মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ ক’রি মনে হবে, শেষ হয়ে হইল না শেষ।’ রবিঠাকুরের লেখা কবিতার পঙক্তির মতোই পথ চলা অনিঃশেষ। নিছক মনের কথা শুনতে, আড্ডা দিতে, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে বছর দুই আগে আনন্দবাজার অনলাইনে শুরু হয়েছিল ‘লোকে কী বলবে’ এবং ‘কী করে বলব’ শীর্ষক অনুষ্ঠান। শুরুর দিন থেকে সঙ্গে ছিলেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশেষ পর্বগুলিতে অতিথিদের আসনও উজ্জ্বল হয়ে উঠত। মনের জটিলতা কাটিয়ে আলোর পথে উত্তরণের উদ্দেশ্য নিয়ে যে নটেগাছটি ডালপালা মেলেছিল, এ বার তার মুড়োনোর সময় এসেছে। এই সপ্তাহে ‘লোকে কী বলবে’ এবং 'কী করে বলব’র শেষ পর্বের প্রথম অধ্যায়ে আনন্দবাজার অনলাইনের ফেসবুক পেজে মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়, মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব ও আবির মুখোপাধ্যায় এবং মনোবিদ শ্রীময়ী তরফদার। আগামী সপ্তাহে এই অনুষ্ঠানের শেষ পর্বটি প্রকাশিত হবে।
প্রতিটি পর্বেই দর্শকরা নিজেদের মনের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকগুলিতে, গোপন কুঠুরিতে জমা হতে থাকা অভিমান, অভিযোগ, ব্যর্থতা, অধিকার নিয়ে মনোবিদের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন। নিজেদের প্রয়োজনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বহু মানুষও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দিয়েছেন। শেষ পর্বেও তার অন্যথা হয়নি। অগণিত চিঠি এসেছে মনোবিদের কাছে। প্রতি পর্বেই নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের উপর আলোচনা হত। তবে এই পর্বে বাঁধাধরা কোনও বিষয় রাখা হয়নি। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার খবরে অনেকেই বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের মনেই এই সমাপনও করুণ সুরে বেজেছে। এমনটাই জানিয়েছেন বেশির ভাগ দর্শক। প্রথম চিঠিটি পাঠিয়েছেন যাজ্ঞসেনী। তিনি লিখেছেন, “অনুত্তমাদি আমার কাছে আলোর দিশারী। তাই অনুষ্ঠান শেষ হবে শুনে মনখারাপ হচ্ছে। এই অনুষ্ঠান আমার অনেকটা জুড়ে ছিল। তাই শেষ পর্বের খবরে মনে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে মানিয়ে নেব কী করে?” যাজ্ঞসেনীর মতো অনেকেই লিখেছেন, তাঁরা যে কোনও ক্ষেত্রেই আকস্মিক বদলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। দীর্ঘ দিনের পুরনো গাছ কাটা পড়লে যতটা কষ্ট হয়, তাঁদের মনেও যে কোনও বিচ্ছেদে একই রকম বেদনা সঞ্চারিত হতে থাকে, বিধ্বস্ত লাগে। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তো এমন বদল আসে। এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার উপায় কী? এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব। তাঁর মতে, “এভরিথিং শ্যাল পাস। খারাপ সময়ও যেমন অতিবাহিত হয়ে যায়, ভাল সময়ও কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। এটাই জীবনের মূল কথা। কিন্তু আজ যা শেষ হয়ে গেল, সেই জায়গা দখল করবে নতুন কিছু। এই নতুন কিছুকে স্বাগত জানানোই আমাদের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। শুধু অনুষ্ঠান নয়, জীবন থেকে কিছু চলে যাওয়া আনন্দের নয়। কিন্তু যা চলে গেল, তা আঁকড়ে থাকাটাও কাজের কথা নয়।”
শীতের পরেই তো বসন্ত আসে। সব পাতা ঝরে যাওয়ার পরেও গাছ আবার নতুন করে ফুলে-ফলে ভরে ওঠে। মৃত্যু বা জরার পাশাপাশি পরিবর্তন, অনিশ্চয়তাও জীবনের চরম সত্য। এমনটাই মনে করেন মনোরোগ চিকিৎসক আবির মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, জীবনে অনিশ্চয়তারও কিন্তু ইতিবাচক দিক রয়েছে। এই প্রসঙ্গে মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, “শেষ হয়ে যাওয়ার যে শোক, তা গ্রহণ করার অনুমতি নিজেকেই দিতে হবে।”
অপ্রীতিকর কোনও ঘটনা বা পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে লাভ নেই। যে কোনও পরিস্থিতির সঙ্গে বাস করতে শিখিয়েছে এই অনুষ্ঠান। এমনটাই জানিয়েছেন ‘লোকে কী বলবে’ অনুষ্ঠানের আরও এক দর্শক। আবার, রক্তিমার চিঠিতে রয়েছে সম্পর্কে বিচ্ছেদের সুর। কাউকে মন থেকে ভালবাসলে কি এ ভাবেই কষ্ট পেতে হয়? সকলকেই কি এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়? ওষুধ খেয়েও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারছেন না তিনি।
মনোবিদ শ্রীময়ী তরফদারের মতে, পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে হবে। এ ছাড়া আর মুক্তির উপায় নেই। জীবনের নানা দিক আছে। কোনও একটা সম্পর্ক, না পাওয়া নিয়ে সারা ক্ষণ কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকাই সমাধান নয়। জীবনের আরও অনেক দিক রয়েছে। সেই সব দিকে নজর দিলে বিচ্ছেদের কষ্ট খানিকটা লাঘব করা যায়। অর্থাৎ ‘ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে, অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে’— এই বিশ্বাস নিয়েই ভাল থাকার চেষ্টা করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy