দূষণের জন্য অন্যকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের করণীয় সম্পর্কে সচেতন হই না। ক্ষতি করি পরিবেশের।
স্কুলের পাঠ্যবইয়ে সকলেই করণীয়-বর্জনীয়ের পাঠ পেয়েছি। কিন্তু তার কতটুকু মেনে চলি? আমাদের রোজনামচা অজান্তেই হয়ে উঠছে ক্ষতিকর। উত্তরাধিকার সূত্রে সে ক্ষতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও। তাদের জন্য বাড়ি-গাড়ি-ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের পাশাপাশি রয়ে যাচ্ছে বাতাসে বিষ, খাবারে ভেজাল আর অপ্রতুল জলসম্পদ। দিল্লির দূষণের চিত্র বা উপর্যুপরি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সংকেতও কি চোখ খুলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়? দূষণের জন্য অন্যকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের করণীয় সম্পর্কে সচেতন হই না। ক্ষতি করি পরিবেশের। তাই সাধ্যের মধ্যেই বার করতে হবে পরিবেশবান্ধব ভাবে বাঁচার উপায়।
বাদ দিন প্লাস্টিক
সরকার আইন করে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের চেষ্টা করলেও নাগরিকরা প্লাস্টিক বর্জন না করলে সুরাহা নেই। সিকিম কিন্তু ইতিমধ্যেই করে দেখিয়েছে। প্লাস্টিক ফ্রি সে রাজ্য। আমরাও অনায়াসে বাড়িতে জল খাওয়ার প্লাস্টিকের বোতলগুলি বদলে ফেলতে পারি কাচ, মাটি, স্টিল, তামার বোতলে। কুঁজো বা কলসির ব্যবহার এবং সেই সঙ্গে গ্লাসও ফিরিয়ে আনা যায়। প্লাস্টিকের দোসর মেলামাইনের তৈরি সামগ্রীও। বাজারের থলে হোক কাপড়ের, ক্যানভাসের ব্যাগও চলনসই। বিক্রেতা প্লাস্টিক দিলে অনুরোধ করুন শালপাতা বা ঠোঙায় দিতে। যেমনটা করে থাকেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত। ‘‘শোওয়ার ঘরে দশ বছর হয়ে গেল এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করিনি। ঠিক করে নিয়েছি, যাতে ইলেকট্রিক বিলের অঙ্ক একটা সীমা না ছাড়ায়। এক ইউনিট বিদ্যুতের জন্য প্রায় ১.৩ কিলোগ্রাম কার্বন বাতাসে মেশে। হিসেব করে বিদ্যুতের ব্যবহার কিছুটা কমাতেই পারি আমরা,’’ পরামর্শ তাঁর।
কমফর্ট-কনভিনিয়েন্স- ক্যাটাস্ট্রফি
পরিবেশবিদদের মত, বিলাসী জীবনযাপন আমাদের আরও তাড়াতাড়ি বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কমফর্ট, কনভিনিয়েন্স এবং ক্যাটাস্ট্রফি শব্দ তিনটির সংযোগ নিবিড়। কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময়ে অনেকে মিলে কার পুল কিংবা কাছাকাছি দূরত্বে সাইকেলের ব্যবহার কমিয়ে দিতে পারে পেট্রোলজনিত দূষণ। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান অরণি চক্রবর্তী যেমন রোজ তিন-চার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পৌঁছন কর্মক্ষেত্রে। দূরে কোথাও যাওয়ার ক্ষেত্রে সময়ের বাধা না থাকলে প্লেনের বদলে ট্রেনে টিকিট বুক করেন সুভাষ দত্ত। নিজের ছেলের বিয়েও দিয়েছিলেন যথাসম্ভব পরিবেশবান্ধব ভাবেই। প্লাস্টিক ফ্রি সেই বিয়েবাড়িতে অতিথিদের দেওয়া হয়েছিল প্রায় সাড়ে চারশো গাছ। ছিল সোলার লাইটের ব্যবস্থাও।
আরও পড়ুন: মোবাইলের দুনিয়ায় বুঁদ প্রিয় কেউ? এই সব উপায়ে সরান নেশা
পুরনো টায়ারের মধ্যে লাগানো গাছ
শুধু বাড়িতে নয়, অফিসের ডেস্কে ছোট গাছ রাখা, কাগজের ব্যবহার কমানো, প্লাস্টিকের চা-কফির কাপ ব্যবহার বন্ধের মতো ছোট পদক্ষেপ করাই যায় সহজে। বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করুন কাগজের কাপ, পাটের ব্যাগ, বাঁশের স্ট্র-চামচ ইত্যাদি। এসি চালানোর সময় সেভার মোডে রাখলে তা খানিকটা বিদ্যুতের সাশ্রয় করে। বাড়ির বারান্দায় বা ছাদে বাগান করা মোটেই শক্ত ব্যাপার নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যাতে বইয়ের পাতা দেখে চড়াই বা শালিক চিনতে না হয়, তার জন্য ছোট পাত্রে একটু করে জল আর খাবার রাখতেই পারেন ব্যালকনিতে। বাড়িতে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, পাম্প, এসি সব একসঙ্গে না চালানোই ভাল। বাজার করার সময়ে মাথায় রাখুন স্থানীয় ফল, আনাজ, মাছ কেনার কথা। কারণ চালানি মাছ কিংবা আমদানি করা ফল-আনাজের সঙ্গে যুক্ত তার পরিবহণমূল্যও। সুভাষ দত্ত মনে করিয়ে দিলেন ধূপকাঠি, মশা মারার কয়েল থেকে হওয়া দূষণের কথা। এমনকি রান্নাঘর এবং ঠাকুরঘরের দূষণ সম্পর্কেও অনেকেই সচেতন নন। প্রতিটি পার্বণের শেষেই বিসর্জনের ফলে জলদূষণকে ঘিরে বিস্তর বিতর্ক হয়। বাড়িতে নিত্যদিনের পুজোর বাসি ফুল প্লাস্টিকে ভরে জলে ফেলার অভ্যেসও সহজেই পাল্টে ফেলা যায়। সপ্তাহের ফুল একসঙ্গে জমিয়ে অর্গ্যানিক সার তৈরির ব্যবস্থা করুন। টব বা ড্রামে ফুল রেখে চাপা দিন। পরে প্রয়োজন মতো দিন গাছের গোড়ায়। সেখানেই ফেলতে পারেন আনাজের খোসা। বাথরুম ও রান্নাঘরে জলের ব্যবহার কমিয়ে করতে হবে ন্যূনতম। ভেবে দেখুন, দেশে এমন জায়গাও আছে, যেখানে মাথাপিছু এক বালতিরও কম জল ব্যবহার করতে হয় মানুষকে।
এই ভাবনা থেকেই গায়ক শ্রীকান্ত আচার্য রেনওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন নিজের বাড়িতে। সিমেন্টের পরিবর্তে মাটির সরা দিয়ে সিলিং তৈরির মতো নানা উপায়ে সাসটেনেব্ল করে তুলেছেন তাঁর বাড়ি ‘মেঘমুলুক’কে।
বিকল্প হোক রিসাইকেল
আমাদেরই আশপাশের বেশ কিছু মানুষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার। যেমন দমদমের পার্থসারথি গঙ্গোপাধ্যায়। অবসরপ্রাপ্ত গাছপাগল মানুষটি প্লাস্টিক রিসাইকেল করে গাছ লাগিয়ে পাড়ার ভোলই পাল্টে দিয়েছেন! প্লাস্টিকের বোতল, তেলের জার, পুরনো টায়ার, ফেলে দেওয়া পাইপ, হোমিয়োপ্যাথি ওষুধের শিশি— গাছের আধার হিসেবে কী নেই! সেগুলোকে রঙিন করে, চোখ-নাক-মুখ এঁকে কোনওটাকে দুর্গার রূপ দিয়েছেন, আবার কোনও কেরোসিনের জ্যারিকেন হয়ে উঠেছে অভিনন্দন বর্তমানের মুখ! জায়গার অভাবে তৈরি করেছেন ভার্টিকাল গার্ডেন, আপসাইড ডাউন টাব। দশটি অ্যাকোয়ারিয়াম আর টেরারিয়াম জারের মধ্যে তাঁর হাতেগড়া বাস্তুতন্ত্র দেখলে বোঝা যাবে, কেন পাড়ার ছোটরা তাঁকে ‘ভাল দাদু’ বলে ডাকে।
এই ‘ভাল দাদু’দের পেতে রাখা ইটেই গড়ে উঠবে আগামীর ইমারত।
মডেল: মুনমুন রায়, ছবি: জয়দীপ মণ্ডল, মেকআপ: প্রিয়া গুপ্ত, পোশাক: আনোখি, ফোরাম মল, লোকেশন: জিনি’স স্কাইলাইন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy