হেঁশেল কি এখন পুরুষের দখলে? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
‘গল্প হলেও সত্যি’-র ধনঞ্জয়কে মনে আছে? রবি ঘোষ অভিনীত এই চরিত্রটি সহজে ভোলার নয়। ঝাল, ঝোল, ডালনা, কালিয়া, মুগের ডাল নারকেল দিয়ে, অড়হড় ডাল হিং দিয়ে, চালতা দিয়ে মটর ডাল রান্না যার বাঁ হাতের ব্যাপার। আলুবোখরার চাটনি থেকে পাঁঠা চচ্চড়ি— হরেক রান্নার নাম যার ঠোঁটের আগায় লেগে থাকে। হেঁশেলের চাবিকাঠি যাদের আঁচলে বাঁধা থাকে, সিনেমার পর্দায় পুরুষ পাচকের এমন দাপট দেখে তো সেই গিন্নিরা রীতিমতো ভিরমি খেয়েছিল। তবে ওই পর্যন্তই। সেই ধনঞ্জয় যে বাড়িতে কাজ করত, সে বাড়ির পুরুষ সদস্যদের কথা মনে করে দেখুন। এক জনও জলটুকু পর্যন্ত গড়িয়ে খেত না। আগে পুরুষ পাচক থাকত বটে। কিন্তু নিজের ঘরের রান্নায় বাড়ির ছেলেদের হাত দিতে দেখা যেত না। এখন সময় বদলেছে। বাবার বিরিয়ানি, বরের হাতের পাস্তা, ছেলের তৈরি কেক— ঘরে ঘরে রীতিমতো ‘ট্রেন্ডিং’।
হেঁশেল শুধু মেয়েদের ব্যক্তিগত আস্তানা আর নেই বললেই চলে। ছেলেদেরও অবাধ যাতায়াত সেখানে। গিন্নিকে খুশি করতে হোক কিংবা শখে— হেঁশেলে আনাগোনা বাড়ছে পুরুষের। অফিস থেকে ফিরে কিছু খেতে ইচ্ছা হলে নিজেই বানিয়ে নিচ্ছেন। কিংবা ছুটির দিনে বাড়িতে বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় বিশেষ কোনও পদ বানিয়ে চমকে দিচ্ছেন সকলকে। অনেকে তো আবার ইউটিউব দেখে রান্না শেখেন। কেউ আবার বইমেলায় গিয়ে খোঁজেন দেশ-বিদেশের রান্নার বই। সেই বই দেখেই চলে রান্নাবান্না।
ইদানীং পুরুষের সঙ্গে হেঁশেলের সম্পর্ক এ ভাবেই নিবিড় হয়েছে। সকলের বাড়ির পরিবেশ আগেকার মতো আর নেই। বহু বাড়িতেই জিরে, কালোজিরে, হলুদের কৌটোর ঠিকানা এখন জানেন পুরুষ সদস্যেরা। বাড়িতে স্ত্রী কিংবা মা কেউ না থাকলে দিব্যি রেঁধেবেড়ে খেতে পারেন। কাজ চালানোর মতো ডাল, ভাত, ডিম সেদ্ধ শুধু নয়, রীতিমতো পঞ্চব্যঞ্জন রাঁধেন। ইচ্ছা হলেও লুচি বানিয়ে নেন মাঝেমধ্যে। রান্না নিয়ে পুরুষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অন্য মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। মন এবং মশলা দিয়ে রান্না করা খাবারের গন্ধে ম ম করে গোটা বাড়ি। আর হেঁশেলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গিন্নি অবাক হয়ে দেখেন নতুন প্রতিভার স্ফূরণ। কখনও তো আবার উলটপুরাণ হয়। ব্যাগ ভর্তি বাজার করে বাড়ি ফিরেছেন গিন্নি। আর রান্নার দায়িত্ব কর্তার। ঝোল, ঝাল থেকে অম্বল— সব ধরনের রান্না দিব্যি বানিয়ে ফেলতে পারেন।
অর্থনীতিতে নোবেল-জয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় তো রান্না নিয়ে গোটা একটা বই-ই লিখে ফেললেন। বইয়ের নাম ‘কুকিং টু সেভ ইয়োর লাইভ’। অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেন, আবার হাতা-খুন্তিও ধরেন। হাতের সামনে উপকরণ যা-ই থাক, গবেষক ঠিক একটা নতুন কোনও পদ রেঁধে ফেলতে পারেন। রান্নার জন্য জমকালো পূর্বপ্রস্তুতি তাঁর দরকার পড়ে না। কালোজিরে দিয়ে মাছের পাতলা ঝোল-ভাত থেকে মোচার ঘণ্ট, মিশিগানের কেক থেকে ইরানের খাবার— চোখের নিমেষে রেঁধে ফেলেন। রান্নার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এমনই সহজ-সরল। রান্না নিয়ে তাঁর লেখনীতেও সেই সারল্য ফুটে উঠেছে। আগে কিন্তু তেমনটা বিশেষ দেখা যেত না। গুণী নারীরা রান্নার বই লিখলেও পুরুষদের ছিল শুধুই জিভের কাজ।
বলিপাড়ায় খুঁজলে এখন রন্ধনপটু নায়ক পাওয়া যাবে। অজয় দেবগণের কথাই ধরা যাক না। পর্দায় অ্যাকশন দৃশ্য যে হাত দিয়ে খলনায়কের রক্ত ঝরান, আবার সেই হাত দিয়েই রাঁধেন সুস্বাদু সব পদ। স্বামীর এই প্রতিভা নিয়ে গর্বিত কাজলও। অজয়ের হাতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পদ খিচুড়ি। অজয়ের হাতের খিচুড়ির স্বাদ নাকি সহজে ভোলার নয়। তবে কোন জাদুবলে অজয় সুস্বাদু রাঁধেন, সে রহস্য এখনও উদ্ঘাটন করতে পারেননি কাজল। কারণ অজয় নাকি হেঁশেলে ঢুকেই দরজা দিয়ে দেন। রেসিপি গোপনে রাখতেই পছন্দ করেন নায়ক।
হেঁশেলে মেয়েদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য চলে আসছে বহু দিন থেকেই। এই জায়গায় পুরুষের যাতায়াত অবাধ ছিল না। কালেভদ্রে হয়তো হেঁশেলের চৌকাঠ পেরোতেন। তবে রান্না করার জন্য নয়। দিন বদলেছে। রান্নাঘরের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন দু’জনেই। সকালের রান্নার দায়িত্ব গিন্নির হলে, অফিস থেকে ফিরে রাতের খাবার চটপট বানিয়ে ফেলেন কর্তা। তা-ও আবার গিন্নির সাহায্য ছাড়া। শুধু বাড়িতেই বা কেন, এই রান্নাঘরের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে টেলিভিশনে রান্নার শো শুরু করেছেন তারকা দম্পতি ঋধিমা ঘোষ এবং গৌরব চক্রবর্তী। রান্নাঘরের খুঁটিনাটি একসঙ্গে বুঝে নিচ্ছেন দু’জনে। তবে রান্না কি মনখারাপের দাওয়াই হতে পারে? আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল গৌরবের কাছে। অভিনেতা বলেন, ‘‘ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে বসে টেলিভিশনে রান্নার অনুষ্ঠান দেখতাম। কী ভাবে রান্না করছে, সেটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে, কেমন খেতে হবে সেই স্বাদও কল্পনা করতাম। এই বিষয়টি খুব মন ভাল করা একটা অনুভূতি। রান্নার অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সেই ভাল লাগার জায়গা থেকেই। রান্না ভীষণ ভাবে থেরাপিউটিক তো বটেই। ক্লান্তি কমায়, মন ভাল রাখে। নিজে রান্না করতে পারি কাজ চালানোর মতো। তবে রান্নায় পাকাপোক্ত হয়ে উঠতে সময় লাগবে কিছুটা।’’
রান্না, তুমি কি কেবলই শিল্প?
লকডাউনে বাড়ি বসে সময় কাটানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল রকমারি রান্না। সেই সময়ে রান্না বা রান্নাঘরের একচেটিয়া তকমা আর শুধু মেয়েদের ছিল না। ছেলেরাও নিজের হাতে রান্না করা খাবারের ছবি নিয়ম করে পোস্ট করতেন সমাজমাধ্যমে। ডালগোনা কফি থেকে মাশরুম পিৎজ়া— নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অবসর যাপনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল রান্না। মেয়েদের হেঁশেল সামলানোর বিষয়টি জলভাত হলেও, ছেলেরা রান্নাঘরে পা রাখা মানেই আলাদা চর্চা। পুরুষ রান্নাঘরে যাবে শেফ হয়ে— এই ভাবনায় যতটা স্বস্তি আছে, রোজের ঝোল-ভাত রান্নায় পুরুষের অংশগ্রহণ মেনে নেওয়া, এখনও খুব একটা সহজ নয়। রান্না মেয়েদের দৈনন্দিন জীবনের দায়িত্ব হলেও ছেলেদের রান্না সেখানে শিল্পের তকমা পায়। তবে সঞ্জীব কপূর বা রণবীর ব্রারের মতো মানুষেরা এই ভাবনার বাইরে। কারণ, তাঁরা পেশাগত ভাবে রান্নার কাজে যুক্ত। তা নতুন কথা নয়। ঘরের রান্নায় পুরুষ হাত এখনও তুলনায় নতুন।
রান্না মানসিক আনন্দ দেয় এটা ঠিক। শুধুমাত্র রাঁধতে ভালবাসেন বলে, প্রণালী না জেনেও আত্মবিশ্বাসে ভর করে খুন্তি নাড়ান, এমনও অনেকে আছেন। রান্নার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সৃজনশীলতাও। তাই মন ভাল রাখতেও ইদানীং হাতা-খুন্তি বেছে নিচ্ছেন পুরুষেরা। অনেকের কাছেই কাজের চাপ, ব্যস্ততা, একাকিত্ব, অবসাদের দাওয়াই হয়ে উঠেছে রান্না। প্রয়োজনে হোক কিংবা অপ্রয়োজনে, রাঁধতে বসলেই ফুরফুরে হয়ে যাচ্ছে মন। এ ভাবেই রান্নার প্রেমে মজেছেন অনেকে।
তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত অনুষ্টুপ রায় তাঁদেরই এক জন। ছবি তোলেন মনের আনন্দে। সদ্য রান্নাতেও খুঁজে পেয়েছেন তেমনই মন ভাল রাখার রসদ। কেমন সেই অনুভূতি? অনুষ্টুপ বলেন, ‘‘নানা রকম ফোড়ন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে বেশ লাগছে। এতে একটা নতুনত্ব আছে। একঘেয়ে জীবনে যা অন্য রকম ভাল লাগা দেয়। নিজের হাতের রান্না নিজেকে খাওয়ানো, আসলে নিজেকে যত্ন করার মতোই অনুভূতি। একই ভাবে নিজে হাতে রেঁধে অনেককে খাওয়ানোর মধ্যে মা-ঠাকুরমা যে আনন্দটা পেতেন, সেটাও অনুভব করা যায়। একসঙ্গেই বোঝা যায়, তাদের কেমন পরিশ্রমও হত।’’ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই ভাবনা যখন পুরুষদের মুখ থেকেই শোনা যায়, আলাদা করে একটু ভেবে দেখার সময় যে তবে এসেছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। এ সব নিয়ে অবশ্য তেমন হইচই শোনা যাবে না৷ কারণ, সমাজ চায় না নারী-পুরুষ সমান সমান, এই জায়গা তৈরি করতে। সাবালক গৃহী রান্নায় খুঁজে পান আত্মতৃপ্তি, এমনটা ভাবার মতো সাবালক সমাজ হয়েছে কি? ঠিক এই প্রশ্ন অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তীকে করা হলে তিনি বলেন, 'রান্না মেয়েরা করবে ছেলেরা বাইরের কাজ, এই ভেদাভেদ কোনওদিন মানিইনি। আমার বাড়িতে রান্নাঘরের ডিপার্টমেন্ট পুরোটাই অভিষেকের। ও দুর্দান্ত রান্না করে। আমার মেয়ে তার বাবার হাতের মটন, চিকেন ছাড়া খায় না। আবার হোয়াইট সস পাস্তা সে আমার হাতের খায়। রান্না নিয়ে আমি কোনও দিন ভাবি না বিয়ের পর থেকে। দাম্পত্যজীবন মানে একে অপরের পাশে থাকা, সেটা সব দিক থেকে। আমি ব্যস্ত থাকলে মেয়েকে ক্লাস থেকে বাড়িতে যেমন অভিষেক আনে, তেমনই আমার কাজের চাপ বেশি বলে বাজার-হাট, রান্নার দিকটাও অভিষেক দেখে রাখে। আমার কাছে কোনও আলাদা জীবন বলে মনে হয় না নিজের এই অবস্থানকে। তবে বাইরের লোকজনকে বলতে শুনি আমি নাকি লাকি, তখনই বুঝতে পারি যা আমার কাছে স্বাভাবিক সেটা সমাজের কাছে নয়। এটা আমাকে অবাক করে না। সমাজের গোঁড়ামি কে না জানি আমরা!’’
রন্ধনে অটুট হয় প্রেমের বন্ধন
রান্না করতে জানলে আর প্রেমিকা খুঁজতে হবে না, শুধু সমাজমাধ্যমে প্রোফাইলে লিখুন ‘লাভ টু কুক’। কিংবা বায়োডেটায় উল্লেখ করে দিন রান্নার প্রতি ভালবাসার কথা। এতে নাকি মেয়েদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকা যায়। বেশ কয়েক বছরের গবেষণায় এমনই তথ্য উঠে আসছে। যে সকল পুরুষ রান্না করতে পারেন বা ভালোবাসেন, সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা বলছে, মেয়েরা সেই সব পুরুষের প্রতি ভীষণ আকৃষ্ট হন। ডেটিং অ্যাপ হোক বা সমাজমাধ্যম, এমন নিদর্শনের ছড়াছড়ি। এর কারণ হিসাবে যে ব্যাখ্যা উঠে আসছে, তা হল একটি ছেলে শুধুমাত্র আর্থিক দিক থেকে সফল হলে চলবে না। তাঁকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও দায়িত্বশীলও হতে হবে। এমন ব্যক্তিত্ব প্রশ্নাতীত আকর্ষণীয়।
বাবুর্চি বা শেফ— সাধারণ ভাবে ছেলেদের রান্নাঘরে এমন পদে আসীন হতে দেখতেই অভ্যস্ত তথাকথিত সমাজ। কিন্তু মেয়েরাও যখন ল্যাপটপ বা বন্দুক হাতে হাল ধরতে পেরেছে সমাজের, তেমনই ছেলেরাও হাল ধরেছে গেরস্থালির। দিনবদলের পালা শুরু হয়ে গিয়েছে। রান্নাঘরের রানির মতো রান্নাঘরের রাজা বলা আজ রীতিমতো সহজ হয়ে উঠছে দেশ-বিদেশে। পুরুষতান্ত্রিকতা নানা ভঙ্গিতে ভাঙছে। বদলাচ্ছে ঘরকন্যা নামক ধারণাও। ক্লান্ত পুরুষ খুঁজে নিচ্ছে রান্নায় আত্মতুষ্টি। মেয়েরা বুঝে নিচ্ছে বিশ্বায়নের বাজার। বদল আসছে পৌরুষের সংজ্ঞায়। আর সেই বদল নীরবে ঘটছে এ দেশের ফ্ল্যাট থেকে অট্টালিকার অন্দরমহলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy