবার লো ব্যাক পেন, মর্নিং স্টিফনেসের সমস্যাও রয়েছে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, গাউটি আর্থ্রাইটিস, ইউরিক অ্যাসিডজনিত সমস্যা— যে কোনও ধরনের ইনফ্ল্যামেশন বা স্পন্ডিলাইটিসই হোক, নেপথ্যের কারণগুলি হল, বয়স, ওজন, কাজের ধরন, বসার পশ্চার এবং বংশগত ধারা। যাঁরা একটানা ডেস্ক জব করেন, তাঁদের আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঘাড়। তার সঙ্গে পরিবারে স্পন্ডিলাইটিসের হিস্ট্রি থাকলে ঘাড়-কোমর সবই অ্যাফেক্টেড হওয়ার সম্ভাবনা।
অতঃ কিম
পেন রিলিফ বাম বা জেল লাগিয়ে ব্যথা থেকে সাময়িক আরাম পাওয়া গেলেও সমস্যার মূলে মলম লাগানো জরুরি। যে কাজই করুন, সেই কাজে বসার ভঙ্গি বা পশ্চার ঠিক রাখতেই হবে। সেই সঙ্গে উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত এক্সারসাইজ়, বিশেষ করে স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ়ের বিকল্প নেই। ডা. সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিলেন মিলেনিয়ালদের চেনা সমস্যার কথা, ‘‘মোবাইল, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ-নির্ভর দুনিয়ায় ফিজ়িক্যাল অ্যাক্টিভিটি কমে গিয়েছে। মাথা-ঘাড় ঝুঁকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সমস্যা ডেকে আনছে বয়সে ছোটরাও। কোন উচ্চতার টেবল-চেয়ারে বসা হচ্ছে, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।’’
শৌখিন ছোট টেবল বা হাফ চেয়ার দেখতে ভাল হলেও কাজ করার জন্য উপযুক্ত নয়। চেয়ার হওয়া দরকার উচ্চতা অনুযায়ী অ্যাডজাস্টেবল এবং কনটুরড ব্যাকরেস্ট সমেত, যাতে তা মেরুদণ্ড ও ব্যাক মাসলকে সাপোর্ট দিতে পারে। এগজ়িকিউটিভ চেয়ারগুলির ব্যাকরেস্ট সাধারণত এমন ভাবেই তৈরি হয়, যাতে স্পাইনাল কলামের বাঁকের সঙ্গে ব্যাকরেস্টটি অ্যাডজাস্টেড থাকে। চেয়ার উঁচু হলেও পা যাতে ঝুলিয়ে না রাখতে হয়, সে দিকে নজর রাখা দরকার। মেশিনের স্ক্রিন যেন আই-লেভেলে থাকে। একটানা কাজ না করে মাঝেমাঝে বসার ভঙ্গি পাল্টানো, হেলান দিয়ে বিশ্রাম কিংবা উঠে গিয়ে একটু স্ট্রেচিং করে নেওয়া জরুরি। পেশিগুলি রিল্যাক্সড হবে এতে। ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রেও সিট ও ব্যাকরেস্ট হওয়া চাই কমফর্টেবল।
স্পন্ডিলাইটিস বা স্পন্ডিলোসিস— চেনা অসুখকে যে নামেই ডাকুন না কেন, তাদের তফাত এবং প্রতিকারের রাস্তাও চিনে রাখা জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy