গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কত ধানে কত চাল? জানেন সম্ভবত এক জনই! নাম সুজয় চট্টোপাধ্যায়। পেশায় চাল ছাড়াও নানা রকম আনাজের বিক্রেতা। কলকাতায় এক শহুরে খামারে তিনি বিক্রি করেন ৪৩ রকমের চাল। চেনা গোবিন্দভোগ, চামরমনি থেকে কম চেনা রানি কাজল, মোহনশাল— রকমারি আছে সেখানে।
সে বিপণির নাম ‘আমার খামার’। কত ধানে কত চাল হবে, সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য দিতে পারেন না সেখানকার ম্যানেজারও। কোন চালে কতটা ভাত হয় তিনি কি জানেন? উত্তরে বিপণির দেখভালের দায়িত্বে থাকা রাকেশ মণ্ডল বলেন, ‘‘ওটা তো প্রবাদ মাত্র। এক এক রকম চালে আসলে এক এক রকম ভাত হয়।’’
বাংলায় এক সময়ে নাকি হাজার পাঁচেক ধরনের চাল পাওয়া যেত। সময়ের সঙ্গে তার অধিকাংশই বিলুপ্ত। সংখ্যাটি কমতে কমতে এখন একশোরও অনেক কম। বঙ্গের সমাজ-ভাবনায় চালের গুরুত্বও যেন সে ভাবেই কিছুটা লুপ্ত হচ্ছে। সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে বাংলার নানা প্রান্তের ফসল ও খাবার শহরে নিয়ে আসছে ‘আমার খামার’। একেবারে ব্রাত্য নয় বাংলা-বহির্ভূত এলাকাও। একই জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে সুন্দরবনে ফলানো রাধাতিলক, আবার মায়ানমারের কালো চাল।
তবে শুধু চাল নয়। আছে বাঙালি হেঁশেলের নানা উপকরণ। এক এক জায়গার ঘিয়ের যে গন্ধ ও ধরন আলাদা, তা-ও চেনাচ্ছে ওরা। কালিম্পংয়ের গাওয়া ঘি যেমন রয়েছে, তেমনই আছে উত্তর ২৪ পরগনার ঘি। আছে নানা জেলার রকমারি হলুদ, গুড়, বাসমতি চালের মুড়ি, চিঁড়ে।
কিন্তু এক জেলার চাল-হলুদের সঙ্গে কী পার্থক্য হয় অন্য জেলার হলুদ ও চালের? এক এক জায়গার খাবার কি সত্যিই আলাদা? মাছের ঝোলে যে হলুদ দেব আর পটল পোস্ততে যে হলুদ পড়বে, তা কি আলাদা হবে তবে? দার্জিলিঙের চা আর মেক্সিকোর লঙ্কার কি সত্যিই বিশেষ গুণ আছে? না কি একই পাতা নিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় গাছ পুঁতলেও হবে দার্জিলিঙের মতো চা?
স্থানমাহাত্ম্য বলে একটি কথা প্রচলিত। ফরাসিরা এটাকে ধর্মের পর্যায় নিয়ে গিয়েছে। ফরাসি ভাষায় ‘তেরোয়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় তা বোঝাতে। বাংলায় তা-ই হল ‘স্থানমাহাত্ম্য’। ফ্রান্সে ওয়াইন তৈরির ক্ষেত্রে তেরোয়া নিয়ে খুবই হইচই করা হয়। তবে বলা হয়, সুরা থেকে চিজ়, আঙুর থেকে চেরি— সবের ক্ষেত্রেই স্থানের মাহাত্ম্য আলাদা। এক জায়গার চিজ়ের সঙ্গে আর এক জায়গায় তৈরি চিজ়ের স্বাদের মিল পাওয়া যাবে না। শুধু তো যে জায়গায় খাবার উৎপাদন হচ্ছে, সেখানকার মাটি নয়, সঙ্গে জল-হাওয়া-তাপমাত্রা, সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। সবে মিলে তৈরি হয় খাবারের স্বাদ।
বাংলার চাল-হলুদ-গুড়ও এক এক জায়গার হাওয়া-বাতাসে এক এক রকম হয়। বর্ধমানের চালের মান ভাল, তো বনগাঁর গুড়ের বিশেষ কদর। কিন্তু ব্যাপার হল, ফরাসিরা যে ভাবে তেরোয়া নিয়ে মাতামাতি করে, বাংলা কেন, পৃথিবীর অন্য কেউ এমন পাগলামি করে না। ফরাসিরা ছোট ছোট ভূখণ্ডকে তেরোয়ায় ভাগ করে ফেলে। রাস্তার এ পার আর ও পারকেও আলাদা আলাদা তেরোয়া বলে ধরে। জিজ্ঞাসা করলে বলবে হয়তো রাস্তার ও পারে যে ভাবে রোদ পড়ে, এ পারের জমিতে সে ভাবে রোদটা পড়ে না। তাই আঙুরের স্বাদ দু’পারে আলাদা। সেই আঙুরের ওয়াইনের স্বাদও তাই আলাদা।
ফ্রান্সের বাইরে কি তেরোয়ার ধারণা একেবারে ছিল না? ছিল তো বটেই। যেমন বাংলায় এক এক ধরনের রান্নায় এক এক জায়গার সামগ্রী ব্যবহার করার রেওয়াজ তো দিব্যি আছে। যেমন, ভোগের খিচুড়ি বা পোলাও হবে গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে। এ চাল সাধারণ ভাবে বর্ধমান জেলার নানা প্রান্তে চাষ করা হত। এখন আরও কয়েকটি জেলায় হয়। তবে বর্ধমানের গোবিন্দভোগই সেরা বলে প্রতিষ্ঠিত। জয়নগরের মোয়া আবার তৈরি হয় কনকচূড় ধানের খই দিয়ে। সঙ্গে থাকে ঘি আর নলেন গুড়। এ ক্ষেত্রে শুধু স্থান নয়, কাল মাহাত্ম্যও আছে। শীতকালে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় পাওয়া যায় ভাল গুড়, সঙ্গে এই খইও ওই সময়েই মেলে। ফলে ওই জেলার জয়নগর অঞ্চলে হয় বিশেষ ধরনের মোয়া। তবে ফরাসিরা যে ভাবে স্থানমাহাত্ম্যে জোর দিয়েছে, ততটা জোর দেওয়া হয় না বাংলায়।
কেউ কি জানেন উত্তর বর্ধমান আর দক্ষিণ বর্ধমানের গোবিন্দভোগ চালের স্বাদে ফারাক আছে কি না? ফরাসিরা হলে জানতেন। এখানে তা জানার তেমন উপায় কিন্তু এখনও নেই। কারণ, এখনও সে সব নিয়ে অত চর্চা হয়নি। আবার কোনও পরীক্ষাই হয়নি তা নয়। যেমন বঙ্গের নানা জেলায় এক এক ধরনের মিষ্টি বেশ বিখ্যাত। বর্ধমানে মিহিদানা-সীতাভোগ, তো কৃষ্ণনগরে সরপুরিয়ার নাম বেশি। এ সব বানাতে এমন কী লাগে, যা কলকাতায় পাওয়া যায় না? দুধ-ঘি-চিনি সবই তো পাওয়া যায়। কারিগরও চলে আসেন শহরে। কিন্তু সে স্বাদ হয়েছে কি এখনও? কৃষ্ণনগর থেকে কল্যাণীর দূরত্ব তো আরওই কম। কল্যাণীতে শহুরে মেজাজের বহু মিষ্টির দোকান আছে। সেখানেও বহু বার কৃষ্ণনগরের কারিগর নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু কৃষ্ণনগরের ধারকাছেও স্বাদ হয়নি কল্যাণীর সরভাজা-সরপুরিয়ার। এমনই হল স্থানমাহাত্ম্য।
সচেতন বা অবচেতন ভাবে সেই তেরোয়ার বিপ্লব ঢুকে পড়ছে এখন কলকাতায়। কৃষি বিপণনে একটু একটু করে স্থানমাহাত্ম্য গুরুত্ব পাচ্ছে। যেমন দক্ষিণ কলকাতার সিয়েনা ক্যাফের শেফ আরুণি মুখোপাধ্যায় যেমন মনে করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারে পাওয়া যাওয়া জিনিস ব্যবহার করলে স্বাদ ভাল হয়। কারণ, যেখানে যে জিনিসটির ফলন হচ্ছে, সেটার স্বাদ আলাদা। একই গাছের বীজ অন্য জায়গায় রোপণ করলে ফলের স্বাদ এক হয় না। যেমন তিনি বলেন, ‘‘সুন্দরবনে যে চাল হয়, তা শুধু মাটি বা হাওয়া নয়, সেখানকার নোনা জলও খেয়ে বড় হয়। ফলে সেখানকার চাল অন্য জায়গার চালের চেয়ে তো আলাদা হবেই।’’
‘আমার খামার’-এর মতো উদ্যোগের ফলে নানা জায়গার চাল-আনাজ এখন কলকাতায় পাওয়া যাচ্ছে। বাজার যত বড় হচ্ছে কলকাতায়, নানা জায়গার জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। এখন হলুদ, ঘি, তেজপাতা, কাঁচালঙ্কা— নানা জেলারটাই এখানে মিলছে। আর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করছে তেরোয়ার মানসিকতা। কখনও লুচি ভাজতে ব্যবহৃত হচ্ছে মেদিনীপুরের ঘি, আবার পাতে পেড়ে খেতে দেওয়া হচ্ছে হয়তো কালিম্পঙের ঘি। চিংড়ি মাছে ব্যবহার করা হচ্ছে মেদিনীপুরের হলুদ, আবার উত্তর ২৪ পরগনার হলুদ দেওয়া হচ্ছে ভেটকি মাছে। হয়তো এটাই বিপ্লবের পূর্বাভাস।
বাংলায় রান্না নিয়ে মান্য সমাজের ঔৎসুক্য বাড়ছে। শৌখিন রাঁধুনিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষিত মুখেরা রান্নায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সকলে হয়তো অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নোবেল পাননি, কিন্তু আগ্রহ সমানে রয়েছে। শিক্ষিত সমাজের প্রবেশের ফলে নানা রকম চর্চা আর নিরীক্ষা করার প্রবণতাও বেড়েছে। রান্না ফরাসিদের কাছে এক ধর্ম। এবং তাই রান্না নিয়ে ধর্মান্ধতা প্রায় তালিবানিদের মতো। এর ফলে মাটি পরীক্ষা যত বিশদ ভাবে হয়েছে, আমাদের এখানে ততটা হয় না। হলে হয়তো দেখা যেত, পশ্চিম বর্ধমান আর পূর্ব বর্ধমানের মাটি আলাদা। সে কারণে গোবিন্দভোগের স্বাদও আলাদা। বিপ্লব কখন আসে, কেন আসে, আগে থেকে বলা যায় না। লেনিন যদি ট্রেনে করে না-পালিয়ে রাশিয়ায় থেকে যেতেন, তা হলে কমিউনিজ়মের প্রচার কোথাও হত না। এমনকি, পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকারও হত না। ‘আমার খামার’-এর মতো উদ্যোগ হয়তো আকস্মিক দুর্ঘটনা। এর ফলে বাঙালি হেঁশেলে বিপ্লব আসবে, না আসবে না, তা বলার সময় এখনও আসেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy