স্কুল থেকে ফেরার সময়ে রোজ মোহর দেখে, পাশের বাড়ির দিদা বসে আছেন জানালার ধারে। কখনও-সখনও দিদা ডেকে লজেন্স দেন, কখনও জুড়ে দেন খোশগল্প। মোহরের সে সব গল্প ভালই লাগে। কারণ, দিদার মতো গল্প কেউ করে না। আর সে এ-ও জানে, দিদার গল্প করার লোক মোটেও নেই। দিদা বড্ড একা।
জীবনের কোনও না কোনও সময়ে একা বোধ করেছেন প্রায় সব মানুষই। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকা একাকিত্বের রং যেন বেশিই বিষাদময়। সেখানে কোথাও ঘিরে থাকে কারও ফিরে আসার অপেক্ষা, কোথাও একরাশ শূন্যতা। তার মানে কি এই অধ্যায় থেকে সব রং হারিয়ে গিয়ে পড়ে থাকে শুধু অভিজ্ঞতার সাদা-কালো জীবন? না কি এলোমেলো নতুন রঙেরা তৈরি করে সুন্দর কোলাজ? এ বার সময় এসেছে বদলে ফেলার। পাল্টে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে বার্ধক্যেও না হয় ডানা মেলুক রঙিন দিন।
একাকিত্বের শিকড়
বার্ধক্য আগেও ছিল। কিন্তু একাকিত্ব এ ভাবে চেপে বসার সুযোগ পেত না। একান্নবর্তী পরিবারে নানা প্রজন্মের মানুষের সঙ্গে থাকার ফলে একা বোধ করার অবকাশ থাকত না। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে এখনকার অনেক প্রবীণই তুলনায় বেশি একা বোধ করেন।
চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে অবসর একদিন নিতেই হবে। যে মানুষটা সারা দিন অফিসের নানা কাজে ব্যস্ত থাকতেন, রিটায়ারমেন্টের পরে তাঁর যেন সময়ই কাটতে চায় না। পড়াশোনা, কাজ বা বিয়ের সূত্রে সন্তান অন্যত্র থাকলে, বাড়তে থাকে একাকিত্ব। আবার সঙ্গীহীন হয়ে পড়লে একা হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। অনেকের সঙ্গেই আত্মীয়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বন্ধুরাও দূরে। একাকিত্বের অন্যতম কারণ হল শারীরিক সক্ষমতা কমে যাওয়া। বয়স বাড়ার সঙ্গেই ভাঙতে থাকে শরীর। কী ভাবে একাকিত্বের খোলস ছেড়ে বেরোনো যায়?
নিজের জন্য অল্প কিছু
• নিজের উপার্জনের প্রায় সবটাই মানুষ ব্যয় করে সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য। অনেক ক্ষেত্রে সঞ্চয়টুকুও চলে যায় সংসারেই। কিন্তু নিজের জন্যও ভাবা জরুরি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টাকা তো থাকবেই, নিজেদের জন্যও থাকুক কিছুটা। টাকা থাকলে সাহস জন্মায়। আর্থিক ভাবে স্বাধীন থাকলে কারও উপরে ভরসা করতে হয় না।
• বিয়ে, কেরিয়ারের জাঁতাকলে পড়ে কখন যেন জীবন থেকে হারিয়ে যায় শখ। অথচ ছোটবেলায় কেউ ভাল আঁকতে পারতেন, কারও স্ট্যাম্পের খাতা মোটা হত। কিন্তু অবসর জীবনে এসে দেখা যায়, যে চাকরি বা সংসারের জন্য এত ছুটোছুটি, তার কিছুই পড়ে নেই। হারিয়ে গিয়েছে শখটাও। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও সেটুকুকে বাঁচিয়ে রাখুন। সেটাই তো আপনার নিজের আকাশ। বার্ধক্য কড়া নাড়লে আঁকড়ে ধরুন শখের হাত। আর তেমন শখ না থাকলে, নতুন শখের প্রেমে পড়তেই বা ক্ষতি কী! নতুন করে তুলি ধরুন, বাগান করুন, গল্পের বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে যান।
• ডিজিটাল দুনিয়ায় পাল্লা দিতে গেলে নিজেও না হয় একটু ‘স্মার্ট’ হলেন! কি-প্যাডের সাবেকি মোবাইল ছেড়ে অন্তত স্মার্টফোন ব্যবহারের অভ্যেস শুরু করতে পারেন। ইনকামিং ও আউটগোয়িং ছাড়াও শুরুর দিকে মেসেজ করতে শিখতে পারেন। সম্ভব হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে প্রোফাইল খুলুন। সেখানেই ফিরে পেতে পারেন হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের। তাঁদের সঙ্গে দেখা করুন, সিনেমায় যান, বাড়িতে ডেকে নিন। ফেসবুকেই রয়েছে নানা গ্রুপ। নিজের শখের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই সব গ্রুপে যোগ দিতে পারেন। এতে আপনার সামাজিক পরিধি বাড়বে। এ সমস্ত কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে ধীরে ধীরে শিখে যেতে পারেন ফুড, ক্যাব, বিল পেমেন্ট জাতীয় নানা অ্যাপের ব্যবহার। সেগুলি খুব কঠিনও নয়। আর এ সব করতে পারলে একটা সময়ে নিজেরই আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
• রোজ সকালে হাঁটার মতো বিকল্প কিছু নেই। এতে যেমন শরীর ভাল থাকবে, তেমনই বাড়বে বন্ধুর সংখ্যাও। হেঁটে ফেরার পথে না হয় বাজারটাও ঘুরে এলেন! মন ভাল হতে বাধ্য। সকালে উঠতে অসুবিধে হলে ইভনিং ওয়াকও মন্দ নয়।
• নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেই করুন। প্রয়োজনে বাড়িতে সিসিটিভি বসান। থানায় জানিয়ে রাখুন। নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে নানা সংস্থার তরফেও।
• নানা ব্যস্ততায় নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রাখার প্রয়োজন বোধ করেন না অনেকেই। কিন্তু বার্ধক্যে একাকিত্ব এড়ানোর প্রধান উপায় নিজেকে সুস্থ রাখা। অনেক সময়ে শারীরিক অক্ষমতা থেকে আসে মানসিক অবসাদ। উল্টোটাও হতে পারে। কিন্তু চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়লে মুশকিল হয়। একাকিত্ব আরও জাপটে ধরে। কারণ প্রতি পদে দরকার হয় কারও সাহায্যের। তাই আপনি যদি সুস্থ থাকেন, মেজাজও থাকবে ফুরফুরে। চিকিৎসক, নার্সদের নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে নানা সংস্থা। চেকআপ, মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। তেমন কর্মসূচিতে নাম লেখাতে পারেন।
• নিঃসন্তান হোন বা সন্তান দূরে... এমন বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন, যেখানে হাতের কাছে আছে বন্ধু-স্বজন। কাছের বন্ধুরা মিলে একই অ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট কিনতে পারেন। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেলেও ভাই-বোনেরা মিলে থাকতে পারেন একই কমপ্লেক্সের নানা ফ্ল্যাটে। এতে ব্যক্তিগত পরিসর বজায় থাকে, আবার হাত বাড়ালেও পাওয়া যায় ভরসার হাত। তবে তার প্রস্তুতি শুরু করতে হবে আগেই।
• বিদেশে অনেক মা-বাবাই চান, ক্রেশে তাঁদের সন্তান দেখভালের কর্মীদের মধ্যে থাকুন একজন প্রবীণ। তিনিই বাচ্চাদের গল্প শোনাবেন। এতে গল্পের মান যেমন ভাল হয়, তেমনই বাচ্চারাও শেখে অনেক কিছু। চাইলে আপনিও পাড়ার ক্রেশে যুক্ত হতে পারেন। আপনারও হয়তো এমন অনেক গল্প আছে, যা ভাগ করে নিতে চান কচিকাঁচাদের সঙ্গে।
বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা ক্লিশে নয়
একটা সময়ে ইচ্ছে করে পিছুটান ফেলে বাঁচতে। তখন খাবার, স্বাস্থ্য, সঞ্চয়... কোনও কিছুতেই মাথা ঘামাতে মন চায় না। ফলে অনেকেই এখন বেছে নিচ্ছেন ওল্ড এজ হোম। সন্তান বাবা-মাকে দেখে না ও তাই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে— এ ধারণা বদলাচ্ছে। অনেকের মাঝে একসঙ্গে হেসে-খেলে, মজায় দিন কাটানোর জন্য অনেকেই বেছে নিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থা। শহরে ঝাঁ চকচকে, সমস্ত সুযোগ-সুবিধে সমেত বৃদ্ধাশ্রম খুলছে। নিজের সাধ্য মতো বেছে নিতে পারেন সে রকমই কোনও হোম। সেখানেই দিনযাপন, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, ঘুরে-বেড়ানো... ব্যবস্থা থাকে সব কিছুরই। চাইলে দম্পতিদের থাকার ব্যবস্থাও পাবেন।
বার্ধক্য যখন গুটি গুটি এসে থাবা বসায় জীবনে, তখন চাইলেই তাকে হেলায় হারাতে পারবেন। দরকার শুধু সামান্য কিছু পরিকল্পনা আর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের। তাই ‘বালিগঞ্জ কোর্ট’-এর দম্পতির নিঃসঙ্গতা, না কি ‘শুভ মহরৎ’-এর মিস মার্পল ‘রাঙা পিসিমা’... কেমন জীবন বাছবেন, তার চাবিকাঠি কিন্তু আপনার হাতেই।
তথ্য: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
রিমা মুখোপাধ্যায়, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায়
মডেল: ভারতী লাহা
অতীন লাহা; ছবি: জয়দীপ মণ্ডল
মেকআপ: সৌমেন সেনগুপ্ত
লোকেশন: লাহা বাড়ি, বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy