‘ন্যাড়া’ আসলে ন্যাড়া নয়। — ফাইল চিত্র।
কলকাতা শহরে না হলেও মফস্সলে সোমবার সন্ধ্যায় অনেক জায়গাতেই শোনা যাবে কচিকাঁচাদের চিৎকার ধ্বনি— ‘‘আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল / পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বল হরি বোল।’’ কলকাতায় অবশ্য ন্যাড়াপোড়া এখন হোলিকা দহন হয়ে গিয়েছে। অনেকেই বলেন, এটা অবাঙালি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। তবে এটাও ঠিক যে বাঙালি ন্যাড়াপোড়া বললেও আসলে সেটি ‘ন্যাড়া’ নয়।
ন্যাড়াপোড়াকে আবার অনেকে চাঁচড়পোড়াও বলেন। অনেক জায়গায় বলা হয়ে বুড়ির ঘর পোড়া। তবে বেশি চল ন্যাড়ায়। কিন্তু আদতে ‘ন্যাড়া’ নয়, শব্দটি ‘মেড়া’। লৌকিক উচ্চারণেই ‘মেড়া’ এক সময়ে ‘ন্যাড়া’ হয়ে যায়। ‘মেড়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ভেড়া বা মেষ। বাংলা সাহিত্যেও এর উল্লেখ রয়েছে। কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম পেঁচার নকশা’-র ‘কলিকাতার বারোইয়ারি পূজা’ অংশে লিখেছেন, “শুনেছি, কেষ্ট দোলের সময়ে মেড়া পুড়িয়ে খেয়েছিলেন।’’
‘মেড়া’ শব্দের অন্য ব্যবহারও রয়েছে। নির্বোধ বা নিস্তেজ ব্যক্তিকে ব্যাঙ্গার্থেও ‘মেড়া’ বলা হয়। তবে কি সেই বুদ্ধিহীনতা বা শক্তিহীনতা পুড়িয়ে ফেলারই প্রতীক মেড়া পোড়া?
মোটেও সেটা নয়, বলে জানালেন পুরাণবিদ নবকুমার ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, অতি প্রাচীন কালে শীতকালের শেষে এই সময়টাতেই সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হত৷ তা ঘিরে উৎসব হত। এখন যে দোল উৎসব হয় সেটা সেই সময়েরই স্মৃতি বহন করছে। তাঁর মতে, চাঁচড় দহনে যে গৃহ বা কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়, সেটা মেষরূপী ভাদ্রপদা নক্ষত্রের প্রতিরূপ।’’ তিনি আরও জানান যে, শাস্ত্রমতে, এই দহন উৎসব আসলে অসুর হিসাবে কল্পিত মেষ বা ছাগকে ভস্মীভূত করা। যার ফলে সূর্যের উত্তরায়ণের বাধা থাকে না এবং সূর্যের তাপ ও দিনের বৃদ্ধি ঘটে। দোলে লাল আবিরের ব্যবহার লোহিতবর্ণ সূর্যের দ্যোতক বলেও অনেকে দাবি করেন।
অন্য কাহিনিও রয়েছে। বলা হয়ে থাকে পুরাণে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান রয়েছে। হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর পত্নী দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপুর বোন। ব্রহ্মার বর পেয়ে হিরণ্যকশিপু দেব ও মানব বিজয়ে যান। এর পরে তিনি দেবতাদের অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। প্রহ্লাদ বিষ্ণুকে নিজের পিতার উপরে স্থান দেওয়ায় রেগে ওঠেন হিরণ্যকশিপু। নিজের ছেলেকেই পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন। দাদার আজ্ঞায় হোলিকা ভাইপো প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করেন। কিন্তু বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অক্ষত থাকেন এবং আগুনে পুড়ে হোলিকার মৃত্যু হয়। এই কাহিনি থেকেই দোলের আগের দিন হোলিকাদহন বা চাঁচড় উৎসব এসেছে বলে মনে করা হয়।
অনেক পুরাণ-বিশেষজ্ঞ আবার এর পিছনে শ্রীকৃষ্ণের মেষাসুর-বধের কাহিনি রয়েছে বলে মনে করেন। বলা হয়, সত্যযুগে রঘু নামে এক ধার্মিক রাজা ছিলেন। ঢুণ্ঢা নামে এক রাক্ষসীর উপদ্রব শুরু হয় তাঁর রাজ্যে। তা থেকে মুক্তি পেতে পুরোহিত বলেন, ঢুণ্ঢা তপস্যা করে শিবের বর পেয়েছে। শুধু ঋতু পরিবর্তনের সময় অল্পবয়সি ছেলেদের হাতে এই রাক্ষসীর বিপদ হতে পারে। ঢাক-ঢোল বাজিয়ে একে পুড়িয়ে মারতে হবে। এখান থেকেই নাকি এসেছে চাঁচড়পোড়া, মেড়া পোড়া বা বাঙালির ন্যাড়াপোড়ার আচার।
সব মিলিয়ে রঙের উৎসবের আগে অশুভকে আগুনে সমর্পণের রীতিটি দেশের নানা প্রান্তেই রয়েছে। ফাল্গুনী পূর্ণিমার আগের সন্ধ্যায় শীতের আবর্জনা, শুকনো ডালপাতা পুড়িয়ে দেওয়ার রীতির নাম শুধু আলাদা আলাদা। হোলির আগের দিন হয় বলে উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় তো এটাকে ‘ছোটা হোলি’-ও ডাকা হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy