“শক্তিদা, আপনি তা হলে কী খাবেন?”
শক্তি চট্টোপাধ্যায় বুড়ো আঙুলটা তুলে বললেন, “এটা কী জানো?”
“কী শক্তিদা?” বললেন বাবা।
“থামস আপ... কোল্ড ড্রিঙ্ক।”
“তখনও বইপাড়ায় নববর্ষে কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়ানোর চল শুরু হয়নি। আমাদের তখন ডাব খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল। অনেকেই জানেন, গভীর রাতে যখন বইপাড়া ঘুমিয়ে থাকে তখন সেটা বদলে হয়ে যায় ডাবপাড়া। ভোরবেলা ডাবপাড়া আবার বদলে বইপাড়া হয়ে যায়। কলকাতা শহর ও শহরতলিতে যত ডাব যায়, তা এই কলেজ স্ট্রিট মার্কেট থেকেই। লেখক-পাঠক মিলিয়ে প্রায় হাজার দেড়েক ডাব আসত তখন। ডাব যিনি কাটতে আসতেন, তিনি হাঁপিয়ে যেতেন। বাবা একজনকে দিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্য কোল্ড ড্রিঙ্ক আনালেন। তিনি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ফের আড্ডায় মেতে উঠলেন। এ গল্প আমার বাবার কাছেই শোনা।”
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন ‘দে’জ পাবলিশিং’-এর অন্যতম কর্ণধার অপু (শুভঙ্কর) দে।
তাঁর কথায়, “একটা সময় বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল কলেজ স্কোয়্যারের চড়কের মেলা। ছোটবেলায় দেখা সে মেলার জৌলুস হারিয়েছে। সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছে বইপাড়ার নববর্ষের চিত্র।”
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইপাড়া, বইপাড়ার ভূগোল, বইপাড়ার চরিত্র যেমন বদলেছে, তেমনই বদলেছে বইপাড়ার নববর্ষ। বইপাড়ার হালখাতা।
আজ আমরা কলেজ স্ট্রিটের যে অঞ্চলকে ‘বইপাড়া’ নামে চিনি, প্রথমে মূল বইপাড়া কিন্তু সেটা ছিল না।
প্রকাশকদের অধিকাংশের ঠিকানা ছিল বিধান সরণি। খাস কলেজ স্ট্রিটে প্রথম বইয়ের দোকান গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী’। এই প্রকাশনা মূলত ডাক্তারি বই বেচত। এর পরেই শরৎকুমার লাহিড়ী ‘এসকে লাহিড়ী অ্যান্ড কোম্পানি’ বইয়ের দোকান খুললেন। সেখানে বিক্রি হত বিভিন্ন বইপত্র।
এক সময় নববর্ষের ভোরে প্রকাশকদের ভিড় লেগে থাকত ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি বা ফিরিঙ্গি কালীবাড়িকে ঘিরে। তার পর দোকানে ফিরে গণেশপুজো এবং ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে খোলা হত খাতা। এখন আর সে দিন নেই। এখন পুরুতমশাই ঘরে এসে পুজোপাঠ সাঙ্গ করার পরেই শুরু হয় লেনদেন।
বই তৈরির সঙ্গে সংযুক্ত বিভাগগুলি, অর্থাৎ ছাপাখানা বা বাঁধাইঘরে ধারবাকির কারবার থাকলেও খুচরো বই বিক্রিতে তেমন ধারবাকি হয় না। সে ক্ষেত্রে আর পাঁচটা অন্য ব্যবসার মতো বইপাড়ার জাবদা খাতার হিসাব একবারেই ভিন্ন। তবে বইপাড়ার অন্যতম বৃহৎ বইবিক্রেতা ‘দে বুক স্টোর’-এর কর্ণধার বর্ষীয়ান পরেশচন্দ্র দে জানালেন, “এক সময় আমাদের ঘরে অনেক পাঠকের ধারবাকির খাতা থাকত। যাঁরা প্রতি মাসে বই কিনতেন তাঁদের নামে খাতা থাকত। কিন্তু সে সব এখন আর নেই।”
বইপাড়ায় পয়লা বৈশাখের ছবি খুব বেশি না বদলালেও বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মূলত বদল হয়েছে দু’টি ক্ষেত্রে।

বইপাড়ায় নববর্ষে মূল আকর্ষণ ছিল লেখক-পাঠকের একযোগে উপস্থিতি। ছবি সৌজন্যে: দে’জ পাবলিশিং।
প্রথমত, বছর ৩০-৩৫ আগেও যখন বইমেলার ব্যাপ্তি বা প্রসার এতটা ছিল না, তখন অধিকাংশ বই প্রকাশ হত বৈশাখের প্রথম দিনটিতেই। এবং কেবল বইপ্রকাশ নয়, সবচেয়ে মজার ব্যাপার, বৃহৎ প্রকাশনা সংস্থাগুলিতে লেখকদের সঙ্গে বইয়ের ‘বায়না’ হত এই দিনেই। অপু দে-র কথায়, “তখন তো আর মোবাইলের যুগ নয়। চাইলেই হুট করে লেখকের দেখা যখন-তখন মিলত না। সবার বাড়িতে ফোনও ছিল না। ফলত এই বিশেষ দিন উপলক্ষে আসা অনেক লেখকের সঙ্গে চুক্তি হত আগামী বইয়ের। সেইমতো পরিকল্পনা করা হত সারা বছরের জন্য। বইমেলা জমজমাট হওয়ার পর বই প্রকাশের বেশির ভাগটাই এখন বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে। কারণ, সেখানে অনেক দিন ধরে অনেকের কাছে একসঙ্গে ডিসপ্লে করার সুযোগ মেলে।” ‘প্রতিক্ষণ’-এর কর্ণধার শুদ্ধব্রত দেবের কথায়ও একই সুর। তাঁদের প্রকাশনা সংস্থাতেও পয়লা বৈশাখের থেকে বইমেলাতেই বই প্রকাশের সংখ্যা বেশি।
দীর্ঘ দিনের প্রকাশনা সংস্থা ‘ডিএম লাইব্রেরি’র প্রবীণ কর্ণধার আশিসগোপাল মজুমদার বললেন, “আমাদের বাবা-কাকাদের সময় থেকেই দেখে আসছি নববর্ষে বই প্রকাশ করার বিষয়টি। আমরা চেষ্টা করতাম এই দিনে অন্তত চার-পাঁচটি বই প্রকাশ করার। বাংলা বাজারে পয়লা বৈশাখের পাশাপাশি বই প্রকাশ করার রেওয়াজ ছিল মহালয়ার দিনেও। এখন তো সবই দেখি বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এটা আগে ছিল না।”
আরও পড়ুন:
বইপাড়ায় দীর্ঘ দিন বইপ্রকাশের সঙ্গে যুক্ত সৌমেন পালের কথায়, “এখন ডিজিটাল মাধ্যমের (পিওডি বা প্রিন্ট অন ডিম্যান্ড) যুগ। এখন আর বই প্রকাশের জন্য কেউ অপেক্ষা করে না। যখন ইচ্ছে বই প্রকাশ করা যায়। এবং যে ক’টি ইচ্ছে বই প্রকাশ করা যায়। ১০-২০টা বইও প্রকাশ করা যায়। পাঠকও অনলাইনে যখন খুশি বই কিনতে পারেন। ফলত, নতুন বাংলা বছরে বই প্রকাশের যে উন্মাদনা সেটা এখন একেবারেই নেই।” আশিসগোপাল মজুমদারের কথায়, “এমনও বই আছে, পয়লা বৈশাখে যা আমরা ১৫০০-২০০০ কপি ছাপিয়েছি। এবং পয়লা বৈশাখের দিনই প্রায় ১০০০ কপি বই বিক্রি হয়ে গিয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে। সে সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল লাইব্রেরি পারচেজ়। বিভিন্ন লাইব্রেরির লোকেরা আসতেন এবং পয়লা বৈশাখে কী বই বেরোল সেটা রীতিমতো খুঁজতেন। নতুন বই যে কেবল আমরা করতাম, তা নয়। সব প্রকাশকই নববর্ষের দিন কিছু না কিছু বই প্রকাশ করতেন। যেহেতু আমরা বিভিন্ন লাইব্রেরিকে বই সাপ্লাই করতাম, অনেক প্রকাশক নতুন বই আমাদের কাছে রেখে যেতেন বিক্রির জন্য।”
দ্বিতীয় বিষয়টি এই— একদা বইপাড়ায় নববর্ষে মূল আকর্ষণ ছিল লেখক-পাঠকের একযোগে উপস্থিতি। বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলিতে পাঠকরা ধৈর্য ধরে বিকেল থেকে অপেক্ষা করতেন কখন তাঁদের পছন্দের লেখক আসবেন। কখন লেখকের বই কিনে তাতে স্বাক্ষর করিয়ে পাঠক হৃষ্টচিত্তে মিষ্টির বাক্স এবং বই নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। এখনও লেখক-পাঠক একসঙ্গে উপস্থিত হন। কিন্তু অপেক্ষা করার সেই উত্তেজনাটা নেই। কারণ মুঠোফোন। সর্বোপরি, সমাজমাধ্যমের দৌলতে এখন লেখকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন পাঠকেরা। তাঁরা আগেই জেনে যান, কোন লেখক কোথায় কখন থাকছেন। সেইমতো গিয়ে টুক করে বইটি সই করিয়ে সেল্ফি তুলে চলে আসেন।
আশিস গোপালবাবুর থেকে কথায় কথায় আরও একটি আকর্ষণীয় বিষয় জানা গেল, সেটা হল— আগে বহু পাঠকের কাছে অটোগ্রাফ খাতা থাকত। সেখানে লেখকের সই সংগ্রহ করতেন পাঠকেরা। তখন তো আগে থেকে ঘোষণা করার উপায় ছিল না যে, অমুক লেখক অমুক দিন স্টলে উপস্থিত থাকবেন। এখন বইমেলায় একাধিক দিন একজন লেখক উপস্থিত থাকেন। ফলত পাঠকেরা লেখকদের নাগালে পেয়ে যান। নববর্ষে সেই সুযোগও ছিল না। সেটি এক দিনের কারবার। তাই পাঠকেরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতেন কখন তাঁর পছন্দের লেখক আসবেন। যদি একাধিক লেখকের বই কেনার সামর্থ্য না হত তাহলে অটোগ্রাফ খাতায় সই করে নিয়ে যেতেন অনেক পাঠক। এখন আর সে সব নেই।
যত সময় গড়িয়েছে তত বেড়েছে প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা। প্রকাশনা সংস্থা বাড়ার সঙ্গে বহরে বেড়েছে বইপাড়াও। সঙ্গে বেড়েছে নববর্ষে পাঠকের উপস্থিতির হার। শুদ্ধব্রত দেবের কথায়, “প্রকাশনা সংস্থা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবতই বেড়েছে নববর্ষের দিন পাঠকের আনাগোনা। কারণ, প্রত্যেক প্রকাশনা সংস্থার নিজস্ব একটা পাঠক বৃত্ত তো আছেই। তাদের আমন্ত্রণে এই দিন জড়ো হন পাঠকেরা। নিখাদ আড্ডার পাশাপাশি চলে খাওয়াদাওয়া, মিষ্টিমুখ।”
আগের থেকে বাংলা বইয়ের পাঠক যে কমছে, সে বিষয়ে অধিকাংশ প্রকাশক একমত হলেও এ দিনটি যে পাঠকদের কাছেও আলাদা, তাই এ দিনে কেবল কলকাতা বা শহরতলি নয়, বিভিন্ন জেলা থেকেও পাঠকেরা আসার ফলে বইপাড়া যে আলাদা রকমের সরগরম হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে সকলে একমত। তবে নববর্ষে পাঠকের উপস্থিতি নিয়ে ভিন্ন মতই মিলছে। যেমন ‘দে’জ প্রকাশনী’র সুভাষচন্দ্র দে জানাচ্ছেন, “আগে পাঠকদের জন্য ৭০০-৮০০টি প্যাকেট করতাম আমরা। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৫০০।” আবার ‘আদি দে বুক স্টোর’-এর কর্ণধার পরেশচন্দ্র দে কিন্তু বলছেন, “আগে আমরা প্রায় হাজারখানেক প্যাকেট তৈরি করতাম। এখন সেটা কমিয়ে দিয়ে ৭০০-৮০০ মতো করি।” ‘দে বুক স্টোর’-এর দীপু দে’র কথায়, “নববর্ষে পাঠকের আনাগোনার যে খুব বেশি পরিবর্তন যে হয়েছে, বলা যায় না। তবে কেবল নববর্ষের দিন ধরলেই তো হবে না। সামগ্রিক ভাবে বাংলা বইয়ের পাঠকের সংখ্যা কিন্তু কমছে।”
বই ছাপা, বই বিক্রির মাধ্যম যেমন বদলেছে, তেমনই স্বাভাবিক ভাবে বদলেছে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমও। আগে লেখকদের চেকের মাধ্যমে সারা বছরের বই বিক্রি থেকে প্রাপ্য রয়্যালটি দেওয়া হত নববর্ষে। কিন্তু এখন ডিজিটাল পেমেন্টের যুগ। তাই বদলে গিয়েছে রয়্যালটি দেওয়ার প্রক্রিয়াও। এক নবীন প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধারের কথায়, “বছরের শুরুতেই যাতে একসঙ্গে চাপ না পড়ে, তাই আমরা বছরে দু’বার লেখকদের রয়্যালটি দিই। একটা অংশ দিই পুজোর আগে। আর একটা অংশ দিই এই সময়ে।” ‘ঋত প্রকাশনা’র কর্ণধার ঐত্রেয়ী সরকারের কথায়, “অনেক লেখকই বলেন পুজোর আগে তাঁদের প্রাপ্য রয়্যালটি দিলে সুবিধে হয়। সে ক্ষেত্রে লেখকের সুবিধা অনুযায়ী তাঁকে আমরা তাঁর প্রাপ্য অর্থ মিটিয়ে দিই। আবার কোনও প্রকাশনা সংস্থা ১০০ কপি বই বিক্রি হলে সেই টাকা মিটিয়ে দেন।”
নববর্ষে বইপাড়ায় অনেক কিছু বদল হলেও আজও বদলায়নি অমলিন আড্ডা। আড্ডার মেজাজ কিছুটা বদলালেও এই একটা দিন লেখক-পাঠক-প্রকাশকের সেই জমাটি আড্ডা কিন্তু রয়ে গেছে। আড্ডার সঙ্গে হয়তো বদলেছে খাওয়াদাওয়ার রকমফের, ডাবের জলের বদলে নরম পানীয়, মিষ্টির বদলে স্ন্যাক্স। কিন্তু আজও বদলায়নি বইকে ঘিরে স্বপ্ন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তা বয়ে চলেছে। আজও নববর্ষে একঝাঁক তরুণ প্রকাশকের ঘরে জন্ম নেবে নতুন বইয়ের পরিকল্পনা।
আজও একদল পাঠক নতুন বই দু’হাতে তুলে নাকে ঠেকিয়ে গন্ধ নিতে নিতে পরিকল্পনা করবেন কবে তিনি বইটি অর্ডার করে নিজের সংগ্রহে নিয়ে যাবেন। কালের নিয়মেই ক্যালেন্ডারের পাতায় নববর্ষ বদলে যায়। বদলায় না নতুন লেখার স্বপ্ন। নতুন বই তৈরির স্বপ্ন।
- পয়লা বৈশাখ মানেই বাঙালির বাঙালিত্বের উদ্যাপন। সাদা-লাল শাড়ির ফ্যাশন, বাঙালি খাওয়া-দাওয়া, হালখাতা— এই সবই জাগিয়ে তোলে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতাকে।
- বছর ঘুরে আবার আসছে বাংলার নববর্ষ। ১৪৩২ আরও অনেক নতুন কিছু নিয়ে আসবে। নববর্ষকে কী ভাবে স্বাগত জানাবে বাঙালি? তারই হাল হদিস।
-
মননে সাহিত্য-শিল্পের বাঙালিয়ানা, বল্লভপুরের রূপকথা শুনবে ক্যাম্পাস শহর
-
কেউ শাড়ি, কেউ সালোয়ার, সাবেক ও সাম্প্রতিকের যুগলবন্দি নববর্ষে, কেমন সাজলেন টলিসুন্দরীরা
-
কাঁধে এক কাঁদি কলা, চুলে হলুদ-বেগনি ফুল, সমুদ্রতটে আঁচল উড়িয়ে নতুন বছরকে স্বাগত স্বস্তিকার
-
বিশেষ দিনে ভিড় করে স্মৃতিমেদুরতা, বর্তমান প্রজন্মও অতীতে চোখ রাখে, নববর্ষে মনে করালেন সোহম
-
দিনের শেষে মেকআপ তুলে ফেলাও জরুরি, ফেসওয়াশ ফুরিয়ে গেলে কী করবেন?