স্মার্টফোন সংস্থার কর্তার কথা শুনে প্রথমটা আকাশ থেকে পড়েন রঘু রাই। ‘সাহস তো কম নয়! আমি এক জন সিরিয়াস ফোটোগ্রাফার। আমায় এ-সব ভুলভাল কাজ করতে বলছ!’— বেজায় রেগেছিলেন প্রবীণ আলোকচিত্র-শিল্পী। সাধাসাধি করে তাঁকে রাজি করানো হল।
সেই চিনে মোবাইলের ২৪ মেগাপিক্সেল ক্যামেরায় অতএব উঠে এল রঘুর ভারত-দর্শন। স্মার্টফোনে তোলা ছবিগুলো দুই বাই তিন ফুট মাপে ছাপালেনও শিল্পী। এবং নিজেই মানলেন, নাহ্, কাজটা বেড়ে হয়েছে। সেই ছবির সম্ভারেই সেজে উঠেছে স্মার্টফোনে তোলা ভারত-বিষয়ক ছবির প্রথম কফিটেব্ল বই।
এ হেন ঘটনার সূত্র ধরেই দানা বাঁধছে দুশ্চিন্তা। ক্যামেরার দিন কি তবে শেষ হতে চলেছে? জবাবটা অবশ্য রঘু নিজেই দিচ্ছেন। এবং জোর গলায় বলছেন, ‘না’! তাঁর কথায়, ‘‘কিছু ভাল স্মার্টফোন সাময়িক খেলনা হতে পারে, সন্দেহ নেই। কিন্তু যে ফোনটায় এত ছবি তুললাম, সেটাতেও লেন্স পাল্টানো যাবে না। এর থেকে সস্তার ডিএসএলআর ক্যামেরায় বরং ঢের বৈচিত্র্য সম্ভব।’’
দেশের অন্যতম সেরা ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার ধৃতিমান মুখোপাধ্যায়ের মত, ‘‘উৎকর্ষ বজায় রাখতে ভাল ক্যামেরার বিকল্প নেই।’’ স্মার্টফোনের কেরামতিও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। বিয়ের অ্যালবাম, পুজোর ঠাকুর দেখা থেকে দেশে-বিদেশে ফ্যাশন ফটোগ্রাফি— সবেতেই স্মার্টফোন অপ্রতিরোধ্য। খবরের কাগজের ছোট ছবিতেও সে ঢুকে পড়ছে।
স্মার্টফোন বনাম ক্যামেরার এই টক্করের আবহেই এ বার একজোট হচ্ছেন কয়েক জন আলোকচিত্রশিল্পী। ফেসবুক-হোয়াট্স অ্যাপ-ইনস্টাগ্রামের যুগে গড়ে উঠছে শখের আলোকচিত্রীদের তালিমের একটি পরিসর। উদ্যোগের নেপথ্যে একটি সর্বভারতীয় ক্যামেরা রিটেল চেন। তাদের ডাকে লাখো ছবির মধ্যে সেরা বাছাই করতে মাঠে নেমেছেন দেশের সেরা আলোকচিত্রশিল্পীরা। ছবির ভিড়ে কিছু প্রশ্নও খচখচ করছে।
‘‘ক’টা ছবি এখন মন ছুঁয়ে যায়, বলুন?’’— হাসছেন, ছবির নেশায় দুনিয়া চষে বেড়ানো পেশাদার ধৃতিমান। তাঁর কথায়, ‘‘হাতে হাতে স্মার্টফোনে ফটোগ্রাফারের সংখ্যা বেড়েছে। ভাল ছবি তোলার চ্যালেঞ্জটা কিন্তু আরও কড়া হয়েছে।’’ প্রবীণ ফ্যাশন ফটোগ্রাফার বিবেক দাসের মত, ‘‘স্রেফ ক্লিক করতে জানলেই ফটোগ্রাফার হয় না! আসল ছবিটা মন ক্যামেরায় ওঠে।’’
এক কালে বাঙালির ঘরে ঘরে কবি দেখা যেত। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। তার আদলে বলাই যায়, সব ছবি ছবি নয়, কিছু কিছু ছবি। তবু দুনিয়া জুড়ে অগুন্তি ফেসবুক ওয়ালে ছবির ছড়াছড়ি। রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে— স্মার্টফোন সহায়। ফেসবুকে তা দেখে দেখে এন্তার ‘লাইক’-এর ছড়াছড়ি। বিবেকের ঠেস, ‘‘ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি হয়! আসলে কিন্তু যন্ত্রই বারো আনা করে দিচ্ছে।’’
শুধু স্মার্টফোন নয়, এ কালের ডিজিটাল ক্যামেরাতেও ঝকমারি ঢের কমেছে। একটা সময়ে সাবধানে আলো জরিপ করে অ্যাপার্চার ও শাটার স্পিড ব্যালেন্স করতে হতো! তার পরে অঙ্ক কষে বাঘের মতো মোক্ষম মুহূর্তটা কামড়ে ধরা। তখন ফটোশপে দিনকে রাত করা নেই। রিটেক চূড়ান্ত বিলাসিতা! সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ফটোগ্রাফারের চটজলদি খ্যাতিও অভাবনীয়। তবে মজার ব্যাপার, ফেসবুকেই ভাল ছবি তুলতে শেখার তাগিদটাও দানা বাঁধছে। ‘ক্যামেরিনা অ্যাকাডেমি’-বলে একটি গ্রুপে ছবি শেয়ার ও আড্ডায় শখের আলোকচিত্রীরা নিজেদের ধারালো করে তুলছেন। কাল, রবিবার সাউথ সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রেক্ষাগৃহে তাঁদের নিয়েই বসবে কর্মশালা। ইতিমধ্যে বাছাই ৪০০ ছবির মধ্যে সেরার বিচার করবেন রঘু রাই, বিবেক দাস, ধৃতিমান মুখোপাধ্যায়, বিনীত বোহরা, সৌমিত্র দত্ত প্রমুখ পরিচিত আলোকচিত্রশিল্পীরা।
এত ছবি তা হলে কীসে উঠছে? ‘‘দেখা যাচ্ছে, স্মার্টফোনের দাপটে আগেকার হটশট ক্যামেরা বাতিল। তার বদলে ২৪-২৫ হাজার টাকার ডিএসএলআর-এর বিক্রি দ্বিগুণ ছাপিয়ে যাচ্ছে।’’ — পর্যবেক্ষণ ক্যামেরা রিটেলচেন-এর সিইও অনুপ কানোডিয়ার। স্মার্টফোন আর ক্যামেরার লড়াই তবু থামার নয়। জঙ্গলে ছবির নেশায় মত্ত অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘ক্যামেরা, ক্যামেরাই! তবু স্মার্টফোনেও ভাল ছবি উঠতে পারে।’’ প্রসেনজিৎ আকছার আফশোস করেন, সে-যুগে স্মার্টফোন ছিল না-বলেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ক-ত দুর্লভ মুহূর্ত হারিয়ে গেল। টালিগঞ্জের রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ই আবার ঘোর ডিএসএলআর-পন্থী বলে পরিচিত। পাখির ছবির জন্য আইটি পেশাদার সন্দীপ বিশ্বাসও দামি লেন্স কেনেন। তাঁর মত, ‘‘স্মার্টফোনে অত ডিটেলিং আসবে না!’’
আবার সহাবস্থানে আস্থাও আছে। দরকারে স্মার্টফোন আর লাখ টাকার ক্যামেরা— দুয়েতেই ছবি তুলতে ভালবাসেন পেশাদার আলোকচিত্রী শুভময় গঙ্গোপাধ্যায়। শত্রুতা নয়! অনেকেই মানছেন, এই টক্করে ‘ক্রিয়েটিভিটি’র জানলাই খুলে যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy