Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Childrens Day

শিশুদের ভালবাসেন, কিন্তু সুখী থাকতে কেন সন্তানের জন্ম দিতেই হবে, প্রশ্ন নবীনদের

সন্তানলাভ নানা ভাবে হয়। নিজে সন্তানের জন্ম না দিয়েও হতে পারে। শিশু দিবসে নানা ভাবে শিশুদের ভালবাসা ও তাদের যত্ন করার কথা বলল তরুণ প্রজন্ম।

সুখী পরিবার মানেই কি সন্তান? এই ধারণা নাকচ করে নিজেদের মতো করে বাঁচছে নতুন প্রজন্ম।

সুখী পরিবার মানেই কি সন্তান? এই ধারণা নাকচ করে নিজেদের মতো করে বাঁচছে নতুন প্রজন্ম। ছবি: পিক্সাম

সুচন্দ্রা ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২২ ১০:৪৩
Share: Save:

বয়স বাড়লে মাঝেমাঝে একা লাগে। এই ভয়ে পরিবার বাড়িয়ে তো নিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু সন্তানদের জন্য চিন্তাও লেগে থাকে। পরিবেশ-পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তার মধ্যে ভাল থাকবে তো ওরা? মনে হয় ষাট পেরোনো বাবা-মায়ের। আবার মধ্য তিরিশের ছেলে-বৌমা, কেন নাতি-নাতনির মুখ দেখাচ্ছেন না এখনও, তা নিয়েও মাঝেমাঝে মুখ ভার হয়। ছেলেও তো বয়সকালে একা হয়ে যেতে পারে!

এত ভয়ের তোয়াক্কা করেন না ছেলে। স্কুলশিক্ষক সাম্য সাহা ঠিক করে নিয়েছেন, তাঁর সুখে থাকার সংজ্ঞায় সন্তানের জন্ম দেওয়া নেই। রোজ স্কুলে নানা বয়সের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের নিয়ে চিন্তা লেগেই থাকে। ওদের দেখে মন ভাল হয় ঠিকই। কিন্তু পরিবেশ দূষণের কারণে যে কত কষ্ট বাড়ছে এ সময়ের শিশুদের, তা তিনি রোজ উপলব্ধি করেন। তাই আর নয়। অন্তত তিনি কোনও শিশুকে আনবেন না দূষণে ভরা এই পৃথিবীতে।

চারধারের পরিবেশের কথা ভেবে হোক কিংবা অনাথের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা, তরুণ সমাজ পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে নানা ভাবে ভাবছে।

চারধারের পরিবেশের কথা ভেবে হোক কিংবা অনাথের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা, তরুণ সমাজ পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে নানা ভাবে ভাবছে। ছবি: পিক্সাম

তিনি কি তবে শিশুদের ভালবাসেন না? পরবর্তী প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আনন্দ পান না? সাম্য কিন্তু তেমন বলছেন না। বরং জানাচ্ছেন, তিনি পরের প্রজন্মের কথাই ভাবছেন। তাই এ দেশের জনসংখ্যা আর বাড়াতে চাইছেন না। সাম্য বলেন, ‘‘ধরে নিন, পৃথিবীর জন্য এটুকুই করছি আমি। নিজের পরিবার বাড়াচ্ছি না। এতটাই তো আমার হাতে আছে। আমি সচেতন হলে অন্তত একটি শিশুকে দূষণ-সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হবে না। আর বাকিরা যারা আছে, তাদের তাতে ভালই হবে বলে বিশ্বাস করি।’’ আর তাঁর সুখ? সন্তানসুখ না পাওয়ার মতো কষ্ট নিজের জন্য ডেকে আনবেন তিনি?

সাম্য কিন্তু অসুখী নন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আশপাশের শিশুরা ভাল থাকলেও আমার আনন্দ হবে। আমি অসুখী মোটেই নই। আমার স্ত্রী স্বাতীও এমনটাই চান। দু’জনে দিব্যি আছি।’’

সাম্য আর স্বাতী একা নন। এমন ভাবনা নানা কারণে অনেকেই ভাবছেন। কেউ পরিবেশের দিক থেকে দেখছেন, কেউ বা অন্য কোনও কারণে। যেমন বছর ৩৫-এর সংযুক্তা আরও লেখাপড়া করতে চান। বাড়িতে মা খুব অসুস্থ। বাবা নেই। স্বামী থাকেন অন্য শহরে। পরিবারের দায়িত্ব আছে। সব দিক সামলে আর সন্তান নেওয়ার কথা ভাবতে পারছেন না। বলেন, ‘‘অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, আমার মন এত শক্ত কী করে হল? অন্য শিশুদের দেখলে নিজের সন্তান পেতে ইচ্ছা হয় না? আমার কিন্তু সত্যিই হয় না। কারণ, আমার জীবনে এখন যাঁরা আছেন, তাঁদের ভাল ভাবে সময় দিতে চাই। সেটা না করতে পারলে তাতে বেশি অসুখী মনে করব নিজেকে।’’ কিন্তু গবেষণা শেষ হলে তো মনে হতে পারে সন্তানের কথা। তখন দেরি হয়ে যাবে না তো? সংযুক্তা ভেবে নিয়েছেন সে বিষয়ে। তেমনটা হওয়ার নয়। তিনি নিজের সন্তানের মুখ দেখাকেই একমাত্র সুখ মনে করেন না। শিশুদের তিনি ভালবাসেন। দিদির দুই ছেলে তাঁর খুবই কাছের। তাদের জন্য বই কিনতে, তাদের সঙ্গে খেলা করতেও খুব ভাল লাগে। তারাই সংযুক্তার আপনজন। সংযুক্তার দিদিও সে ভাবেই বড় করছেন দুই ছেলেকে। মা আর মাসি, দু’জেনেই তাদের কাছের মানুষ। বন্ধুর মতো। সংযুক্তা মনে করেন, আরও একটি শিশু তাঁদের পরিবারেই এলেই যে সকলে ভাল থাকবেন, এমন নয়। বরং যে দুই শিশু ইতিমধ্যেই আছে, তাদের যত্নে রাখতে চান। এতেই মন ভাল থাকবে তাঁর।

সন্তানের জন্ম না দেওয়া মানেই সুখে না থাকা, এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন এখন অনেকেই। শিশু দিবসে তেমনই কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেছে আনন্দবাজার অনলাইন। শিশুরা ভবিষ্যৎ। তাদের যত্ন করাই ভাল থাকার সংজ্ঞা হিসাবে ধরে নেওয়া হয়েছে এত কাল। তবে কি এ প্রজন্ম শিশুদের ভালবাসতে ভুলে যাচ্ছে? না কি ভাল থাকা এবং ভাল চাওয়ার মানে বদলে ফেলছে?

উত্তর কিন্তু বহুমুখী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, শিশু ও কিশোরদের মধ্যে বাড়ছে মানসিক অসুখের সংখ্যা। শুধু এ দেশে নয়, গোটা বিশ্বেই। কিশোর বয়সে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে গিয়েছে আত্মহত্যা। চারপাশ যত দ্রুত বদলাচ্ছে, ততই চাপ পড়ছে শিশুমনের উপর। ফলে আগের চেয়ে কম আনন্দে থাকছে শিশুরা। দেখা যাচ্ছে, সামগ্রিক ভাবে শিশুদের ভাল থাকার হার নিম্নগামী। আর সে কথাই বার বার মনে করাতে চাইছে কেউ কেউ। বলছে, যেই শিশুরা আছে, তাদের ভাল রাখতে হবে। শিশুকে দিয়ে নিজের সুখের কথা ভাবলে চলবে না।

তবে কি এ প্রজন্ম শিশুদের ভালবাসতে ভুলে যাচ্ছে? না কি ভাল থাকা এবং ভাল চাওয়ার মানে বদলে ফেলছে?

তবে কি এ প্রজন্ম শিশুদের ভালবাসতে ভুলে যাচ্ছে? না কি ভাল থাকা এবং ভাল চাওয়ার মানে বদলে ফেলছে? ছবি: পিক্সাম

এ বার্তা কী ভাবে দিচ্ছেন তাঁরা?

নিজের নিজের মতো করেই ঘরে ঘরে বেড়েছে সচেতনতা। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে রোজগার করা সচ্ছল সংসার দেখলেই অনেকের মনে হয়, এখানে শুধু মাত্র একটি শিশুর অভাব। তবে বহু স্বামী-স্ত্রীই সে ভাবনায় আটকে রাখেননি নিজেদের। যেমন রাখেননি গড়িয়ার বাসিন্দা অর্ক আর অনুষ্কা। নিজেদের রোজগারের টাকায় প্রতি মাসে পাঁচটি শিশুর লেখাপড়ার খরচ চালান ওঁরা। না, সেই শিশুরা তাঁদের সঙ্গে থাকে না। থাকে বিভিন্ন আশ্রমে। কিন্তু অর্ক-অনুষ্কার সাহায্যেই একটু ভাল বই-খাতা, খাওয়াদাওয়া হচ্ছে সেই শিশুদের। অনুষ্কা বলেন, ‘‘আমার বাচ্চাদের খুব ভাল লাগে। ওদের কষ্ট পেতে দেখলে মনখারাপ হয়ে যায়। তাই ঠিক করেছি, যে সব শিশুরা কষ্টে আছে, ওদের একটু ভাল রাখার চেষ্টা করব। সকলের জন্য করতে পারব না। তবে আমার উপার্জন যত বাড়বে, তত বেশি শিশুর লেখাপড়ার দায়িত্ব নেব। মাঝেমাঝে আশ্রমে গিয়ে ওদের দেখে আসি। ওরা কী শিখল, কেমন আছে দেখতে ভাল লাগে। আমার সন্তান হলে হয়তো একটি মাত্র শিশুর যত্ন করতে পারতাম। তখন অন্যদের দিকে মন দেওয়া, অন্যদের জন্য খরচ করার সুযোগও খানিকটা কমে যেত। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ ভাবেই থাকব।’’

স্বামী-স্ত্রী দু’জনে রোজগার করা সচ্ছল সংসার দেখলেই অনেকের মনে হয়, এখানে শুধু মাত্র একটি শিশুর অভাব। তবে বহু স্বামী-স্ত্রীই সে ভাবনায় আটকে রাখেননি নিজেদের।

স্বামী-স্ত্রী দু’জনে রোজগার করা সচ্ছল সংসার দেখলেই অনেকের মনে হয়, এখানে শুধু মাত্র একটি শিশুর অভাব। তবে বহু স্বামী-স্ত্রীই সে ভাবনায় আটকে রাখেননি নিজেদের। ছবি: পিক্সাম

অর্কদের আত্মীয় সুকন্যা আর সার্থকও এখন এ ভাবেই ভাবছেন। একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় সম্প্রতি চাকরি পেয়েছেন সুকন্যা। ঠিক করেছেন, প্রতি মাসে বেতনের অর্ধেক রাখবেন অনাথ আশ্রমের শিশুদের জন্য। একেবারে লেখাপড়া করে দায়িত্ব নেবেন তাদের। সুকন্যা বলেন, ‘‘এত দিন খুবই কম উপার্জন করতাম। নিজের খরচ চালানোই অসুবিধার ছিল। এখন বেতন বাড়ল। আর দেরি নয়। নিজের সন্তান চাই। একটি বা দু’টি শিশুর জন্যও যদি কিছু করতে পারি, আমার মন ভাল লাগবে।’’ কিন্তু তিনি যাদের নিজের সন্তান বলছেন, তারা তো থাকবে না সুকন্যার ঘর আলো করে। এখন এমন মনে হলেও পরে মনখারাপ হবে না তো? সুকন্যার সাফ কথা, ‘‘যদি ভালবাসি, তবে সে যেখানেই থাকুক, ভাল থাকলেই হল। আর যদি কোনও দিন একা লাগে, তবেও ও রকম একটি নিঃসঙ্গ শিশুকে ঘরে আনব। আইন মেনে, যা যা করতে হয় করব। এত বাচ্চা কষ্টে থাকে, আমাদের তো দেখতেই হবে।’’ অনেকে এ ভাবে এগিয়ে এলে তবেই তো শিশুরা ভাল থাকবে, মনে করেন সুকন্যা-অনুষ্কারা।

চারধারের পরিবেশের কথা ভেবে হোক কিংবা অনাথের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা, তরুণ সমাজ পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে নানা ভাবে ভাবছে। যেমন গতিশীল সময়ের সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে ‘পিছিয়ে’ পড়া শিশুদের জন্যও ভেবেছেন কেউ কেউ। নিজের চাকরি ছেড়ে ঘরে বসে শুধু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিছু শিশুকে পড়াচ্ছেন আর এক তরুণী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বছর তিরিশের সেই মেয়ে একটি বেসরকারি কলেজে পড়াতেন। সেই কাজ করতে করতেই মনে হয়, নিজের শিক্ষা বৃহত্তর সমাজের কাজে লাগাবেন। নিজের সন্তান নেবেন না, তা আগেই ঠিক করেছিলেন। বলেন, ‘‘শিশুদের ভাল লাগে। কিন্তু এত শিশুর কষ্ট দেখে আরও একটি শিশুর জন্ম দিতে ইচ্ছা হয়নি। পরে ভাবলাম নিজের শিক্ষা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করি।’’ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের যত্নে এখনও যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই বলেই মনে করেন তিনি। তাই যাদের প্রয়োজন, তাদের পাশে দাঁড়াবেন। ঠিক করে নিয়েছেন তরুণী। বলেন, ‘‘সকাল থেকে বাড়িতে নানা বয়সের শিশুরা ঘোরাফেরা করে। ওদের দেখে মনটাও ভাল লাগে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Childrens Day parenthood Childless Couple
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy