ট্রোলিং কতটা ক্ষতিকর? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
ইদানীং আমাদের জীবনটাই যেন চলছে সমাজমাধ্যমকে ঘিরে। ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত, সব সময় আমাদের নজর থাকছে মুঠোফোনে বন্দি ওই সমাজমাধ্যমের পাতায়। কোনও এক জনের ভিডিয়ো দেখে সামান্য হাসি পেলেই চট করে একটা খারাপ মন্তব্য করে দিতে অনেকেই সময় নেন না। পর ক্ষণেই সেই বিষয় নিয়ে মিমও বানিয়ে ফেলেন কেউ কেউ। আপনার একটা খারাপ মন্তব্য দেখে হাজার হাজার লোক হাজার রকম তির্যক মন্তব্য শুরু করেন। তারকার কোনও কীর্তি দেখে হোক কিংবা সাধারণ মানুষের, ট্রোল করা কারও কারও কারও কাছে যেন স্বভাবে পরিণত হয়েছে। অনেকেই আছেন, যাঁরা অন্য নামে অ্যাকাউন্ট খোলেন কেবলমাত্র ট্রোল করার জন্য। কেউ ট্রোলারদের নিয়ে কোনও রকম খারাপ কথা বললে তাঁদের কষ্ট হয়। যাঁরা ট্রোল করেন, কেমন আছেন তাঁরা? ট্রোল করার প্রবণতা, ট্রোলারের মানসিকতা, এবং সেই মানসিকতা বদলের প্রয়োজন আছে কি না, সেই সব নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের ফেসবুক এবং ইউটিউব পেজে আলোচনায় বসলেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘কী করে বলব? সঙ্গে অনুত্তমা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ সপ্তাহের বিষয় ছিল, ‘ট্রোল করি’।
কেউ জেনেবুঝে ট্রোল করেন, কেউ আবার অজান্তেই ট্রোল করে বসেন। ট্রোলারদের মনেও চলে নানা রকম টানাপড়েন। প্রতি পর্বের আগেই অনুত্তমার কাছে প্রশ্ন পাঠানো যায়। বহু চিঠি এসে জমা হয় তাঁর কাছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জন লিখেছেন, “যে দিনগুলিতে আমার মনমেজাজ ভাল থাকে না আমি খেয়াল করে দেখেছি, সেই দিনগুলিতেই আমি ইন্টারনেটে ভীষণ তিক্ত আচরণ করে ফেলি। কেউ যদি আমার কোনও স্টেটাস দেখে লেখেন ‘পাশে আছি’, তখন তাঁকেও কটুকথা বলে ফেলি। আমার জীবন তো তাঁর পাশে থাকা বা না থাকার উপর নির্ভর করে না। সমাজমাধ্যমে কোনও প্রভাবশালী মানুষের সুন্দর জীবনের ঝলক দেখলে বিরক্তি আসে, তখন অনেক সময়ই নানা কটু মন্তব্য করি আমি। আমি কি তা হলে ট্রোলার হয়ে যাচ্ছি?”
নিজের অভিজ্ঞতা মনোবিদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন অশোক নাথ। তিনি লিখেছেন, “ছোট থেকেই কোনও কিছু ভাল না লাগলে স্পষ্ট সে কথা বলে দিই আমি। ফেসবুকে অনেককেই দেখি, জীবনের ভাল-মন্দ নিয়ে অনেকেই অনেক রকম কথা লেখেন। সেই সব দেখে আমার বিরক্তি লাগে। মনে হয়, এঁদের শিক্ষার এত অভাব কেন? আর তখনই মন্তব্য করে ফেলি। কখনওই নিজেক আটকাতে পারি না। মন্তব্য করার পরেও নজর থাকে সেই পোস্টের উপরেই। দেখি, আর কে কী বললেন আমার মন্তব্য ঘিরে। অনেক সময় অনেকে আমায় গালাগালও করেন। তবুও আমার মনে হয়, আমি যা করেছি ঠিক করেছি। আমার স্ত্রী এই আচরণে বিরক্ত হন খুবই। বন্ধুরাও কেউ কেউ আমায় এড়িয়ে চলে। সমাজমাধ্যমে তো সকলেই নিজের মনের কথা ভাগ করে নিতে পারেন। তাই বলে কি সব সময় ভাল কথাই বলতে হবে?”
এই চিঠি যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা সকলেই জানতে চেয়েছেন ঠিক কোন মন্তব্যটা আসলে ট্রোলিং। অনুত্তমা বললেন, ‘‘ট্রোলিংকে বলা হয়, এক ধরনের আন্তর্জালিক দূষণ। যেন অনলাইনে এক ধরনের দূষণ তৈরি করতেই আমরা ট্রোল করি। ট্রোলিংয়ের মাধ্যমে আমরা অন্যকে আক্রমণ করি, কখনও কখনও কাউকে তাতিয়ে দিই, কখনও আবার অন্যকে আহতও করে ফেলি। ইচ্ছাকৃত ভাবে আক্রমণাত্মক হওয়া, কাউকে আহত করা অথবা তাঁদের উত্তেজিত করে দেওয়া— এ সবের মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে থাকে ট্রোলিংয়ের মনন। অনেকেই কিন্তু বলছেন এই ট্রেন্ড বিপজ্জনক। আপনারা, যাঁরা চিঠি পাঠিয়েছেন তাঁরাও কিন্তু কোথাও না কোথাও ওই পথেই হাঁটছেন। আচ্ছা ভেবে দেখুন তো, যে দিনগুলোয় আপনার মন ভাল থাকছে না, সেই দিনগুলোতেই কি অন্যের ভাল আপনি মেনে নিতে পারছেন না? কোনও কারণে কি ঈর্ষা জাগছে মনে? কোথাও কি সমাজমাধ্যমে থাকার কারণে একটা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হয়ে যাচ্ছে? তারকাদের সঙ্গে নিজের জীবন তুলনা করার পর নিজেকে ক্ষুদ্র লাগছে? এই দিকগুলি কিন্তু একটু ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। সমাজমাধ্যম সারা ক্ষণ আমাদের মনের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি করে চলেছে। আপনার ভাল না থাকাটা কোথাও যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সমাজমাধ্যম। সেই থেকেই আপনার মনের মধ্যে তৈরি হচ্ছে রাগ। সমাজমাধ্যমে তো আমরা ব্যক্তিকে সরাসরি আক্রমণ করি না, ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের দূরত্ব থাকে যথেষ্ট, তাই আক্রমণ করা অনেক সহজ হয়ে ওঠে। অনেকেই আবার গুরুত্ব পাওয়ার জন্যেও ট্রোল করেন। গুরুত্ব পাওয়ার তাগিদে আমরা ভুলে যাচ্ছি, আদৌও এই গুরুত্ব প্রশংসার্হ, না কি নিন্দনীয়? তাই সমাজমাধ্যমে কোনও রকম মন্তব্য করার আগে একটু ভাববেন, আপনি ঠিক কী কারণে মন্তব্যটি করছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy