ঘটনা ১
মধ্যরাত, টালমাটাল বাইপাস ধরে হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। চার তরুণ, ঈষৎ মত্ত। গাড়ি আস্তে চালানোর কথা উঠতেই চালকের আসনে বসা তরুণ বলে উঠল— চাপ নিস না, কিছু হলে বাবা সামলে নেবে।
ঘটনা ২
সমাজে প্রতিষ্ঠিত বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রায় সমস্ত পার্টি-ইভেন্টেই যায় মেয়ে। আলাদা করে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শিখেছে কিশোরীবেলার শুরু থেকেই। তার প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন ব্যবহার ও যাপনে। উন্নাসিকতায় চার পাশের বেশির ভাগ মানুষকেই নস্যাৎ করে চলে সে। পাপা-মাম্মার ‘প্রিন্সেস’ সে, সমাজ-টমাজ নিয়ে বেশি না মাথা ঘামালেও চলবে তার।
যুগে যুগে কালে কালে ধনী ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত বাবা-মায়ের সন্তানদের রয়েছে নিশ্চিন্তির রেওয়াজ, সেই সঙ্গে সূক্ষ্ম অধিকারবোধ। পৃথিবীতে যা-ই ঘটে যাক না কেন, সন্তান জানে তার নিরাপত্তার ঘেরাটোপ তথা ‘কুশনে’ আঁচ পর্যন্ত লাগবে না। যে জ্ঞান তাকে লাইসেন্স দেয় বেপরোয়া, ‘এনটাইটেলড’ যাপনের। ফল — দায়িত্ব এবং অনুভূতির স্থানে আসে ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন তথা সঙ্গে সঙ্গে পেতে চাওয়া আনন্দের লোভ। বেড়ে ওঠার ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে যায়।
এই প্রসঙ্গেই বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম জানালেন, সন্তানের এমন ভাবনা আসা এবং না আসার পিছনে প্রাথমিক ভাবে দায়িত্ব কিন্তু বাবা-মায়েরই। প্রথমেই সন্তানকে বোঝাতে হবে, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-অর্থ-প্রতিপত্তি এগুলো সহজে পাওয়া যায় না। অর্জন করতে হয়। তার জন্য পরিকল্পনা ও পরিশ্রম থাকে। একই সুর শোনা গেল পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের কথায়। তিনি জানান, সন্তানের চাইলেই পেয়ে যাওয়া ও সেটিকে মূল্য না দেওয়ার প্রবণতা যাতে না হয় সেই জন্য ছোট থেকেই দায়িত্ব নিতে হবে বাবা-মাকে। তৈরি করতে হবে প্রয়োজনীয় একটি পেরেন্টিং ফ্রেমওয়ার্ক।
বলা চলে, ধনী, সমাজে প্রতিষ্ঠিত বা সেলেব্রিটিদের সন্তানদের জীবন শুরু হয় একটা বুদ্বুদের মধ্য দিয়ে। পুরনো দিনের মানুষেরা একটা কথা ব্যবহার করতেন, ‘নজর উঁচু হয়ে যাওয়া’। অতিরিক্ত অর্থব্যয়, বাবা-মায়ের ভুল ধরনের মনোযোগ এবং মাটিতে পা রেখে চলার অভ্যাস না থাকায় একটা সময়ের পরে গিয়ে জীবনের অর্থ ফুরিয়ে যায় বহু ছেলেমেয়ের কাছে। সেই শূন্যতায় প্রবেশ করে নেশা, অতিরিক্ত অর্থব্যয়, ঔদ্ধত্য। সঙ্গত করে আশপাশের মানুষজনের প্রতি দুর্ব্যবহার। এই প্রসঙ্গেই একটা উদাহরণ দিলেন ডা. রাম, তাতে জানা গেল প্রতিপত্তিশালী বাবার একমাত্র ছেলে বাবার উপরে রাগ করে বহুমূল্য ঘড়ি দেওয়ালে আছড়ে ভেঙে ফেলেছে। তাই সন্তানকে গোড়া থেকে এটা বোঝানোও প্রয়োজন, টাকা-প্রতিপত্তির জোর দেখিয়ে দুর্ব্যবহার করলে এক সময়ে সে সকলের কাছে অপ্রিয় হয়ে যাবে।
তা হলে উপায়?
ছোট থেকেই সমাজ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে সন্তানকে। অর্থবলে পাওয়া সব সুযোগ-সুবিধা আদতে অনিত্য এবং বহু মানুষ এগুলো ছাড়াই বেঁচে রয়েছেন, সেই সত্যিটা যত দ্রুত সন্তান বোঝে তত উপকার। তার জন্য সাহায্য নিতে হবে সাহিত্য-চলচ্চিত্রের। বলা চলে, পাঠ দিতে হবে এমপ্যাথি তথা সহমর্মিতা ও সহানুভূতির। ডা. রামের মতে, কল্পনাশক্তির অভাবে সহমর্মিতা-সহানুভূতি বোধ গড়ে ওঠে না। তাই ছোট থেকেই সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে যতটা সম্ভব জল-সার দিতে হবে কল্পনাশক্তিতে। তবেই সন্তান পরিপূর্ণ জীবনের স্বাদ পাবে।
পায়েল ঘোষের মতে, প্রথমেই দরকার পরিবারের একটি স্বাভাবিক গঠনগত নিয়ম এবং সেটা আলোচনার মাধ্যমে চালু করতে হবে বাবা ও মা দু’জনকেই। এই নিয়মের মধ্যে থাকবে সন্তান চাইলেই কী কী দেওয়া হবে না। তার প্রতিদিনের যাতায়াত স্কুল বাসে হবে না গাড়িতে হবে সেই সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত। বাবা-মাকে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় যুক্তিগত ভাবে সিদ্ধান্তগুলি নিতে হবে। মাথায় রাখতে হবে চাইলেই ‘হ্যাঁ’ বলব না, সন্তানকে অর্জন করতে শেখাব।
এর পর আসবে সন্তানের সঙ্গে কথা বলা বা যোগাযোগ রাখার বিষয়টি। বাবা-মা যত ব্যস্তই থাকুন না কেন, নিয়ম করে দিনের মধ্যে দশটা মিনিটও সময় দিতে হবে সন্তানের সারা দিনের কাজের বা সে কোথায় কাদের সঙ্গে রয়েছে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য। তার প্রেক্ষিতে কোন কোন জায়গাগুলোয় সে গন্ডগোল করেছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে খুব ভাল করেছে তার একটা সহজ বিশ্লেষণ ও বার্তা থাকা দরকার সন্তানের কাছে। এ ছাড়া, ছোট থেকে সন্তানের মধ্যে যে ভাল দিকগুলি রয়েছে, সেগুলোর দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি শিশু যদি খুব সহমর্মী হয়, তার এই গুণটির যদি বার বার প্রশংসা করা হয়, তবে বস্তুতান্ত্রিক আকর্ষণ তার মধ্যে গড়ে উঠতে পারে না সহজে। নিজের সে গুণ বা গুণগুলির দিকেই নজর দিতে শুরু করে বাচ্চারা। পাশাপাশি, আমাদের চার পাশে অন্য মানুষেরা কী ভাবে থাকে, কী ভাবে যাপন করে তার সঙ্গে যদি বাচ্চাদের পরিচয় করানো যায় তবে সেই বিষয়টিও তাদের মাটিতে পা রেখে চলতে সাহায্য করে। সেলেব্রিটি সন্তানদের ক্ষেত্রে যদি ছোট থেকে সমাজসেবামূলক কাজে যোগ দেওয়ানো যায়, তা হলে মাটিতে পা দেওয়া সহজ হবে তাদের পক্ষে।
তৃতীয় বিষয়টি হল, সমাজে প্রতিপত্তিশালী বাবা-মায়ের জীবনে পার্টি, ইভেন্টস প্রভৃতি লেগেই থাকে। সন্তানকে প্রথমেই বোঝাতে হবে, এগুলো জীবন নয় জীবিকার অংশ। সে যেমন পেনসিল, পেন দিয়ে লেখাপড়া করে তেমনই বাবা-মাকে জীবিকার জন্য এগুলো করতে হয়। ফলে, শুরু থেকেই তার মধ্যে যাপন ও বিলাসের পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সুযোগ থাকলেও সে সব জায়গায় সন্তানকে কখনওই নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিত নয় বাবা-মায়ের। পাশাপাশি, সন্তান একটু বড় হলে যখন তাদের নিজেদের পার্টি, স্লিপওভার শুরু হবে তখন খেয়াল রাখতে হবে বাবা-মাকে। প্রয়োজন হলে সেই সব বন্ধুকে বাড়িতে ডেকে তাদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।
চতুর্থ, যে সব পরিবারে বাবা-মা অত্যধিক ব্যস্ত, সেখানে সন্তানেরা বাবা-মায়ের সান্নিধ্য পায় না বিশেষ। ফলে লেখাপড়ায় অযত্ন হলেও তা দেখার কেউ নেই। সুতরাং, এখানেও বাবা-মায়ের পদক্ষেপের প্রয়োজন। সপ্তাহে একটা দিনও যদি বাবা এবং মা সন্তানের সঙ্গে বসে তার লেখাপড়া কেমন চলছে, কী পড়ানো হচ্ছে, তার প্রিয় বিষয় কী, কোন বিষয়ে সে দুর্বল এই সংক্রান্ত আলোচনা করে তবে সন্তানের পড়ার প্রতি আগ্রহ ফিরে আসে। অন্তত, তার মাথায় এটা গেঁথে যায়, বাবা-মা শত ব্যস্ততাতেও তার লেখাপড়ার দিকে নজর রেখেছেন।
আর যাঁরা সন্তানের একটা বয়সের পরে খেয়াল করেছেন তার ঔদ্ধত্য তথা বয়ে যাওয়ার বিষয়টি, পথ রয়েছে তাঁদের জন্যও। প্রথমেই ‘সব শেষ হয়ে গেল’ বিষয়টি মাথা থেকে বার করে দিতে হবে। তার পর, বেশি করে সময় কাটাতে হবে সন্তানের সঙ্গে। প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নিতে হবে। এতে সহজ হয়ে উঠবে পারিবারিক জীবন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy