বিবাহবিচ্ছেদের পর থেকে তিতিরকে আরও বেশি আঁকড়ে ধরেছেন সন্দীপ্তা। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েকে সব সময়ে আগলে রাখতে চান। মায়ের ভালবাসা, অনুভূতি বুঝলেও হাঁসফাঁস অবস্থা তিতিরের। একলা ঘরে নিজের মতো সময় কাটাবে, সে সুযোগ নেই। খেতে, ঘুমোতে, উঠতে-বসতে মায়ের নজরদারি দিনে দিনে অসহ্য লাগছে তার।
অর্কের সমস্যাটা আবার অন্য। মা সরকারি উচ্চপদে কর্মরতা। বাবা ব্যস্ত ব্যবসার কাজে। একমাত্র সন্তানের অভাব রাখেননি তাঁরা। তবু অভাববোধ তীব্র বছর দশেকের স্কুলপড়ুয়ার জীবনে। বাবা-মায়ের সঙ্গ, সময়ের জন্য ছটফট করে সে।
তিতির, অর্কের উদাহরণ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং শিশু-কিশোরদের জীবনে এগুলি এখন বাস্তব চিত্র। যে কোনও বাবা-মা চান, সন্তান বড় হোক, সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচুক। কিন্তু দৈনন্দিন কাজের চাপ, সন্তান পালন করতে গিয়ে বহু অভিভাবকই ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। কখনও বুঝে উঠতে পারেন না, কতটা শাসন করবেন, আর কতটা ছাড় দেওয়া প্রয়োজন।
এক সময় যৌথ পরিবারে শিশুরা বাবা-মায়ের সান্নিধ্য ছাড়াও ঠাকুরদা, ঠাকুরমার সাহচর্যে বড় হত। মা রেগে গিয়ে গায়ে হাত তুললে, কাকিমা, জেঠিমা, ঠাকুরমার স্নেহের পরশ তাদের আগলাত। একান্নবর্তী পরিবারে সন্তান বড় হয়ে যেত বাড়ির আর পাঁচ জনের কোলেপিঠেই। সেই যৌথ পরিবার এখন অতীত। বাবা-মা দু’জনেই কর্মরতা। অনেক সন্তানই এখন বড় হয় বাবা অথবা মায়ের একলার অভিভাবকত্বে। সময়ের সঙ্গে বদলেছে নতুন প্রজন্মের শিশুদের মন এবং মানসিকতাও। ফলে, সন্তানের মনের তল পাওয়াও কঠিন। সামান্য কারণে তারা হয়তো রেগে যাচ্ছে, জেদ করছে। কখনও চুপ হয়ে থাকছে। ফলে প্রশ্ন থাকে, কী ভাবে অভিভাবকেরা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সঠিক ভাবে মানুষ করবেন?

ছবি: সংগৃহীত।
তারই উত্তর খুঁজতেই বিশ্ব জুড়ে নানা ভাবনা, সমীক্ষা, মতের জন্ম। এরই ফলশ্রুতি ‘পান্ডা পেরেন্টিং’। পান্ডা বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুন্দর একটি প্রাণীর ছবি। ধীরস্থির পান্ডারা সন্তানদের যেমন সযত্নে লালন করে, তেমন নিজের মতো বেড়ে ওঠার সুযোগও দেয়। তাদের অভিভাবকত্বের কৌশল থেকেই এমন নামকরণ। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, ‘‘স্বাধীনতা এবং তার সঙ্গে নিয়মানুবর্তিতার ভারসাম্যের কথাই বলা হয়েছে এই অভিভাবকত্বে।’’ মনোবিদ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, পান্ডা পেরেন্টিং-এর মূল কথাই হল সন্তানকে স্বাধীনতা দেওয়া। নিজের মতো করে বড় হতে গিয়ে সে ভুল করবে, ভুল থেকে নিজেই শিখবে। নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হবে।
পান্ডাদের মতো অভিভাবকত্বের ভাবনা কোথা থেকে এল?
আমেরিকার সাংবাদিক এবং শিক্ষাবিদ এস্থার ওয়েজ়িস্কি তাঁর বই ‘‘হাও টু রেজ় সাকসেসফুল পিপ্ল: সিম্পল লেসন্স ফর র্যাডিক্যাল রেজাল্টস’’ বইয়ে প্রথম পান্ডা পেরেন্টিং-এর কথা উল্লেখ করেন। এস্থার নিজেও দুই সন্তানের মা। অভিভাবকত্ব নিয়ে এস্থারের বক্তব্য, পান্ডা পেরেন্টিং-এর মূল কথাই হল সন্তান এবং অভিভাবকের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, স্বাধীনতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। বইয়ে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন লেখিকা। তিনি বলছেন, ‘‘পান্ডা মায়েরা কিন্তু মোটেই অলস নয়। তবে তারা সন্তানকে নিজের মতো ছেড়ে দেয়। সর্ব ক্ষণ ছেলেমেয়ের উপর নজরদারি করার বদলে অভিভাবকের উচিত প্রয়োজনের সময় সন্তানের পাশে থাকা।’’

ছবি: সংগৃহীত।
অভিভাবকত্বের ইতিবাচক দিক
স্বাধীন ভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয়। পায়েলের কথায়, ক্রমশ পরিবার ছোট হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যখন ছেলেমেয়েকে একলা সিদ্ধান্ত নিতে হয়, মানসিক ধাক্কাও নিজেকে সামলাতে হয়। এমন অভিভাবকত্বে ছোট থেকেই সেই শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ থাকে। অনিন্দিতা বলছেন, ‘‘এর অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল মানসিক ঝড়ঝাপটা সামলানোর ক্ষমতা। কাজ করতে গিয়ে অনভিজ্ঞতায় ভুল হতে পারে। সেই ভুল থেকে শেখা, পরিস্থতি সামলাতে পারার দক্ষতা বাস্তব জীবন থেকেই তৈরি হয়ে যায়।’’
পান্ডা পেরেন্টিং-এ যে হেতু নিজের ইচ্ছায় কাজ করা যায়, তাই সেই কাজে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে ঠিক-ভুলের দায়ও নিতে হবে সন্তানকেই। অনিন্দিতার কথায়, টাইগার পেরেন্টিং বা হেলিকপ্টার পেরেন্টিং-এ সন্তানের উপর বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণ বা যে কোনও কাজে নজরদারি, হস্তক্ষেপের প্রবণতা থাকে, এই বিষয়টি ঠিক উল্টো। কেউ যদি পড়াশোনায় নিজের ইচ্ছামতো বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়, তা হলে সে তার মতো করে এগিয়ে যেতে পারবে। ভবিষ্যৎ নিয়ে কিন্তু বাবা-মাকে দোষারোপের জায়গা থাকবে না। পায়েলের বক্তব্য, কাজে সাফল্য তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে।
স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িয়ে দায়িত্ব
স্বাধীনতা যেমন শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করতে পারে, তেমনই স্বাধীনতার সঙ্গে যে দায়বদ্ধতা জড়িয়ে, তা অনুধাবন করতে না পারলে বিপদের ঝুঁকিও থাকে। অনিন্দিতা বলছেন, ‘‘সব শিশু বা কিশোরের মানসিক ক্ষমতা এক রকম হয় না। যাদের চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য খুব স্পষ্ট, তাদের ক্ষেত্রে এমন অভিভাবকত্ব অবশ্যই ইতিবাচক। তবে অনেক ছেলেমেয়ের পক্ষে একা একা সব কিছু শিখে ফেলা, ভুল শুধরে নেওয়া সম্ভব হয় না। কারও কারও ক্ষেত্রে অভিভাবকের হস্তক্ষেপ জরুরিও হয়। একই মত পায়েলের। স্বাধীনতা পাওয়া মানে তার দায়িত্বও থাকবে। আর তা না বুঝলেই সমস্যা। অনেক সময়ে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার সুযোগকে বাড়তি ক্ষমতা বলে মনে করতে পারে ছেলেমেয়েরা। হাতে ক্রেডিট কার্ড রয়েছে, বিবেচনা না করে মোটা টাকা খরচ করে ফেলল, সেটা ঠিক নয়। পায়েল বলছেন, ‘‘তাই স্বাধীনতা দেওয়া হলেও সন্তানদের জন্য স্পষ্ট সীমারেখা থাকা দরকার।’’
আরও পড়ুন:
কোন পথে চলবেন অভিভাবকেরা?
প্রয়োজন মতো পাশে থাকা: সন্তানকে নিজের মতো বেড়ে উঠতে দেওয়া এর শর্ত হলেও প্রয়োজনে ছেলেমেয়েদের পাশে থাকতে হবে। তাদের কার্যকলাপ এবং সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নিজের মতামত চাপিয়ে না দিলেও, তাদের ভাবনা জানা বাবা এবং মায়ের জন্য খুব জরুরি।
মানসিক সমর্থন: এই অভিভাবকত্বের গুরুত্বপূ্র্ণ বৈশিষ্ট্য হল বিশ্বাস। বাবা-মা যেমন সন্তানকে বিশ্বাস করবেন, তেমনই ছেলেমেয়েও বাবা-মায়ের ভরসার মান রাখবে। তবে এ ক্ষেত্রেও কোথাও সীমারেখা ঠিক করে দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে সন্তানের মানসিক সমর্থনের প্রয়োজন হলে, সেটিও দিতে হবে অভিভাবককে।
স্বাধীনতা দিলেও নজরে রাখা: পান্ডা পেরেন্টিং-এর মূল শর্তই হল সন্তানকে স্বাধীনতা দেওয়া। তবে মনোবিদ বলছেন, স্বাধীনতা দেওয়ার পরেও দূর থেকে নজরদারি জরুরি। কোনও ভুল করতে যাচ্ছে বুঝলে সঙ্গে সঙ্গে ধরিয়ে দিতে হবে এমনটা নয়, কিন্তু দেখতে হবে সে কী ভাবে পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। অনিন্দিতার কথায়, সকল শিশু বা ছেলেমেয়ের মানসিকতা, বুদ্ধিমত্তা এক নয়। সে ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি লাইটহাউস পেরেন্টিং-এর মতো দূর থেকে সন্তানের উপর নজর রাখাটা সন্তানের জন্য ভাল হতে পারে।