Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Autism and Down Syndrome Problem

কেউ ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত, কারও অটিজ়ম আছে! ক্যাফের দায়িত্ব তাঁদেরই হাতে

অটিস্টিক মানেই কাজকর্মে অষ্টরম্ভা! সমাজের এই ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ক্যাফে চালাচ্ছেন বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ন’জন কর্মী। খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।

A Kolkata Based cafe is completely run by nine Special Children

‘অপরচুনিটি ক্যাফে’র ন’জন কর্মী। —নিজস্ব চিত্র।

রিচা রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২৪ ০৯:৪৪
Share: Save:

কাঁপা কাঁপা হাতে কফির কাপ এনে টেবিলে রাখলেন অরিত্র। হাত কাঁপলেও, কাপ থেকে এক ফোঁটা কফি চলকে নীচে পড়তে দেননি। অন‍্য দিকে, শ‍্যামল ব‍্যস্ত হেঁশেলের অন‍্য কাজে। ত্রস্ত পায়ে আর ব‍্যস্ত হাতে খাবার বানানোর উপকরণগুলি গুছিয়ে রাখছেন। বিকাশ মাঝেমাঝেই রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখছেন, কাজ কত দূর এগোল। অরিত্র, শ‍্যামল, বিকাশ— সমাজের চোখে এঁরা ‘স্পেশ‍্যাল’, ‘স্বাভাবিক’ নন। কেউ ডাউন সিনড্রোমে ভুগছেন, কেউ আবার অটিস্টিক। সকলেই বয়সে আঠেরোর কোঠা পেরিয়েছেন। তবে মনে মনে এখনও শিশু। কিন্তু এঁরাই চালাচ্ছেন গোটা একটি ক‍্যাফে! দমদম রোডের ‘অপরচুনিটি ক‍্যাফে অ্যান্ড কোওয়ার্কস’-এর হাল এঁদের হাতেই। ক‍্যাফের হেঁশেলে রান্না থেকে খাবার পরিবেশন—নিজেরাই করেন সব কিছু।

‘স্পেশ‍্যাল চাইল্ড’ মানেই স্বাভাবিক কাজকর্মে অষ্টরম্ভা! এমনই ধারণা সমাজের অধিকাংশের। সেই ভাবনায় জল ঢেলেছেন এই ক‍্যাফের ন’জন কর্মী। এ বছর গোড়ার দিকে পথচলা শুরু এই ক‍্যাফের। এখন সেখানে গেলে খুব একটা অসুবিধা চোখে পড়বে না। সকলেই অভ‍্যস্ত, পেশাদার হয়ে উঠেছেন। তবে শুরুটা একেবারেই মসৃণ ছিল না। দৃশ‍্যটা একেবারেই আলাদা ছিল। জল ভর্তি গ্লাস অতিথিদের টেবিলে পৌঁছে দেওয়ার আগেই কেউ মাঝপথে উল্টে ফেলেছেন, আবার কেউ নিজেই মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছেন। খাবার পুড়িয়ে ফেলা তো রোজের ঘটনা ছিল। তবে সঠিক প্রশিক্ষণ, সুযোগ আর নিজেদের ইচ্ছাশক্তির জোরেই সমাজের বদ্ধমূল ধারণা একেবারে ভেঙেচুরে দিয়েছেন তাঁরা।

A Kolkata Based cafe is completely run by nine Special Children

পরিবেশনে ব্যস্ত। —নিজস্ব চিত্র।

এই কর্মকাণ্ডের নেপথ‍্যে রয়েছেন ক‍্যাফের কর্ণধার সিদ্ধান্ত ঘোষ। পেশায় আইনজীবী সিদ্ধান্ত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও পরিচালনা করেন। অটিজ়ম, ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্তদের নিয়েও কাজ করেন। এই ক‍্যাফের কর্মীদের মধ‍্যে কয়েক জন আছেন, যাঁরা অনাথ। জন্মের পর থেকে বাবা-মায়ের স্নেহ পাননি। হোমেই বড় হয়েছেন। পরে এখানে আনা হয়েছে। আবার বাড়ি থেকে ক‍্যাফেতে কাজ করতে আসেন, এমনও অনেকে আছেন। এই রোগে আক্রান্তেরা অনেক ক্ষেত্রে নিজের বাড়িতেই বাতিলের খাতায় চলে যান, সেখানে তাঁদের মতোই কয়েক জনকে নিয়ে ক‍্যাফে শুরু করা ঝুঁকির কাজ মনে হয়নি? সিদ্ধান্ত বলেন, ‘‘একেবারেই না। আমরা ধরেই নিই যে, অটিস্টিকরা কিছু করতে পারবেন না। সেই ধারণা বদলে দিতে চেয়েছিলাম। ঠিকঠাক প্রশিক্ষণ আর সুযোগ পেলে এঁরাও অনেক কিছু করতে পারেন। ক‍্যাফে শুরু করার আগে সকলকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ দিলেও ওঁদের সেটা রপ্ত করতে সময় লাগে। তবে সেটুকু ধৈর্য যদি রাখা যায়, তা হলে ওঁরা সব কিছুই করতে পারবেন। প্রথম দিকে সকলেই এত চৌখস ছিলেন না। ধীরে ধীরে হয়েছেন। সমাজ এই ধরনের মানুষদের সহজে মেনে নিতে পারে না। কয়েক জনের ব‍্যাঙ্ক অ‍্যাকাউন্ট খুলতে গিয়ে বুঝেছি। তবে অ‍্যাকাউন্টটা শেষ পর্যন্ত হয়েছে। প্রতি মাসে সেই অ‍্যাকাউন্টে বেতন ঢোকে সকলের।’’

অরিত্র, শ‍্যামল, অরিত্রীদের কাজে দক্ষতা নিয়ে মনে সংশয় রেখেই ক‍্যাফেতে এসেছেন অনেকে। আসার পর অবশ‍্য তাঁদের সংশয় অনেকটাই কেটে গিয়েছে। কথায় কথায় জানালেন সিদ্ধান্ত। তবে এই সংশয় নিয়ে বিস্মিত হওয়ার জায়গা নেই। কারণ, অনেক সময়ে, সন্তান অটিজ়ম আক্রান্ত জানার পর বাবা-মায়েরাও হাল ছেড়ে দেন। তাঁরা ধরেই নেন, যে জীবনে করার মতো কোনও কাজ তাঁদের নেই। কিন্তু এই ভাবনা যে কতটা ভ্রান্ত, সেটা স্পষ্ট করলেন মনোরোগ চিকিৎসক সঞ্জয় গর্গ। তাঁর কথায়, ‘‘অটিজ়মের ‘মাইল্ড মডারেট সিভিয়ার’ বলে একটি ভাগ আছে। যাঁরা এই ভাগে পড়েন, তাঁদের ক্ষেত্রে কাজ করার কোনও অসুবিধা নেই। অটিজ়মের মূল সমস‍্যা হল লোকজনের সঙ্গে কথাবলা, মেলামেশায়। এবং একই কাজ বার বার করার একটা প্রবণতা থাকে। তবে অটিজ়মের ক্ষেত্রে সময় মতো রোগ ধরা পড়া এবং চিকিৎসা হওয়া জরুরি। তার পর চাই পর্যাপ্ত ট্রেনিং। প্রথমত এই রোগ নিয়ে সমাজে কোনও সচেতনতা নেই, শুধু আছে ভ্রান্ত ধারণা, এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। ধরেই নিয়ে যাওয়া হয় যে, ওঁরা কিছু করতে পারবেন না। সেই ভাবনা থেকে কোনও সুযোগ দেওয়া হয় না। ফলে ওঁদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। তবে সঠিক সুযোগ-সুবিধা পেলে, প্রশিক্ষণ পেলে ওঁরা সব কিছু করতে পারবেন। আমার অনেক রোগী ব‍্যাঙ্ক, পোস্ট অফিসে কাজ করছেন।’’

A Kolkata Based cafe is completely run by nine Special Children

ওরা কাজ করে আনন্দে। —নিজস্ব চিত্র।

হোয়াইট সস পাস্তা থেকে চিকেন সসেজ় পিৎজ়া, আমেরিকান প্ল্যাটার থেকে মশলা চা, ম্যাগি, চিকেন উইংস, চিকেন স্ট্রিপ্‌স, বিভিন্ন ধরনের শেক, নানা স্বাদের কফি— রেস্তরাঁর মেনুকার্ড বেশ সমৃদ্ধ। আরও নতুন নতুন খাবার রাখার ভাবনাচিন্তাও চলছে। স্বাদে পেশাদার হাতের ছোঁয়া না থাকলেও, খাবারে মিশে আছে বাপি, শ্যামল, নূপুর, ভার্গবদের ভরপুর আন্তুরিকতা আর আত্মবিশ্বাস। যে আত্মবিশ্বাস আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে ভর করেই সমাজের ভাবনাকে তাঁরা মিথ্যা প্রমাণ করেছেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy