Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Covid-19

দিন যায়, রাত আসে, ডায়েরির পাতা ওল্টায় করোনা

মেয়ের গায়ে জ্বর... নাক দিয়ে জল ঝরছে... মাথাব্যথা, গলাতেও খানিক। ‘বাবা, আমার না শরীরটা খুব খারাপ লাগছে।’ কপালে হাত ছোঁয়াতেই ছ্যাঁক করে ওঠে!

যখন নিজেরাই এই করাল গ্রাসে আবদ্ধ হলাম, তখন দেখার চোখটাও যেন পাল্টে যেতে লাগল।

যখন নিজেরাই এই করাল গ্রাসে আবদ্ধ হলাম, তখন দেখার চোখটাও যেন পাল্টে যেতে লাগল।

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:৫৫
Share: Save:

‘মনে হয়, এই বিছানা ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না,

জঙ্গল পাহাড় নদী নিয়ে আসবো আমার বাগানে—’

শক্তি চাটুজ্যের পদ্যের এই লাইন দু’টো কেন যে এত বার মনে পড়ছে, কে জানে! জানলার বাইরের আকাশটা বদলে বদলে যায়। রং বদলায়... আলো পাল্টায়... ঠিক নাটকের এক একটা দৃশ্যের মতো! আর কুশীলবেরা? তারা প্রত্যেকেই তাদের মতো করে নামভূমিকায়...। জীবননাট্যে যেমনটা হয় আর কি। যেমন আমি, এই কোভিড-নাট্যের আমিও যে এক কুশীলব!

২০ সেপ্টেম্বর

মেয়ের গায়ে জ্বর... নাক দিয়ে জল ঝরছে... মাথাব্যথা, গলাতেও খানিক। ‘বাবা, আমার না শরীরটা খুব খারাপ লাগছে।’ কপালে হাত ছোঁয়াতেই বুকের ভেতরটাতেও কেমন ছ্যাঁক করে ওঠে! যা দিনকাল... চারদিকে করোনার থাবা। তার মধ্যেই বেরোতে হয় পেশাদারের দায়িত্ব পালনে। বিশেষজ্ঞদের সাবধানবাণী মেনে যাবতীয় সতর্কতা নেওয়া। বাইরে থেকে ফিরে একেবারে কপিবুক মেনে নিজে ‘স্যানিটাইজড’ হওয়া। কিন্তু এটা অন্য কিছু নয় তো? টেস্ট তো পরে, তাতে কী বেরোবে, সেটা আরও পরে। কিন্তু তার আগে কী হবে? বাড়ির সকলকে হাত নেড়ে হাসিমুখে মেয়ে ঘরবন্দি হয়ে গেল। আশ্বিনের ৩ তারিখ, তবু এ মাসে দুর্গাপুজো নয়।

বাড়ির সকলকে হাত নেড়ে হাসিমুখে মেয়ে ঘরবন্দি হয়ে গেল।

২৬ সেপ্টেম্বর

পুবের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় রোজ। কি মুশকিল, যত রাতেই শুই, রোজ ভোরে এক কাণ্ড! কিন্তু আজ সকালে বাইরে তাকাতেই জানলার বাইরের ফ্রেমটা কি রকম অচেনা লাগছে! কয়েক সেকেন্ড চুপ করে শুয়ে থাকার পরে উপলব্ধি করি, এ ঘরে রোজ শুই না, তাই বাইরের পৃথিবীর ফ্রেমটা কেমন অচেনা হয়ে গিয়েছে! এই ক’দিনে বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। পারিবারিক চিকিৎসকের পরামর্শে মেয়ের কোভিড টেস্ট করানো হয়েছিল, ২৬ তারিখ তা পজিটিভ এল। যাকে ছাড়া সে এক মুহূর্তও থাকে না, সেই ঠাকুমার জ্বর এসেছে গত কাল থেকে। হালকা সর্দি, নাক থেকে জল গড়াচ্ছে, খাবারে স্বাদও তেমন পাচ্ছে না! গতকাল,২৫ তারিখেমায়ের করোনা পরীক্ষার রিপোর্টও পজিটিভ এসেছে। অতএব, বাড়িতে অন্তরিনের সংখ্যা বাড়ল। মেয়ের ঠাকুমাও বন্দি হলেন নিজের ঘরে। আর বাড়ির বাকিরা? যারা তখনও সুস্থ, প্রোটোকল মেনে তারা তত দিনে বাড়ির বাইরে পা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। দু’টি ঘরে দু’জন বন্দি... আমাদের সংসারটাও গুটিয়ে ছোট হয়ে এসেছে... বাড়ির যাবতীয় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাহাড় হয়ে উঠেছে ছোট্ট জায়গায়। ঘরের মধ্যেই দড়ি টাঙিয়ে জামাকাপড় মেলার ব্যবস্থা করতে হয়েছে, কারণ বারান্দা আর ছাদে যাওয়া যাচ্ছে না। বারান্দা লাগোয়া ঘর বন্ধ। ছাদে আরও মানুষজন যান, তাঁদের সুরক্ষার কথাটাও ভাবতে হবে।

বাইরের পৃথিবীর ফ্রেমটা কেমন অচেনা হয়ে গিয়েছে!

এত দিন সংবাদ মাধ্যম জানিয়ে এসেছে, কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি চতুর্দিকে। সেই মার্চ মাস থেকে এত দি‌নে বেশ কিছু প্রিয়জনকে হারিয়েছি। বেশ কয়েক জনের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর এসেছে। কিন্তু যখন নিজেরাই এই করাল গ্রাসে আবদ্ধ হলাম, তখন দেখার চোখটাও যেন পাল্টে যেতে লাগল। চতুর্দিক থেকে বন্ধু, সহকর্মী আর আত্মীয়স্বজনদের ফোন। মা আর মেয়ের রিপোর্ট পজিটিভ হওয়ার পরেই এক ডাক্তার বন্ধু প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও বাড়ি এসে ওষুধ পৌঁছে দিল। ছেলেবেলার ইস্কুলের সেই বন্ধু যে দিন বাড়ির বাইরে ওষুধের প্যাকেট হাতে এসে দাঁড়াল... ঈশ্বরের দূত কে জানি না, কিন্তু ওকে দেখে শুধু বলতে পারলাম, ‘‘তুই নিজে এলি কেন, কাউকে দিয়ে পাঠাতে পারতিস তো!’’ উত্তরে ছেলেবেলার গালিগালাজ...। কলকাতার আর এক প্রান্তে থাকা দুই বন্ধু এক সকালে এসে পৌঁছল বড় ব্যাগে ওষুধপত্র, আরও একটি অক্সিমিটার, থার্মোমিটার, হেল্থ ড্রিঙ্কের প্যাকেট, বাড়ির রান্নাবান্না, সব্জি— আরও নানা জিনিসপত্র নিয়ে। এক দিন সকালে আর এক বন্ধুর ফোন, ‘‘মাছ, সব্জি ছাড়া আর কী কী নেব?’’ প্রবল বিস্মিত আমার প্রশ্ন, ‘‘তুই কোথায়?’’ ‘‘কেন, পাশের বাজারে!’’ থাকে দক্ষিণ কলকাতায়, সাত-সকালে এসে হাজির এ পাড়ায়! কিছু ক্ষণের মধ্যেই বাড়ির বাইরেটা নানা জিনিসের পাহাড়! এটিএম যাওয়া যাচ্ছে না? তাতে কী? এক প্রতিবেশী বললেন, যাঁরা টাকাপয়সা পাবেন তাঁর বাড়ি তাঁদের পাঠিয়ে দিতে। তিনি টাকা মিটিয়ে দেবেন। নগদ টাকার দরকার? সেই ছেলেবেলার বন্ধুরাই পাঠাল।কেন জানি না, গত ক’দিনে শুধু মনে হচ্ছে, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি!

আরও পড়ুন :সিল্কের মরসুম

৩০ সেপ্টেম্বর

চার দিকের চেনা পৃথিবীটা যেন আরও বদলে গেল! ২৫ তারিখ রিপোর্ট পজিটিভ আসার পরে গত কয়েক দিন গৃহচিকিৎসকের পরামর্শেই ওষুধ চলছিল মায়ের। কিন্তু আজ সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি আচমকাই ঘুরে গেল। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রাহু হু করে নামছে... সঙ্গে বাড়ছে ছটফটানি। যে গৃহচিকিৎসক গত কয়েক দিন ধরে আশ্বাস দিচ্ছিলেন, বাড়িতেই রেখে মায়ের চিকিৎসা সম্ভব, কারণ হাসপাতালে নিয়ে গেলে অন্য বিপত্তির আশঙ্কা থাকে, টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে সেই চিকিৎসকেরই ভয়ার্ত গলা ভেসে আসে, ‘‘মাসিমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। এখনই ভর্তি না করলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে।’’ এর পর শুরু অন্য এক যুদ্ধ। কোন হাসপাতালে বেড খালি তা দেখতে হবে। সাধারণ নয়, আইসিইউ-র বেড। কারণ চিকিৎসকের সুপারিশ তেমনই। আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বন্ধুরাও ফোন ঘোরাচ্ছে... ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাত গড়াচ্ছে গভীর রাতের দিকে। অবশেষে বাইপাসের ধারের এক হাসপাতালে একটি বেডের সন্ধান মিলল এক বন্ধুর চেষ্টায়। পাশাপাশি, আরও এক যুদ্ধ চলছিল তখন— অ্যাম্বুল্যান্স! যুদ্ধ, কারণ কোভিড আক্রান্তকে নিয়ে যাওয়ার মতো অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়া এ শহরে সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। রাত সাড়ে ১১টা। মায়ের শরীর দৃশ্যতই খারাপ হচ্ছে।শেষমেশ ৮ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে ৬ হাজার টাকার চুক্তিতেঅ্যাম্বুল্যান্স এসে পৌঁছল।চালক একা! আপাদমস্তক পিপিই কিট। আমার স্ত্রী বলল, ‘‘আপনি একা! হেল্পার কোথায়?’’ জবাব আসে,‘‘করোনা পেশেন্ট নিতে এত রাতে কে আসবে? কাকে ডাকব?সঙ্গে দাদা থাকবেন তো।’’ সত্যিই তো, কাকে ডাকব?করোনা রোগীকে সব জেনেশুনে নিয়ে যাবে কে? শুনশান রাস্তা... ঠাকুমাকে নিজের হাতে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে নাতনি কাঁদছে... বলছে, ‘‘ভেবো না, তুমি সেরে উঠবেই।’’ ক্ষীণ কণ্ঠে ঠাকুমাও বলছে, ‘‘ঠিক করে থাকবি, ওষুধ খাস। ভাল করে খাবি...।’’ স্ট্রেচার সিঁড়ির মোড় ঘোরে। এক দিকে চালক, অন্য দিকে আমি। হাসপাতালে পৌঁছে দেখি, ওই রাতেও আমার আর এক ডাক্তার বন্ধু তার প্রিয় ‘মাসি’র জন্য ইমার্জেন্সির বাইরে অপেক্ষায়। রাত পৌনে ৩টের সময় জোর করে তাকে বাড়ি পাঠালাম। কারণ, পর দিন সকাল ৭টায় তার একটা অপারেশন আছে!

সত্যিই তো, কাকে ডাকব? করোনা রোগীকে সব জেনেশুনে নিয়ে যাবে কে?

১৩ অক্টোবর

বাঁচাতে পারলাম না নিজেকে। ১০ তারিখ সামান্য জ্বর আর কাশির উপসর্গ নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। ভয়ঙ্কর দুর্বলতা। এতটাই যে বিছানা থেকে উঠে টেবিলে রাখা ওষুধ পর্যন্ত নিতে পারছি না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে শুয়েভেবেই যাচ্ছি যে ওষুধটা খেতে হবে।আতঙ্ক তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এক দিকে আইসিইউ-তে মায়ের লড়াই চলছে। ভর্তির পর থেকেই বেশির ভাগ সময় খারাপ,কখনও একটু ভাল। আর এক দিকে বাড়িতে আমার স্ত্রী একা সুস্থ। আমাদের দেখভালের জন্য ও প্রাণপণে নিজেকে বাঁচাতে চাইছে। সব পরিচারককেই ছুটি দেওয়া আছে সেই মার্চ থেকে।আমি আর মেয়েও বন্দি। ফলে যাবতীয় কাজ নিজের হাতে করতে হচ্ছে ওকে। আজ সকালে রিপোর্ট এল... মা আর মেয়ের দলে নাম লেখালাম।রাতে ভর্তি হলাম মায়েরই হাসপাতালে। না, কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বিবেকে সায় দেয়নি। অ্যাম্বুল্যান্সে একাই চললাম হাসপাতালে। পুজো আসছে। কলকাতা একটু একটু করে সেজে উঠছে। অ্যাম্বুল্যান্সের হুটার বেজেই চলেছে ই এম বাইপাসে...।

আরও পড়ুন : মোবাইল স্ক্রিনেই গ্লাস ঠেকিয়ে চেঁচিয়ে বলুন উল্লাস!​

২৮ অক্টোবর

পুরো পুজোটা হাসপাতালে কাটিয়ে প্রায় এক মাস পরে মা আজ বাড়ি ফিরল। আমি ফিরেছি কয়েকটা দিন আগে। মা জানেও না, মায়ের কেবিন থেকে মাত্র চারটে কেবিন আগে আমি ছিলাম। খুব ইচ্ছে করত, কিন্তু ডাক্তারদের কড়া নির্দেশ, আমি করোনামুক্ত নই, তাই দেখা করা যাবে না! আজ আমরা আবার সবাই বাড়িতে, হোক না আলাদা আলাদা ঘরে জীবনযাপন... এক বাড়িতেই তো!

এ দিনলিপি এখানেই শেষ। মধ্যবিত্তের রোজনামচা যেমন হয়... ওই বিছানায় শুয়ে আমার জানলা দিয়ে অনেকটা আকাশ দেখা যায়... কাছের লেকে ফেরার জন্য প্রতি সন্ধ্যায় দলবদ্ধ পাখিদের তাড়া... দূরে নির্দিষ্ট আকাশপথে বিমান নামে মাথাটা একটু নিচু করে... দূরের বাড়ির কার্নিশ বেয়ে দুষ্টু বেড়ালটা রোজ দুপুরে ছাদে ওঠে...।

‘মনে হয়, এই বিছানা ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না...’।

অন্য বিষয়গুলি:

COVID-19 coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy