রেলের ট্র্যাকের উপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেলফি। ছবি: শাটারস্টক।
নিজেকে ভালবাসা ও নিজেকে প্রকাশের কোপে পড়েই ঝরে যাচ্ছে প্রাণ।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের রাগ-বিষাদ-প্রেম-খুনসুটি সবই জানান দেওয়ার মাধ্যম এক টুকরো ছবি। আর এই ছবির দুনিয়ায় সেলফি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সেলফি তুলে তা খুঁটিয়ে দেখা, পছন্দসই না হওয়া অবধি বারংবার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এ বার পছন্দের ছবি ফটো ফিল্টারে এডিট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সে ছবি পোস্ট করা। লাইক-কমেন্টের বন্যায় ভেসে যাওয়ার এই লোভই অনেক সময় ডেকে আনছে মৃত্যু। আর এক-আধটা নয়, মৃত্যুর সংখ্যাটা নাড়িয়ে দেওয়ার মতো।
অন্তত পরিসংখ্যান তা-ই বলছে। ২০১১ অক্টোবর থেকে ২০১৭-র নভেম্বর পর্যন্ত শুধুমাত্র সেলফি নিতে গিয়ে গোটা দুনিয়াতে মৃত্যু হয়ছে ২৫৯ জনের। ভারতের ‘জার্নাল অব ফ্যামিলি মেডিসিন অ্যান্ড প্রাইমারি কেয়ার’-এর সমীক্ষা ও তার ফল অনুযায়ী, ওই নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীতে হাঙরের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে মোটে ৫০ জনের। অর্থাৎ মৃত্যুর অঙ্কে হাঙরের কামড়কে পাঁচ গুণেরও বেশি পিছনে ফেলে দিচ্ছে ‘সেলফাইটিস’ (ঘন ঘন সেলফি তোলার প্রবণতা)। গত ১০ বছরে এই ‘অসুখ’ আরও বেড়েছে বলেই মত মনোবিদদের।
মূলত মহিলাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা গেলেও সমীক্ষায় প্রকাশ, পুরুষদের মধ্যেও এই আসক্তি ক্রমেই বাড়ছে। অনেক সময় মহিলাদের সেলফি তোলায় সাহায্য করতে গিয়েও মৃত্যু হচ্ছে তাঁদের। এর মধ্যে জলে ডুবে মৃত্যু, পথ দুর্ঘটনা, শুটিংয়ের সময় ঘটা দুর্ঘটনার সংখ্যাই বেশি। আজ পর্যন্ত ভারতে সেলফির ফাঁদে পড়ে প্রাণ দিয়েছেন প্রায় ১৫৯ জন। এ দেশের প্রায় ১৩০ কোটির বেশি জনগণের মধ্যে প্রায় ৮০ কোটি মানুষই মোবাইল ব্যবহার করেন ও সেলফিতে কমবেশি অভ্যস্ত। ভারতে রেলের ধাক্কায় মৃত্যুর ক্ষেত্রেও অনেক সময় দায়ী থাকে এই সেলফিপ্রেম।
আরও পড়ুন: একান্তই কিনতে হচ্ছে প্রসেসড ফুড? অসুখ রুখতে কেনার সময় মেনে চলুন এ সব সতর্কতা
গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে সেলফি-তে মন ডেকে আনে বিপদ।
‘সেলফি’ শব্দটি কয়েক বছর আগে ‘অক্সফোর্ড অভিধান’-এর প্রবেশ করেছে। ‘কেমন করে আরও ভাল সেলফি তুলবেন’— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সার্চ ইঞ্জিনগুলোতে গেলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ওয়েবসাইট খুলে যায়। শুধু ‘সেলফি স্টিক’ নয়, নিজস্বী তোলার জন্য বিশেষ জুতোও এসে গিয়েছে বাজারে। সেলফি-ফ্রেন্ডলি হওয়ার উপরেই স্মার্টফোনের বিক্রি বাড়ছে। ইতিমধ্যে ইউরোপে ‘সেলফি স্টিক’ কে ‘নার্সিসাস স্টিক’ বলেও ডাকা হচ্ছে।
শুধু ভারত নয়, সব উন্নয়নশীল দেশ ও পিছিয়ে পড়া দেশরাও সেলফিমুগ্ধতায় ভরপুর। কেবল আমজনতা নন, এই প্রেমে মশগুল সেলিব্রিটিরাও। তাইওয়ানে গত জানুয়ারিতেই ‘বিকিনি ক্লাইম্বার’ সোশ্যাল মিডিয়ার সেলিব্রিটি গিগি উও পব্রতের শিখরে উঠে সেলফি নিতে গিয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে প্রাণ হারান। ক্রোয়েশিয়ার উদ্ধারকারী দল সেলফির বিরুদ্ধে টুইট করতেও বাধ্য হয়। আমেরিকা, রাশিয়ার মতো দেশেও সেলফি তুলতে গিয়ে প্রতি বছরই কারও না কারও মৃত্যু ঘটে। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ভারতেও বিভিন্ন জায়গায় সেলফি তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেলফি তোলার জেরে ঘটে চলা দুর্ঘটনায় রাশ টানতে ও সচেতনতা প্রসারে রাশিয়ার রাস্তাঘাটে সেলফি তোলা নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে দেশের সরকার।
আরও পড়ুন: সন্তান মোটা হয়ে যাচ্ছে? মেদের জুজু তাড়ান এই সব উপায়ে
শিশুরাও বাদ নেই সেলফি-র টান থেকে।
‘সেলফাইটিস’ নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই সেলফি তোলায় কেবল মৃত্যুর সংখ্যা দেখলেই এর ভয়াবহতা বোঝা যায় না। যাঁরা মারা যাচ্ছেন না অল্পের জন্য বা বিপজ্জনক ভাবে সেলফি তুলছেন, তাঁরাও যে কোনও দিন দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। একটা একটি মানসিক অসুখ। অবসাদ ও তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে অনেক সময় ব্যক্তিটি নিজের মানসিক তৃপ্তির জন্য এমন করেন। ছবি এডিট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে প্রচুর ভাল কমেন্ট এবং লাইক পেতে চাওয়ার এই খিদে আসলে মানুষ কতটা অসুখী, নিরাপত্তাহীন ও মনকেমনের শিকার সে দিকেই ইঙ্গিত দেয়।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy