প্রদ্যোত পাণ্ডা ও অনুষ্কা পাণ্ডা।
সিবিএসই দশমের পরীক্ষায় নম্বর ছিল ৫০০-র মধ্যে ৪৮৯। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে দ্বাদশের পরীক্ষায় পান ৯৭ শতাংশ নম্বর। ২০২০ সালে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স-সহ একাধিক প্রথম সারির কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়ার সুযোগ মিলেছিল। কিন্তু পছন্দ ছিল কানপুর আইআইটি। তাই সেখানেই কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়তে ভর্তি হয়েছেন ‘স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি’ (এসএমএ) আক্রান্ত, বছর কুড়ির অনুষ্কা পাণ্ডা। তবে স্বপ্নের এই সফরে বিরল রোগের মতো প্রতিবন্ধকতা জয় করতে হয়েছে হুইলচেয়ারে বন্দি ওই বাঙালি তরুণীকে।
অনুষ্কা একা নন। পরিবারে রয়েছেন তাঁর কাকা প্রদ্যোত পাণ্ডাও, যিনি এসএমএ টাইপ থ্রি আক্রান্ত। পেশায় চিকিৎসক, সল্টলেকের বাসিন্দা প্রদ্যোত যে এই বিরল রোগাক্রান্ত, তা জানা গিয়েছিল সেই আশির দশকে। তবে তা তাঁর চিকিৎসক হওয়ার দৌড় থামাতে পারেনি। বিরল রোগীদের চিকিৎসার খরচ জোগাতে সরকারি স্তরের অনীহা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অথচ এই রোগীরা সমাজের বোঝা নন— সেই কথাই বার বার প্রমাণ করে চলেছেন এই কাকা-ভাইঝি জুটি।
২০০২ সালে ফরিদাবাদে জন্ম অনুষ্কার। বাবা বাঙালি, মা গুরুগ্রামের মেয়ে। অনুষ্কার ১১ মাস বয়সে জানা যায়, সে ‘স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি’ (এসএমএ) নামে বিরল রোগে আক্রান্ত। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে মা অর্চনা ও বাবা অনুপকুমার পাণ্ডার। এই বিরল রোগ সম্পর্কে বিশদে জানতেই কেটে যায় কয়েকটা মাস।
এর পরে মেয়েকে নিয়ে গুজরাতের দমনে ফিরে শুরু হয় স্কুলে ভর্তির চেষ্টা। ‘না’ বলে দিয়েছিল একাধিক স্কুল। শেষে এক সপ্তাহ অনুষ্কাকে ক্লাসে দেখে নিয়ে তবেই ভর্তি করতে রাজি হয় একটি স্কুল। পরের লড়াই আরও কঠিন। সাত বছর বয়সে ধরা পড়ে, অনুষ্কার শিরদাঁড়া বেঁকে যাচ্ছে। সেই চিকিৎসা চলে মুম্বইয়ে। রোগের কারণে ছোট থেকেই ফুসফুস নিয়ে ভুগতে হয়েছে তাঁকে। ২০১২ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে ভেন্টিলেশন দরকার পড়েছিল। দমনে সেই পরিষেবা না থাকায় সাড়ে চার ঘণ্টার ঝুঁকির পথ পেরিয়ে যেতে হয়েছিল মুম্বইয়ে।
এর পরেই পরিবার চলে যায় গুরুগ্রামে। ফের শুরু নতুন স্কুল ও বন্ধুহীন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই। তার সঙ্গে বাড়তে থাকে পড়াশোনাকে আঁকড়ে নিজের পরিচয় তৈরির বাসনা। ২০১৮ সালে দশমের পরীক্ষায় ডিফারেন্টলি এব্লড ক্যাটাগরিতে দেশের মধ্যে প্রথম হন অনুষ্কা।
অর্চনা বলছেন, “মেয়ের অসুখের কথা শুনে প্রথমে ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু যখন শুনলাম, ওর মস্তিষ্ক সুস্থ এবং বুদ্ধিদীপ্ত, তখন লড়াইয়ের জেদ বেড়েছিল। ওর শরীর বেশ খারাপ, ফুসফুসের কর্মক্ষমতা এখন ২০ শতাংশ। ফলে শিরদাঁড়া বেঁকে যাওয়া ঠেকাতে অস্ত্রোপচার করা সম্ভব নয়।”
অনুষ্কার কাকা প্রদ্যোতের যখন ১৫ বছর বয়স, তখন তাঁর পড়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি ভেলোরে মাস্ল বায়প্সি করে রোগ নির্ণয় হয়। বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজথেকে তিনি এমবিবিএস পাশ করেন। এমডি পড়াকালীন অসুস্থতা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যায়। বাড়িতেই প্র্যাক্টিস করতেন তিনি। সমস্যা বাড়তে থাকায় ঘরে চলাফেরা করতেন। শেষে পেন ধরার ক্ষমতাটুকুও হারান।সম্প্রতি ওই রোগের ওষুধ সামনে আসার পরে জীবনের সব সঞ্চয় খরচ করে ছেলের জন্য তা কিনে এনেছেন প্রদ্যোতের বাবা-মা। অর্চনার কথায়, ‘‘গত চার-পাঁচ মাসের চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন প্রদ্যোত। ফের পেন ধরছেন।’’
শিশুরোগ চিকিৎসক সংযুক্তা দে-র মতে, ‘‘এই রোগে মোটর নিউরন শুকিয়ে যায়। কিন্তু অক্ষত থাকে মস্তিষ্ক। ফলে এঁদের মস্তিষ্কের বিকাশ সুস্থ মানুষের মতোই হয়। আমাদের সব কিছু মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে। সেখান থেকে বার্তা পৌঁছয় মেরুদণ্ডে। সেখানকার যে স্নায়ুর মাধ্যমে সারা শরীরে বার্তা ছড়িয়ে পড়ে, তাকেই মোটরনিউরন বলে। ’’
শিশুদের স্নায়ু রোগের চিকিৎসক দীপ্তাংশু দাসও বলছেন, ‘‘মস্তিষ্কের বিকাশ বা বুদ্ধ্যঙ্কের দিক থেকে কোনও কোনও রোগী তাঁদের সমবয়সি সুস্থদের থেকেও এগিয়ে থাকেন। এ নিয়ে গবেষণাও চলছে। পাশাপাশি এমপিএস টাইপ ওয়ানেও মস্তিষ্কের বিকাশ অক্ষত থাকে।গসার ডিজ়িজ় ওয়ানের কিছু ক্ষেত্রেও মস্তিষ্ক সাধারণ বাচ্চাদের মতোই সুস্থ থাকে। উপযুক্ত সময়ে এই রোগীদের চিকিৎসা হলে জীবনের মান উন্নত হতে পারে।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy