Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Famous Pice Hotel in Kolkata

কলকাতায় এলেই এখানকার খাবার খান ইমতিয়াজ় আলি! শতবর্ষ পেরিয়ে এখনও ‘তরুণ’ এই পাইস হোটেল

দেব বাড়ির বৃহত্তর পরিবার, দক্ষিণ কলকাতার এই বিখ্যাত পাইস হোটেল তরুণ নিকেতন পা দিল ১০৮ বছরে।

Image of Tarun Niketan

রাসবিহারী মোড়ের কাছে এই পাইস হোটেল খোলা থাকে রোজই। ছবি: সংগৃহীত।

অঙ্কিতা দাশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:৩৪
Share: Save:

ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৭টা বাজতেই বাজারের থলি হাতে বেরিয়ে পড়েন অরুণ দেব। আর পাঁচটা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়িতে যেমনটা হয়, এ ক্ষেত্রেও তাই। রাসবিহারী চত্বরের সব্জি বাজার ঘুরে, রাধুবাবুর দোকান হয়ে লেক মার্কেট। রুই, কাতলা, ট্যাংরা, ভেটকি, বোয়াল, পার্শে, পাবদা থেকে কই, পুঁটি। পেট টিপে, কানকো তুলে, তবেই ওজনের পাল্লাতে চাপিয়ে দেন অরুণ। তার পর চলে পদ অনুযায়ী মাছ কাটার পর্ব। মাছ কাটাতে দিয়ে অরুণবাবু চলে যান সোজা মাংসের দোকানে। সদ্য কাটা মুরগি, খাসি পরখ করে, ওজন দেখে তবেই বাজারের ব্যাগে ভরে নেন। তবে, মুরগির ডিম একেবারে বাদ। বদলে হাঁসের ডিম কিনে নেন গোটা তিরিশ। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা— এ নিয়মের অন্যথা হয় না। প্রতি দিন অরুণদের হেঁশেলে ছ-সাত রকম সব্জি হবেই। তাই মাথায় রাখতে হয় কোন সব্জি কতটা কিনতে হবে। মরসুমি সব্জি চোখের সামনে দেখতে পেলে তা-ও বেশ খানিকটা নিয়ে নেন। তবে এত বাজার একা হাতে বয়ে আনতে পারেন না। সঙ্গে দু-তিন জন লোক থাকে। ওই কয়েক ঘণ্টা চরম ব্যস্ততার মধ্যে কাটে অরুণদের।

Image of Food

কলাপাতায় পাত পেড়ে ভূরিভোজ। ছবি: সংগৃহীত।

রাসবিহারীর মোড় থেকে ফুটপাত ধরে গড়িয়াহাটের দিকে কিছুটা যেতেই ডান হাতে ‘তরুণ নিকেতন’। দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত এই পাইস হোটেল পা দিল ১০৮ বছরে। ‘দেব’দের বৃহত্তর পরিবারও বটে। এক দিকে চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। দেশ ভাগ হওয়া তো অনেক দূর। ব্রিটিশ রাজত্বে অন্য দিকে কলকাতায় একটু একটু করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে মেস কালচার। গ্রাম, মফস্‌সল থেকে কলকাতায় চাকরি করতে আসা ছেলেদের সস্তায় দু’বেলা খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলেন তরুণ দেব। দু’বেলা পেট ভরে খেতে না পাওয়ার কষ্ট কী, তা বুঝতে বেশি দূর পড়াশোনা করতে হয়নি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা তরুণকে। সেই শুরু। একবিংশ শতাব্দীর নামজাদা ফাইন ডাইনিংকেও হার মানায় এখানকার খাবারের স্বাদ। তরুণ নিকেতনের তৃতীয় প্রজন্মের অরুণ দেব বলেন, “মেসবাড়িতে থাকা ছাত্র, সাতসকালে মফস্‌সল থেকে কলকাতায় চাকরি করতে আসা ছেলেপিলের দলের কথা মাথায় রেখেই এই হোটেল শুরু করেছিলেন দাদু। তাঁর মুখেই শোনা, সেই সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে বিখ্যাত মানুষের আনাগোনাও ছিল এখানে।” অরুণ দেবের ছেলে অমরনাথ দেব বলেন, “তখন তো ছবি তোলার চল ছিল না। শুনেছি, বলিউডের ‘বিগ বি’ কলকাতায় চাকরি করতে এসে নাকি এখানে খেয়ে তার পর অফিসে যেতেন। বাংলা ছবি ‘ফাটাফাটি’র শুটিং-ও তো এখানেই হল।” বলিউডের ধারা অবশ্য এখনও চলছে। ‘জব উই মেট’ খ্যাত পরিচালক ইমতিয়াজ় আলির মুখে তরুণ নিকেতনের প্রশংসা অনেকেই শুনেছেন। পরিচালকের টিম ভাল করেই জানে, তিনি যতই নামী হোটেলে থাকুন না কেন, কলকাতা এলে তাঁর খাবার চাই তরুণ নিকেতনেরই। তবে শুধু বলিউড কেন, টলিউডেরও অনেক অভিনেতা মাঝেমাঝেই এখানে ঢুঁ মারেন। কোনও একটা শীতের দুপুরে খেতে গিয়ে হঠাৎ দেখা হয়ে যেতে পারে অভিনেতা শান্তিলাল মুখোপাধ্যায় কিংবা লোকনাথ দে-র সঙ্গে।

Image of Arun Deb.

হিসাব করতে ব্যস্ত তরুণ নিকেতনের তৃতীয় প্রজন্ম অরুণ দেব। ছবি: সংগৃহীত।

একেবারে ছাপোষা বাঙালির ঘরোয়া রান্না খাইয়ে ক্রমে কলকাতা সবচেয়ে পুরনো পাইস হোটেলের দলে নাম লিখিয়ে ফেলে এই তরুণ নিকেতন। ঝাঁ- চকচকে অন্দরসজ্জা নেই। নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের হাওয়া। খসে পড়া পলেস্তারা চাপা দিতে হালের ‘অয়েল পেন্ট’ করা দেওয়াল জুড়ে রয়েছে ১০০ বছরের ইতিহাস। ছোট-বড় নানা সংবাদপত্রের প্রতিবেদন কেটে, বাঁধিয়ে টাঙানো রয়েছে দেওয়ালে। আগে মাটিতে চাটাই পেতে খাওয়াদাওয়ার চল ছিল। তবে এখন শ্বেতপাথরের টেবিল হয়েছে। রয়েছে প্লাস্টিকের চেয়ারও। খাওয়ার ঘর আর ভাঁড়ার ঘরের মাঝে পর্দা টাঙানো। তারই এক পাশে রয়েছে ছোট্ট খামার। গ্রাম থেকে আনা দেশি মোরগ, মুরগি রাখা থাকে এখানে। অমরনাথ বলেন, “কলকাতার বাজারে ভাল মানের দেশি মুরগি পাওয়া যায় না। তাই এই ব্যবস্থা।” হেঁশেল থেকে ক্রমাগত ভেসে আসা খাসির মাংসের সুবাস এবং প্রেশার কুকারে সিটি পড়ার আওয়াজ শুনে দেব বাড়ির চতুর্থ প্রজন্ম অমরনাথ দেব বললেন, “রাতের খাসিটা রান্না হচ্ছে এখন। ঢাকাই চিংড়ি পোলাও আর মাংসের বরাত রয়েছে। আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখলে আমরা লোক দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিই।”

Image of Tarun Niketan

বাঙালি রান্নার পাশাপাশি চাইলে বিরিয়ানিও পাবেন। ছবি: সংগৃহীত।

গড়িয়াহাটের হিন্দুস্তান পার্ক অঞ্চলে এখন দেব পরিবারের বাস। এই বাড়িরও একটি বিশেষত্ব রয়েছে। বাড়িতে হেঁশেল থাকলেও সেখানে রান্নাবান্না করার চল একেবারেই নেই। ক্রেতাদের জন্য যা রান্না করা হয়, তা-ই খেয়ে থাকেন দেব বাড়ির সদস্যেরা। হাসতে হাসতে অমরনাথ বলেন, “আমরাও রোজ এখানকার রান্না খাই। আমাদের বাড়িতে রান্নাঘর আছে। কিন্তু সেখানে কোনও রান্না হয় না। অতিথিকে যা খাওয়াই, নিজেরাও তাই খাই। বাড়ির ছোটরাও তাই। পেটের সমস্যা হওয়ার ভয় নেই। কারণ, আমাদের রান্না বেশির ভাগটাই বাটা মশলায় করা হয়।”

Image of Food

তরুণ নিকেতনে এলে রোজই পাবেন এমন মাছের সমাহার। ছবি: সংগৃহীত।

কয়েক যুগ আগেও হিন্দু বাড়িতে মুরগির প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। হোটেলেও সেই নিয়ম শুরু করেছিলেন তরুণ। কিন্তু খদ্দেরদের কথা মাথায় রেখে তরুণ নিকেতনের হেঁশেলে মুরগির মাংস উঠলেও, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ডিম এখনও ব্রাত্য। চেনা-অচেনা, অফিসযাত্রী, স্কুল-কলেজের ছাত্র মিলিয়ে প্রতি দিন প্রায় জনা পঞ্চাশের পাত পড়ে এখানে। উৎসব-অনুষ্ঠানে তা আবার দ্বিগুণ হয়ে যায়। যাঁরা নিয়মিত আসেন, তাঁরা জানেন, এখানে মুরগির ডিমের কোনও পদই পাওয়া যায় না। যে মরসুমে যা পাওয়া যায়, তা তো থাকেই। যেমন— মটর ডাল মুলো দিয়ে, কচুশাক, কুমড়ো ফুল বা বকফুলের বড়া, নটে শাক, পুঁই শাক, সর্ষে দিয়ে ইলিশ, চিতল পেটি, পাতলা করে খাসির মাংসের ঝোল, দিশি মুরগি থেকে নিমবেগুন, চুনোমাছ কিংবা কাঁটাচচ্চড়ি, বাটামাছের ঝোল— সবই পাওয়া যায়। সারা বছর পাওয়া যায় কাঁচা আমের চাটনি। আর শীতকালে নলেন গুড়ের রসগোল্লা তো আছেই। আগে থেকে বললে পায়েসও পাওয়া যাবে। অনেক বাঙালির কাছে নিরামিষ খাবার মানে আবার পেঁয়াজ-রসুনও ব্রাত্য। তাঁদের কথা ভেবেই মাছ, মাংস বা ডিমের কোনও পদ ছাড়া আর কিছুতেই পেঁয়াজ-রসুন দেওয়া হয় না। প্রতি দিনের মেনু পরিবর্তন হওয়াই পাইস হোটেলের নিয়ম। তবে ডাল, তরকারি, মাছ, মাংসের সাধারণ পদগুলোয় কোনও পরিবর্তন হয় না।

সাদা কাগজে পেন দিয়ে কাটা ছক। সেখানে অরুণবাবু লিখে রাখেন কোন টেবিলে, কী কী খাবার দেওয়া হয়েছে। সেই তালিকা মিলিয়ে বিল তৈরি করে, অনলাইনে টাকা নেওয়ার কাজ করতে করতেই অরুণ দেব বললেন, “থালি খাবার ইচ্ছে মাথায় নিয়ে এখানে এলে কিন্তু পস্তাতে হবে। এই হোটেলে তেমন কোনও নিয়ম নেই। সকাল-বিকাল নিজের হাতে বাজার করি। ভাত, ডাল, তরকারি— যা চাইবেন, তাই পাবেন। কিন্তু ধরাবাঁধা কোনও মেনু নেই। ফ্রিজে স্টোর করে রাখার প্রথা নেই। খাবার যাতে নষ্ট না হয়, সেই কথা মাথায় রেখে অফুরন্ত রান্না করা হয় না। তবে বেলা ৩টের মধ্যে এলে না খেয়ে ফিরতে হবে না। রাতে খোলা থাকে ১০.৩০টা পর্যন্ত।”

অন্য বিষয়গুলি:

Tarun Niketan pice hotel Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE