ছবি: পিটিআই।
মঞ্চ প্রতিবাদের। সেখানে মাঝেমধ্যেই গমগমিয়ে বেজে উঠছে গান। সমস্বরে নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ বা সলিল চৌধুরীর ‘পথে এ বার নামো সাথী, পথে হবে এ পথ চেনা’। গিটার বাজিয়ে পিট সিগারের ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ও ধরছেন কেউ কেউ। আবার এদের পাশেই এক ভাবে এক ‘স্পিরিটে’ বাজছে অরিজিৎ সিংহের ‘আর কবে’!
৪০ দিন পার করল আরজি কর নিয়ে আন্দোলন। এই ৪০ দিনে অরিজিৎ ছাড়াও, আন্দোলনের সমর্থনে গান বেঁধেছেন, গেয়েছেন বহু শিল্পী। রূপম ইসলাম গেয়েছেন ‘ক্ষত’, কল্যাণ সেন বরাট কথা ও সুর দিয়ে তৈরি হয়েছে ‘যন্ত্রণা’, দেবজ্যোতি মিশ্র সুর করেছেন ‘পাখিদের গান’-এ, ঊষা উত্থুপ গেয়েছেন ‘জাগো রে’, তালিকা অগুনতি। অনেক গান মুক্তি পেয়েছে, ইউটিউব-ফেসবুকে। অনেক গান সরাসরি গাওয়া হয়েছে প্রতিবাদের মঞ্চে। বহু গান এখনও তৈরি হচ্ছে। সব গানেই শোনা যাচ্ছে, প্রতিবাদের কথা, সুবিচারের দাবি। কিন্তু কেন হঠাৎ এত গান লেখা হল? ওই সব গান লেখা না হলেই বা কী ক্ষতি হত?
ইতিহাস বলছে প্রতিবাদ বা আন্দোলনের সঙ্গে গান যখনই জুড়েছে, তখনই জোর পেয়েছে আন্দোলন। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, আরজি কর নিয়ে আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল হওয়ার আগে বিপ্লবের ঢেউ উঠেছিল ওপার বাংলায়। প্রায় দেড় মাস ধরে চলছিল বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন। সেই আন্দোলনও জুড়ে ছিল একটি গান। সেই গানের ভিডিয়োর একটি দৃশ্য নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। ড্রোন শটে সবুজে ঢাকা শাহবাগের মাঝে কালো মাথার সারি। তারা গাইছে— ‘‘ওমা তোমার চরণ দু’টি বক্ষে আমার ধরি/ আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি/ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি...।’’
একটু পিছিয়ে ভারতের কৃষক আন্দোলনের সময়ে ফিরে যাওয়া যাক। ২০২১ সাল। কেন্দ্রের কৃষি বিলের বিরোধিতা করে পঞ্জাব থেকে দিল্লি পায়ে হেঁটে এসেছেন কৃষকেরা। অবস্থান করছেন দিল্লির সীমান্তে। রোজই চলছে বিক্ষোভ। দাবি কৃষি আইন প্রত্যাহারের। কিন্তু কেন্দ্র তাদের দিল্লি ঢোকার পথই বন্ধ করে দিয়েছে। কনকনে শীতে মাসের পর মাস দিল্লি সীমান্তে অবস্থানরত কৃষকেরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। সেই সময়ে কৃষকদের জন্য গান বাঁধতে শুরু করেন পঞ্জাবের লোকশিল্পীরা। সেই সব গান কুয়াশা ঘেরা দিল্লি সীমান্তে বাঁশ ত্রিপলের অবস্থানস্থলে মাঝেমধ্যেই গমগম করে উঠত চাষিদের গলায়। অনমনীয় মনোভাব নিয়ে মাটি কাম়়ড়ে পড়ে থাকতেন তাঁরা।
কিন্তু কেন আন্দোলন-প্রতিবাদে গান থাকে এতটা জায়গা জুড়ে? কল্যাণ সেন বরাট মনে করেন, গান বরাবরই প্রতিবাদের দারুণ মাধ্যম। তাঁর মতে, ‘‘একটা গানের লাইন পাঁচখানা বক্তৃতার সমান। কারণ গানের লাইন অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী।’’ ক্যালকাটা কয়্যারের প্রতিষ্ঠাতা কল্যাণ। তাঁর দল বহু গণসঙ্গীত গেয়েছে। তিনি নিজে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন আইপিটিএ-র প্রাণপুরুষ সলিলের সঙ্গে। সেই সময়ের কথা মনে করেই কল্যাণ বলছেন, ‘‘আন্দোলনের ভিতরে থেকে লেখা গানের প্রাণশক্তিটাই অন্য রকম। সলিলদা যেমম তেভাগা আন্দোলনের সময়ে চাষিদের কথা লিখেছিলেন গান। সে গান একেবারে মাঠঘাটে গিয়ে মিশে গিয়েছিল।’’ তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা সেই গানের কথা ছিল, ‘হেই সামালো ধান হো/কাস্তেটা দাও শাণ হো/জান কবুল আর মান কবুল/আর দেব না আর দেবনা/ রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।’ গরীব বর্গাচাষিদের সঙ্গে জোতদার আর জমির মালিকদের বিরোধ থেকেই দানা বেঁধেছিল তেভাগা আন্দোলন। নিজেদের বোনা ধানের তিন ভাগের দু’ভাগ পাওয়ার অধিকারের দাবিতে বিদ্রোহ করেছিলেন বাংলার কৃষকেরা। তার থেকেই আন্দোলনের নাম তেভাগা। সলিলের গান তেভাগা আন্দোলনের সুর বেঁধে দিয়েছিল। সেই আন্দোলনও সফল হয়।
গান যে প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে, সেই পথ অবশ্য দেখিয়ে গিয়েছেন বাঙালির রবি ঠাকুরই। ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘শাসনে যতই ঘেরো, আছে বল দুর্বলেরও, হও না যতই বড় আছেন ভগবান। বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান, তুমি কি এমন শক্তিমান!’’ সেটা ১৯০৫ সাল। তার পরে বহু এমন গান লিখেছেন বিশ্বকবি। তার পরে একে একে এসেছেন নজরুল, সলিলেরা। সলিলের সঙ্গে দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করেছেন সঙ্গীতকার দেবজ্যোতি মিশ্র। তিনি বলছেন, ‘‘বিদ্রোহের গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাসেরা। এখনও তা-ই হচ্ছে। আন্দোলনের আবহে এই ক’দিনে অসম্ভব শক্তিশালী কিছু গান তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে অরিজিতের গানটা দারুণ লেগেছে আমার। একেবারে সলিল ঘরানার গান।’’ বিদ্রাহ বা প্রতিবাদের গানের সত্যিই নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেছিলেন সলিল। রক্তে তুফান তোলা বহু গান তিনি লিখেছিলেন আইপিটিএ-র হয়ে। সলিলের লেখা এবং সুর করা গান সেই সব গান যেমন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় গাওয়া হয়েছে, তেমনই স্বাধীনতা পরবর্তী অস্থির সময়ে এবং বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সময়েও গাওয়া হয়েছে। এক-একটা অন্ধকার সময় বছরের পর বছর স্থায়ী হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলো দেখেছে আন্দোলন। আন্দোলনের সুফল পেয়েছেন সাধারণ মানুষ। কল্যাণের মতে, দীর্ঘদিন ধরে চলা একটা আন্দোলনকে জ্বালানিও তো জোগাতে হয়। একঘেঁয়ে স্লোগান, বক্তৃতায় সাধারণ আন্দোলনকারীদের উৎসাহ কত দিন টানতে পারে? আন্দোলনের গানের জন্মবৃত্তান্তের সেই খুঁটিতেই বাঁধা। গান সব সময়েই মানুষের মনোরঞ্জন করতে পারে। প্রতিবাদের গানও তাই তার থেকে ভিন্ন নয়। শুধু তার উদ্দেশ্যটা আরও বেশি একমুখী। এই গান মনোরঞ্জন করে প্রতিবাদী মনের। তাঁদের মন টিকিয়ে রাখে আন্দোলনে। আন্দোলনের শিকড়ে জল জোগায়। যাতে আন্দোলন নুইয়ে না পড়ে। কোনও ক্লান্তি না আসে। যেন আন্দোলন সফল হয়।
সেই ভাবনা থেকেই কোল্ড ওয়ার বা ভিয়েতনামের যুদ্ধ বা কসময়ে আমেরিকার শিল্পী পিট সিগার, জন বায়েজ়, জন লেননেরা গেয়েছিলেন প্রতিবাদের গান। পিট আর বায়েজ়ের ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। লেনন গেয়েছিলেন ‘গিভ পিস আ চান্স’, ‘ইমাজিন’। সেটা সত্তরের দশক। লেনন যখন ওই গান গাইছেন, তখন এ পার বাংলায় চলছে নকশাল আন্দোলন। ও পার বাংলায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। তত দিনে আইপিটিএ ভেঙে ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার গঠন করেছেন সত্যজিৎ রায়, রুমা গুহঠাকুরতা এবং সলিল। একের পর এক গণসঙ্গীত তৈরি করছেন তাঁরা— ‘পিট সিগারের গাওয়া ‘উই শ্যাল ওভারকাম’-এর অনুকরণে ‘এক দিন সূর্যের ভোর’ গেয়েছিলেন তাঁরা। আবার বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে গান গেয়েছিলেন বায়েজ়— ‘‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ, হোয়েন দ্য সান সিঙ্কস ইন দ্য ওয়েস্ট, ডাই এ মিলিয়ন পিপল ইন বাংলাদেশ।’’ সেই মুক্তিযুদ্ধ শেষে নতুন করে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। আর এ পার বাংলায় এসেছিল কমিউনিস্ট সরকার।
কথায় আছে, সুর বেঁধে রাখে। সে জন্যই সুরের গুরুত্ব। বিভিন্ন আন্দোলনের ক্ষেত্রেও বার বার গানের সুর-ছন্দ-তাল হয়েছে অনেককে নিয়ে চলার মতো। আরজি কর আন্দোলন নিয়ে যে সব গান বাঁধা হয়েছে, তার কথা-সুর শুনলে চট করে গণসঙ্গীত বলে মনে হবে না। তবু প্রত্যেকটা গানে এমন একটা কিছু রয়েছে, যা অনেককে বেঁধে রেখেছে। হয়তো সে কারণেই ইতিহাসের বহু আন্দোলনের কথাও মনে করিয়েছে সে সব গান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy