ত্বকের অংশগুলি পুরু হয়ে আঁশ ওঠার মতো খোসা উঠতে শুরু করে। ছবি: শাটারস্টক
কোভিড ১৯ ভাইরাসের দাপটে সোরিয়াসিস নামক ত্বকের অসুখের কিছুই যায় আসেনি। বরং করোনার ভয়ে ফলো আপ চিকিৎসায় বাধা পড়ায় রোগের দাপট বেড়েছে। সোরিয়াসিস নামের সঙ্গে পরিচয় কম থাকলেও ত্বকের এই অসুখ নিয়ে ভুগছেন এমন মানুষের সংখ্যা কিন্তু মোটেও কম নয়। সংখ্যার বিচারে ত্বকের এই ক্রনিক অসুখ নভেল করোনা ভাইরাসের থেকে অনেক এগিয়ে।
বিশ্বের ১২৫ মিলিয়ন মানুষ এই ত্বকের সমস্যা নিয়ে জেরবার। মোট জনসংখ্যার ২–৩% ত্বকের ক্রনিক সমস্যা সোরিয়াসিসে আক্রান্ত, বললেন ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর পেডিয়াট্রিক ডার্মাটোলজির প্রেসিডেন্ট ত্বক বিশেষজ্ঞ সন্দীপন ধর। বিশ্বের বিশাল সংখ্যক মানুষ সোরিয়াসিসে আক্রান্ত হলেও রোগটা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা অত্যন্ত কম।
আমেরিকার ন্যাশনাল সোরিয়াসিস ফাউন্ডেশন ১৯৯৭ সালে ওদেশের মানুষকে ত্বকের এই ক্রনিক রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে সোরিয়াসিস নিয়ে প্রচার চালানো শুরু করে অগস্ট মাস জুড়ে। এর পর বিশ্ব জুড়ে এ রোগের সচেতনতা বাড়াতে অগস্ট মাসকে 'আন্তর্জাতিক সোরিয়াসিস মাস' হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বললেন সন্দীপন বাবু।
আরও পড়ুন: নিয়ন্ত্রিত ভাবে ব্যবহারে ছাড়, করোনা রুখতে পারবে ত্বকের অসুখের এই ওষুধ?
অসুখটা ঠিক কী জানতে গেলে ত্বকের গঠন সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। আমাদের ত্বকের প্রধানত দু'টি স্তর, এপিডার্মিস বা বহিঃত্বক আর ডার্মিস বা অন্তঃত্বক। এপিডার্মিস অংশের একদম উপরের অংশে কেরাটিন নামের মৃত কোষ থাকে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর আমাদের অগোচরে কেরাটিন খসে যায়। এর তলায় থাকা সজীব কোষগুলি উপরে উঠে আসে, সময় হলে আবার তারা খসে যায়। আজীবন চক্রাকারে এই পদ্ধতি চলতে থাকে। সন্দীপনবাবু জানালেন, ত্বক-বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে এপিডার্মিস টার্নওভার। নিরন্তর চলা এই প্রক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা হলেই সোরিয়াসিস হয়।
স্বাভাবিক অবস্থায় এপিডার্মিস টার্নওভারের সময় লাগে ২৮ দিন। অর্থাৎ ২৮ দিন পর পর বহিঃত্বকের আয়ু শেষ হয়ে যায়। কিন্তু যখন ৩–৪ দিনের মাথায় এপিডার্মিস টার্নওভার হয়, তখনই সমস্যার সূত্রপাত শুরু। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে ছাল ওঠতে শুরু করে। তবে নিঃশব্দে ছাল ওঠা নয়, ভয়ঙ্কর চুলকানি, র্যাশ, ব্যথা, চুলকে সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয়ে ঘা হয়ে যাওয়া এসবের ঝুঁকি খুবই বেশি। সন্দীপন ধর জানালেন এই অবস্থার নামই সোরিয়াসিস।
আরও পড়ুন: কেউ উপসর্গহীন বাহক, কেউ করোনা সংক্রমিত, ভাইরাসের আচরণ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কেমন
ত্বকের ক্রনিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ সোরিয়াসিস সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখনও বিশ বাঁও জলে। কারণ জানা নেই বলে এই ক্রনিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজের সুনির্দিষ্ট ওষুধ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে রোগের লক্ষ্মণ অনুযায়ী কিছু বিশেষ ধরনের স্টেরয়েড ওষুধের সাহায্যে রোগ আটকে রাখা যায়। স্কিনের সমস্যা হলেই সবাই ছোঁয়াচ বাচিয়ে চলার চেষ্টা করেন। সোরিয়াসিস বংশগত হলেও মোটেও ছোঁয়াচে নয়, বললেন ডার্মাটোপ্যাথলজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শুভ্রা ধর। ক্লিনিক্যাল আই দিয়ে বিচার করে পারিবারিক ইতিহাস জেনে প্রয়োজনে স্কিন বায়োপ্সি করে সোরিয়াসিস রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়, বললেন শুভ্রা দেবী। বায়োপ্সির কথা শুনে ক্যানসারের আশঙ্কা করার কোনও কারণ নেই বলে ভরসাও দিলেন শুভ্রা দেবী।
সোরিয়াসিস বংশগত হলেও মোটেও ছোঁয়াচে নয়। ছবি: শাটারস্টক
সোরিয়াসিসের উপসর্গ হিসেবে শুরুতে বুকে পিঠে হাতে ও শরীরের বিভিন্ন অংশে লালচে র্যাশ দেখা দেয়। এর পর ধাপে ধাপে নানা সমস্যার সূত্রপাত হয়। ত্বকের ওই অংশগুলি পুরু হয়ে আঁশ ওঠার মতো ত্বকের খোসা উঠতে শুরু করে। শুরুতে চিকিৎসা না করলে শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। সন্দীপনবাবু বললেন, মাথায় বাড়াবাড়ি রকমের খুসকি অনেক সময় সোরিয়াসিসের জন্যেও হতে পারে। তাই অতিরিক্ত খুসকি হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত বলে পরামর্শ দিলেন সন্দীপনবাবু ও শুভ্রা দেবী। অনেক সময় নখেও সোরিয়াসিস হয়। শুরুতে চিকিৎসা না করালে নখে গর্ত হয়ে যায়, নখ উঠে আসে। মাথায় বাড়াবাড়ি রকমের সোরিয়াসিস হলে মাথার সব চুল ঝরে গিয়ে টাক পরার ঝুঁকি থাকে। নিজে ইচ্ছে মতো ওষুধ খেলে নানা বিপদের সম্ভাবনা থাকে। বাড়লে শরীরের নানা অস্থিসন্ধি আক্রান্ত হয়। ত্বকের অসুবিধা ছাড়াও অস্থিসন্ধি বা গাঁটে ব্যথা, হাত-পায়ের আঙুলে ব্যথা হয়।
আরও পড়ুন: মানসিক চাপে কমছে রোগপ্রতিরোধ শক্তি, কী করবেন, কী করবেন না
১০–৩৫% সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ৩০–৪০ বছর বয়সে সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি থাকে। শুষ্ক ত্বক সোরিয়াসিসের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। তাই ইমোলিয়েন্ট জাতীয় লোশন, নারকেল তেল বা ময়েশ্চারাইজারের সাহায্যে ত্বকের শুষ্কতা প্রতিরোধ না করলে রোগ ভয়ানক বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। অনেক সময় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সোরিয়াসিসের লক্ষণ বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন: শরীর অচল থেকে পক্ষাঘাত, করোনার দোসর কি এ বার গুলেনবারি সিনড্রোম? কী বলছেন চিকিৎসকেরা
মানসিক চাপ, মদ্যপান, স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া, অতিরিক্ত রোদ রোগটা বাড়িয়ে দেয়। ত্বকে ডাইভোনেক্স জাতীয় স্টেরয়েড মলম লাগানোর পাশাপাশি খাবার ওষুধ হিসেবে সোরালেন, মেথাট্রিক্সেট, রেটিনয়েড, সাইক্লোস্পোরিন-- সবই দেওয়া হয়। তবে এসবই হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রক্ত পরীক্ষা করে। সম্প্রতি মেটাবলিক সিনড্রোমের সঙ্গে সোরিয়াসিসের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। যাঁদের ডায়াবিটিস, হাইপারটেনশন, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল, হার্টের অসুখ আছে এবং কোমরের মাপ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি তাঁদের সোরিয়াসিসের ঝুঁকি অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক সোরিয়াসিস মাসে আরও একবার সচেতন হন। নিয়মিত শরীরচর্চা করে ওজন ও কোমরের মাপ স্বাভাবিক রাখুন। ক্রনিক এই ত্বকের অসুখের সঙ্গে লড়াই করে ভাল থাকুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy