তথ্যচিত্রের এক চরিত্রের সঙ্গে পরিচালক দেবলীনা।
সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছেন, মনে আছে? বিয়ে জিনিসটি বড়ই জটিল। যে করে সেও হাবুডুবু খায়, যে না করে সেও খায়!
বিয়ে নিয়ে এ রকম রসিকতার অভাব নেই। এর প্রয়োজনীয়তা এবং অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষেই চলে মশকরা। তবে জটটা কাদের ক্ষেত্রে বেশি? যাঁরা বিয়ে করতে পারেন, নাকি যাঁরা এখনও সুযোগই পান না? বিয়ে নিয়ে রসিকতা করেন কি তাঁরাও? নাকি বঞ্চিত মনে করেন নিজেদের? দেশ-বিদেশে ঘুরে ঘুরে ভাবতে বলছে এ শহরেই তৈরি তথ্যচিত্র ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’। বারবার সে প্রশ্ন তোলার প্রেক্ষিত তৈরি করে দিচ্ছে বদলাতে না চাওয়া এ দেশেরই আইনব্যবস্থা। যেমনটা বৃহস্পতিবারও করল কেন্দ্রীয় সরকার। সমকামী বিবাহকে বৈধতা দেওয়ার আর্জির উত্তরে সাফ জানিয়ে দেওয়া হল, এ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে তা একেবারেই মানানসই নয়।
‘‘যে পথে চলতেই পারব না, তা নিয়ে হাসাহাসি করি কী ভাবে বলুন তো?’’ প্রশ্ন বছর কুড়ির কলেজপড়ুয়া সুরভির। এ তো আঙুর ফল টক বলার মতো হয়ে যাবে, মনে করেন তিনি। কেন এমন ভাবনা এল এ সময়ের এক শহুরে তরুণীর মনে? একমাত্র কারণ, সুরভি সমকামী নারী। কলেজেই এক বন্ধবীর সঙ্গে সম্পর্ক ওঁর। পরিবার তাঁদের বন্ধু বলেই জানে। তাই এখনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু একসঙ্গে থাকতে চাইলে কী বলবেন বাবা-মা? এখন সে সব ভাবতেই চান না ওঁরা। দু’বছর আগে সমকামিতাকে অপরাধের তকমা মুক্ত করেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তবু ভয় তো কাটেনি। হাসি তো দূরের কথা।
সম্প্রতি এক সমীক্ষায় প্রকাশিত হয়েছে, আমেরিকায় আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক নাগরিক নিজেদের সমকামি বলে পরিচয় দিচ্ছেন। এখানে ভয় কাটল না কেন? নিজেকে সমকামী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার আগে এখনও কেন ভাবতে হচ্ছে এত? সমকামীদের বিবাহ-চিন্তা নিয়ে এমন নানা কথা তুলে ধরেছে ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত যাতে হয় একান্ত নিজের, সেই লড়াইয়ে সামিল ‘এলজিবিটিকিউএ’ সম্প্রদায়ের মানুষদের বৃত্তান্ত প্রকাশিত হয়েছে তাতে। পরিবার মানলেও কি সহজ হয় সঙ্গীর পরিচয় প্রকাশ করা? নাকি সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে তাঁদের পছন্দ মেনে নিলেও আদতে পাশে থাকতে পারেন বাবা-মা? সামাজিকতার বাধা ঢুকে পড়ে কি পরিবারের গণ্ডী পেরিয়ে? তথ্যচিত্রের পরিচালক দেবলীনা জানান, যৌনতা ভিত্তিক পরিচয় গোপন করার হার কিছুটা হলেও কমতে শুরু করেছে এ শহরে। তিনি বলেন, ‘‘এক সময়ে টিভি কিংবা ছবিতে সমকামীদের মুখ দেখানোই যেত না। অর্থাৎ, তাঁরা দেখানোর কথা ভাবতে পারতেন না। এখন পারছেন।’’ তথ্যচিত্রটি তৈরি করেছেন এ শহরেরই বহু সমকামী নারী-পুরুষকে নিয়ে। তাঁরা ভয় পাননি নিজেদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে। তবে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে ঠাট্টা করার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা রোজ করতে হয় তাঁদের। তাই তৈরি হয়েছে এই ছবি।
আর একসঙ্গে থাকা? বিয়ে? আঞ্চলিক ভাষার তথ্যচিত্র তো শুধু নয়, বলিউডের পুরদস্তুর বাণিজ্যিক ছবি ‘শুভমঙ্গল জ্যাদা সাবধান’-ও প্রশ্ন তুলেছে এ নিয়ে। তবু কি নিজেদের বর-বউয়ের সম্পর্ক নিয়ে হাসিঠাট্টার সময়ে মনে পড়ে যে পাশে এমনই কেউ বসে আছেন, যিনি এই মশকরা পরিমণ্ডলে ঢোকার অধিকার পাননি এখনও? তিনি আড়ালে আপনার অজ্ঞতা নিয়ে পাল্টা হাসলে কি রাগ হয়? নিজেকে সে সব প্রশ্ন করতে বাধ্য করে দেবলীনার ছবি।
বহু দিনের প্রেমিকা সুচন্দ্রাকে বৈদিক মতে বিয়ে করে সুখের সংসার শ্রীর। দেবলীনার তথ্যচিত্রে নিজেদের সংসার-ভাবনা নিয়ে অকপটে অনেক কথা বলেছেন তাঁরা। তবে সেই বিয়ে নিয়ে যে কম হাসাহাসি হয়নি, তা জানেন। সেই হাসিকে কী ভাবে দেখেন তিনি?
আহ্লাদে হাসার সময় এখনও আসেনি এ দেশে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিল হয়েছে বটে। তবে বিয়ের আর্জি আবারও বাতিল হয়েছে। সমাজে পরিবর্তন আসছে খুবই ধীর গতিতে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্টকেই শুধু ‘স্বাভাবিক’ মনে করা সমাজ এখনও সমকামিতাকে সহজ ভাবে দেখে না। সমকামী বলে পরিচয় দিলে এখনও হাসি পায় তাঁদের। সমকামী বিয়ে তো অনেক দূর। ফলে শ্রী বলেন, ‘‘আমি কারও জীবন নিয়েই হাসতে পারি না। নিজেরটা নিয়েও নয়। এত সহজ নয় সবটা।’’ আইন তো এখনও স্বীকৃতিই দিতে পারেনি তাঁদের বিয়েকে। এখনও হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে শ্রীকে ভাবতে হয় স্ত্রী সুচন্দ্রা সই করার অধিকার পাবেন কি না সেই কাজগপত্রে। না হলে কে করবে? কেউ আছে কি পাশে? না, প্রেমের সম্পর্ক রাখতে গেলে বাকি সব সম্পর্কই ছাড়তে হয় বেশির ভাগ সমকামীকে। তাঁদেরও হয়েছে।
যে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ঠাট্টার শেষ নেই, তার মধ্যে ঢুকতেই বা চান কেন বাকিরা? তথ্যচিত্রে সেই প্রশ্ন নিজেরাও নিজেদের কাছে রাখলেন তাঁরা। দেবলীনার ছবি দেখিয়েছে, এই প্রশ্ন সমকামীদের মধ্যে ততটাই ঘুরপাক খায়, যতটা চলে অন্যদের মধ্যে। তবে এর উত্তরও মেলে তাঁদের থেকেই। ‘‘আইন মেনে বিয়ে করব কি করব না, তা পরের ব্যাপার। আগে বাকিদের মতো মেনুতে বিয়েটা তো চাই। যাতে আমরাও বেছে নিতে পারি নিজেদের পথ,’’ বললেন শ্রী। সে দিন দেখার আগে আরও কতটা পথ পেরোতে হবে? প্রশ্ন রাখল তথ্যচিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy