শব্দে ব্রহ্ম মেলে!
২০২০ সাল কোন কোন নতুন শব্দ আমাদের জীবনে জুড়ে দিয়েছিল মনে আছে? তালিকায় করোনা ছাড়াও আছে লকডাউন, কোয়রান্টিন, ডালগোনা কফি আর? আর মাকব্যাং!
এই শব্দটা আপনি হয় বাচ্চাদের মুখে শুনেছেন, নয়তো সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিয়োতে দেখেছেন। সেই ভিডিয়োয় এক জন ক্যামেরার সামনে খাবারের পাহাড় নিয়ে বসে দামোদর শেঠের মতো গপাগপ খাচ্ছে। কেউ বিরক্ত হয়ে ভিডিয়ো সরিয়ে দিয়েছেন, আবার অনেকেই নিজেরই অজান্তে অন্যের সেই খাওয়ার দৃশ্য হাঁ করে দেখতেই থেকেছেন। ফলে ভিডিয়োর ভিউ আর লাইক হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে। খেয়ে খেয়েই মন, পেট আর পকেট ভরিয়ে ফেলছেন তিনি। এমনধারা মহাভোজের ভিডিয়োর উৎপত্তি দক্ষিণ কোরিয়ায়, গত দশকের গোড়ায়। সে দেশের ভাষায় একে মাকব্যাং বলে। আর এখন অতিমারি যুগে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘এএসএমআর মাকব্যাং’। এ ক্ষেত্রে খাদক খচমচ শব্দ করে প্যাকেট খুলে খাবারদাবার বার করে, ঠংঠাং প্লেট সাজায়, তার পর হুসহাস করে খায়। গত দু’বছর ধরে আন্তর্জাল বিনোদনে এবং করোনাধ্বস্ত জীবনযাপনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ‘এএসএমআর’ ট্রেন্ড। সহজ করে বললে, বিশেষ কিছু শব্দ শুনে আরাম পাওয়ার প্রবণতা! অতিমারি জনিত স্ট্রেস, অবসাদ, মানসিক অস্থিরতায় নাকি ম্যাজিকের মতো কাজ দিচ্ছে কিছু নরম, মৃদু, আরামদায়ক বা শিহরন জাগানো শব্দের মানসিক মলম। তাই অনলাইনে ও অফলাইনে এই ধরনের শব্দ বেচার বিশ্বজোড়া হাট বসে গিয়েছে।
শব্দেই ব্রহ্ম মেলে
এমনটা যে হতেই পারে, সে কথাটা বহু যুগ আগেই বোধহয় এ দেশের মুনিঋষিরা বলে দিয়ে গিয়েছেন। পুরাণে শব্দকে ব্রহ্ম রূপে বর্ণিত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা, শব্দ বিভিন্ন রকম ‘ভাইব্রেশন’ সৃষ্টি করে। সেই কম্পনের দ্বারা নেগেটিভ ও পজ়িটিভ, দু’ধরনের এনার্জিই উৎপন্ন হয়। মাঝরাতে মোটরবাইকের পাড়াজাগানো হর্নের চ্যাঁচানি, বহুক্ষণ ধরে চড়া স্টিরিয়োর আওয়াজ, ধাঁই ধাঁই করে ইট ফেলার শব্দ আমাদের মেজাজ তিরিক্ষে করে দেয়। অর্থাৎ নেগেটিভ এনার্জির জন্ম দেয়। আবার পাখির কূজন, ঝরনার শব্দ, জঙ্গলের গুঞ্জন, সমুদ্রের গর্জন, এমনকি মৃদু যন্ত্রসঙ্গীতেও আমাদের মনটা তরতাজা হয়ে ওঠে। এ সবই বিশেষ বিশেষ শব্দতরঙ্গের পজিটিভ এনার্জির কামাল। যখন বেদজ্ঞরা নাভিপদ্ম থেকে ওম কথাটি উচ্চারণ করেন, তা যেন শরীরতন্ত্রের অণু পরমাণুগুলিকে কাঁপিয়ে দিয়ে উঠে আসছে। এতে যে শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে, তা যেন এক অতীন্দ্রিয় জগতে তাঁদের স্থানান্তরিত করছে। সে এক অনির্বচনীয়, স্বর্গীয় অনুভূতি। কাজেই শব্দের শক্তি অসীম।
#এএসএমআর ঠিক কী?
সেই শক্তিই বুঝি এই এএসএমআর নামক আশ্চর্য মনোজাগতিক বিক্রিয়ার মূলে। পুরো কথাটি হল অটোনোমাস সেন্সরি মেরিডিয়ান রেসপন্স। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, কোনও কোনও মানুষের এই বিশেষ অনুভূতির বোধ থাকে। ফিসফিস আওয়াজ, পাতা ওল্টানো বা কাগজ মুড়ে রাখার খড়মড় শুনলে, ত্বকে কেউ তুলি বোলাচ্ছে বা ছুরি দিয়ে আস্তে করে সাবান কাটা হচ্ছে দেখলে, তাঁদের মাথার ভারটা হঠাৎই হালকা হয়ে যায়। অব্যক্ত সুখানুভূতি হয়। মনে হয় মাথার ঠিক মধ্যিখানে রিনঝিনি শিহরন সাঁতার কাটছে। তার পর তা ছড়িয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কের সবখানে। সেই শিহরন যেন ক্রমে নেমে আসছে ঘাড়ে, সেখান থেকে সঞ্চারিত হচ্ছে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। এতে খুব রিল্যাক্সড লাগে।
এএসএমআর ট্রেন্ড কিন্তু বছর দশেকের উপর ধরেই চলছে। তবে করোনার দাপট বাড়তেই তার ভীষণ রমরমা হয়েছে। কারণ, অতিমারির শ্রান্তির ভার লাঘব করতে, একাকিত্বের জ্বালা জুড়োতে তার নাকি জুড়ি নেই। এ বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়রঞ্জন রাম বলছেন, “এই সংবেদন বা আরাম-অনুভূতিগুলি কিন্তু খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই হয়। অনুশীলন করে এমন অভিজ্ঞতা আনা সম্ভব কি না, এখনও জানা নেই। যারা এই সংবেদন অনুভব করছে, তাদের মস্তিষ্কের কোনও কোনও অংশ বেশি সক্রিয় হয়ে উঠছে বলেই জানা যাচ্ছে।” মস্তিষ্ক উদ্দীপিত হয়ে উঠছে, তাই ইন্টারনেটের ভাষায় এএসএমআর-কে ‘ব্রেনগ্যাজ়ম’ও বলা হচ্ছে।
কোথায় পাবে তারে
কেউ মাথায় বিলি কেটে দিলে বা পিঠে আঙুল দিয়ে নাম লিখলে যে আরাম— এএসএমআর-এর অনুভূতিগুলিও কতকটা তেমনই। আলতো হাতের স্পর্শ, নিচুস্বরে কথোপকথন, সূক্ষ্ম হাতের কাজ (যেমন কাগজ বা ত্বকে তুলি বোলানো, হেয়ারকাটিং), কুড়মুড়ে বা খুচুরখাচুর শব্দ— সবই এএসএমআর-এর উৎস হতে পারে। ভিডিয়ো বানিয়ে এই সব দেখিয়ে বা শুনিয়ে উপার্জন করছেন বহু ইউটিউবার। আর বাজারে ভরে গিয়েছে পপেট টয়। ডা. রাম বললেন, “ওরা ওই আওয়াজ শোনার মজাটা, সেনসেশনটা বারবার পেতে চাইছে।”
সশব্দ খাওয়ার ভিডিয়ো বা ‘এএসএমআর মাকব্যাং’ তো ছেয়ে গিয়েছে। তাতে কেউ সুডুৎ সুড়ুৎ করে নুডলস খাচ্ছেন, কেউ চাকুমচুকুম শব্দে মোমো বা বিরিয়ানি সাঁটাচ্ছেন তৃপ্তি করে। ভিডিয়োর আবেদন বাড়াতে, আওয়াজগুলো আলাদা রেকর্ড করার উপায়ও রয়েছে। কেউ সকাল থেকে উঠে বাজার করা থেকে শুরু করে, রান্নাঘরে ঢুকে খাবার বানানো ও সবাই মিলে খাওয়ার পুরো রোজনামচার ভিডিয়ো তুলছেন। কেউ বা রেস্তরাঁ থেকে খাবার অর্ডার করে ক্যামেরার সামনে খেতে বসছেন। কিন্তু দর্শকরা ভিডিয়ো-মাধ্যমে অন্যের ঘরে ঢুকে তাঁদের খাওয়াদাওয়া দেখছেনই বা কেন? বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, অনেক কারণ রয়েছে। এই অতিমারি-বিধ্বস্ত সময়ে অনুষ্ঠানে-পার্বণে গোষ্ঠীভোজের, রেস্তরাঁয় গিয়ে হইহই করে খাওয়ার সুযোগ কমেছে। তার জন্য একটা চাপা মনখারাপ তো আছেই। অন্যকে পাত পেড়ে খেতে দেখলে, হয়তো সেই গুমোটটা কেটে যাচ্ছে। সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রীতিভোজের সময়ে যে প্লেট রাখার, কাঁটা-চামচ সাজানোর, আয়েশ করে খাওয়ার খুশিমাখা শব্দগুলো ঘোরে, ছায়াবাস্তবের দুনিয়ায় সেই ধ্বনিগুলিরই পুনর্নির্মাণ হচ্ছে এই ভিডিয়োগুলোর মাধ্যমে। মস্তিষ্কে একই আনন্দবার্তা পৌঁছাচ্ছে। অনেকে বলছেন, আগে নামকরা খাইয়েরা বাজি ধরে পঁচিশটা লেগপিস, কুড়িটা মাছ, আধ গামলা দই উড়িয়ে দিতেন। তখনও তো লোক জমে যেত তাদের খাওয়ার খেল দেখতে। যাঁরা বিশাল থালায় উপুড়চুপুড় খাবার সাজিয়ে গপাগপ খাচ্ছেন, তাঁদের দেখে সেই মজাই ভার্চুয়ালি মিলছে। করোনার ফলে জন্মানো একাকিত্ব বোধের উপশম হচ্ছে এই সব ভিডিয়োয়।
তবে ফুড এএসএমআর-এর ভিডিয়োগুলোয় অনেকেরই আপত্তি। তাঁদের মতে, এই দুঃসময়ে অনেকেই খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর সেখানে কত খাবারের অপচয় হচ্ছে। তাই ভুল বার্তা যাচ্ছে সমাজে। তবে এএসএমআর ভিডিয়োর আর একটি প্রকার নিয়ে বোধহয় কারওরই কোনও অভিযোগ নেই। তা হল, নেচার এএসএমআর। অর্থাৎ গাছের পাতার খসখস, শিশির ঝরার টুপটাপ, বৃষ্টির রিমঝিম, নদীর জলের ছলাৎছলাৎ শব্দ, মোরগের ডাক। এ সব খাঁটি প্রাকৃতিক ধ্বনি ভিডিয়ো বা রেকর্ড করেও এএসএমআর ট্যাগ করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন অনেকেই। যাঁরা শোনেন, তাঁরা বলেন এ সব নৈসর্গিক ধ্বনি নিমেষে মনটাকে আহ্লাদে ভরিয়ে তোলে।
বাচ্চারা নিরাপদ তো?
#এএসএমআর বা মাকব্যাং স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে বিরাট উন্মাদনা জাগিয়েছে। অভিভাবকেরা একটু চিন্তিত। বাচ্চারা আসক্ত হয়ে পড়ছে না তো? এ সব ভিডিয়ো ওদের উপর শেষমেশ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না তো? বিশেষজ্ঞেরা বলেন, এই ট্রেন্ড একেবারেই বিপজ্জনক নয়। তবে সন্তান মাকব্যাং ভিডিয়োয় খুব বেশি আগ্রহী হলে, আপনিও ওর সঙ্গে ভিডিয়োগুলো দেখুন। কী দেখলেন আলোচনা করুন। এতে ওর ভাবনাচিন্তারও পরিষ্কার হদিস পেয়ে যাবেন আপনি।
থেরাপি নাকি?
নেটিজ়েনরা প্রায় একমত, এতে মস্তিষ্কের বিনোদন তো মিলছেই। তা ছাড়াও, এএসএমআর ভিডিয়োগুলো ঘরবন্দিদশার একঘেয়েমি কাটায়, মানুষের সঙ্গে সংযোগ বাড়ায়। মেজাজ চাঙ্গা রাখে। কেউ কেউ বলছেন, অবসাদ-দুশ্চিন্তা তো বটেই, এএসএমআর অনিদ্রা, মাইগ্রেনের ব্যথা সারিয়েছে। বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকেরা তাঁদের দাবি উড়িয়ে দিচ্ছেন না একেবারে। তাঁদের কথায় মিউজ়িক থেরাপি-র মতোই এএসএমআরও একটি নতুন ধরনের থেরাপি হতেই পারে।
এএসএমআর আদৌ আছে না নেই, ভাল না মন্দ সে সব নিয়ে আলোচনা চলছে। সঙ্গে উঁকি দিচ্ছে প্রশ্ন। নিউ নর্মাল যুগে, বাস্তবের যত ঝুটঝামেলা-মনখারাপ, তার সব সমাধান কি শেষমেশ ভার্চুয়াল পৃথিবীর অলিগলিতেই পাওয়া যাবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy