গুরুদ্বারের মালাই চা খেয়ে প্রাণ ফিরে পেয়েছে সতনাম। নিজস্ব চিত্র।
হাসপাতালের খাতায় সতওয়ারি সিংহ। পাঁচ বছর সে নামেই ডাকা হয়েছে তাঁকে। সম্প্রতি ছাড়া পেয়েছেন। সুযোগ পেয়ে জানানোর চেষ্টা করছেন সতওয়ারি নন, সতনাম তিনি। কিন্তু ওইটুকুই। বাড়ি কোথায়, কার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ফিরতে পারবেন নিজের গ্রামে— সে সবের কিছুই মনে নেই। তাই বলে কি বাড়ি ফিরবেন না? তা তো হয় না। উদ্যোগী হয়েছেন মনোসমাজকর্মী। সতনামের বাড়ির খোঁজের চেষ্টায় পাশে পেয়েছেন দক্ষিণ কলকাতার এক গুরুদ্বারের সদস্যদেরও।
পুলিশ এসে লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিল। সেই থেকে প্রায় কারও সঙ্গে কথাই বলতে পারছিলেন না। ইচ্ছা ছিল না বলে নয়। ভাষায় মিল নেই যে! আশপাশে সকলে বাংলায় কথা বলেন। আর সতনামের ভাষা পঞ্জাবি মেশানো হিন্দি। ফলে কাউকেই নিজের কথা বোঝানো সম্ভব হয়নি। ছাড়া পেয়েছেন হাসপাতাল থেকে। মানসিক রোগ থেকে সেরে ওঠার পর নিজের জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য রোগীদের সাহায্য করে ‘প্রত্যয়’। বন্ডেল গেট এলাকায় সেই বাড়িতেই গত পনেরো দিন ধরে রয়েছেন সতনাম। তবে সমস্যা কাটেনি। কাউকেই নিজের কথা বোঝাতে পারেন না তিনি। বাধা সেই ভাষা। ফলে যেন দূরে দূরেই থাকেন। পরিস্থিতি বুঝে সমস্যার সমাধান করতে উদ্যোগী হন মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। সতনামকে নিয়ে যান রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের গুরুদ্বার শ্রী গুরু সিংহ সভায়। সেখানে যেতেই যেন ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পেলেন সতনাম। এত বছর পর পেলেন এমন কয়েক জনকে, যাঁরা তাঁর কথা বোঝেন। তাঁর দেশের কথা জানেন। তাঁর পছন্দের চা খান। বাঙালিদের ‘ফিকা’ চায়ের বদলে এত দিন পর তাঁকে দেওয়া হয়েছে মালাই দেওয়া চা। তা খেয়ে ঢেকুর তুলে তবে বলতে শুরু করেছেন এককালে চাষ করতেন, পরে লরি চালিয়েছেন। মা, বাবা, স্ত্রী মারা গিয়েছেন। এক দিন ভুল ট্রেনে চেপে কলকাতা পৌঁছন। তার পরেই সাদা পোশাকের পুলিশ নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে। এত কথা মনে করতেও যে পারছিলেন না এত দিন।
সোমবার সতনামের সঙ্গে গুরুদ্বারে গিয়েছিলেন রত্নাবলীও। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি জানালেন, গুরুদ্বারে তো এমন আবদার নিয়ে বেশি কেউ যান না, তাই ওঁদের বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। কিন্তু তার পর সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন গুরুদ্বারের অনেকেই। বিষয়টি বোঝা মাত্র সতনামের বাড়ির খোঁজ শুরু করে দেন গুরুদ্বারের প্রেসিডেন্ট হরপ্রীত সিংহ।
এক দিনেই কাজ এগিয়েছে অনেকটা। অনেক গল্প করে সতনামের পাড়ার গুরুদ্বারের নাম জানতে পেরেছিলেন হরপ্রীতরা। তার পরেই খোঁজ শুরু হয় গুরুদ্বার শহিদ বাবা দীপ সিংহজির। জানা গিয়েছে অমৃতসরের কাছেই সতনামের গ্রাম। নাম কিডওয়া। ‘প্রত্যয়’-এর প্রোজেক্ট ম্যানেজার অভিজিৎ রায় বলেন, ‘‘সতনামের সঙ্গে কথা বলায় ভাষা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখানে এসে অনেকটাই কাজ হল। এক দিনেই বেশ খানিকটা কাজ এগিয়েছে। আর কিছু দিনের মধ্যে আশা করা যায় বাড়ির খোঁজ পাওয়া যাবে।’’
ইতিমধ্যে বাঙালিদের শাক-ভাত-ডাল খেয়ে মুখ পচে যেতে বসেছে সতনামের। রুটি দিলেও মুখে রোচে না। পঞ্জাবের রুটির সেই স্বাদ কোথায়! তাঁকে সাহায্যে হাত বাড়িয়েছে গুরুদ্বার। হরপ্রীত আমন্ত্রণ দিয়েই রেখেছেন সতনামকে। প্রত্যয় থেকে যে কোনও দিন তাঁকে গুরুদ্বারে পাঠিয়ে দিলেই মিলবে মোটা মোটা রুটি, পছন্দের ডাল, হালুয়া। বাড়ি ফেরার আগে কিছুটা মন ভাল হবে সতনামের। রত্নাবলী জানান, সে নিমন্ত্রণ হয়তো রক্ষা করতে পারবেন না সতনাম। প্রত্যয়ের আর সকল আবাসিকের মতোই যে চলতে হবে তাঁকে। নিয়ম ভাঙা যাবে না তাঁর জন্য। কিন্তু হরপ্রীতদের ভালবাসা, উৎসাহ মন ছুঁয়ে গিয়েছে তাঁদের সকলেরই। এ বার অন্তত কোনও দিশা পাওয়া যাবে বলেন মনে হচ্ছে ওঁদের।
গুরুদ্বার থেকে ফিরে যেন প্রাণ পেয়েছেন সতনাম। অভিজিৎ জানান, গুরুদ্বার থেকে বেরোনোর সময়ে সতনামকে সর্দারের মতো বুক ফুলিয়ে বাঁচার কথা বলেছেন হরপ্রীত। তাঁর মতো সর্দার মুখ ঝুলিয়ে থাকলে মানায় না যে। আর ‘প্রত্যয়’-এ ফিরে এসে তিনিও যেন খানিক সে বাক্য মেনেই চলছেন। সোমবার রাতে অন্য দিনের তুলনায় ফুরফুরে ভাব দেখা গিয়েছে সতনামের আচরণে। বুক চিতিয়ে রাতের রুটি খেতে ঢুকেছেন বাঙালিদের সঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy