Advertisement
E-Paper

‘আমার তৈরি পোশাকে বুম্বাদা আর লিয়েন্ডারকে দেখে হাততালিতে ভরিয়ে দিল মুম্বই, এটা বড় প্রাপ্তি’

২৫ বছরে পা দিল দেশের সবচেয়ে বড় ফ্যাশন-উৎসব। এক ছাদের তলায় জড়ো হন ফ্যাশন জগতের তারকারা। পাঁচ দিন ব্যাপী এই মহোৎসবে আমন্ত্রণ পান কলকাতার খ্যাতনামী পোশাকশিল্পী অভিষেক রায়। তাঁর জন্য র‍্যাম্পে হাঁটেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং লিয়েন্ডার পেজ়। আনন্দবাজার ডট কমের জন্য কলম ধরলেন তিনি।

ফ্যাশন-উইকের মঞ্চে পোশাকশিল্পী অভিষেকের সঙ্গে লিয়েন্ডার পেজ় এবং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।

ফ্যাশন-উইকের মঞ্চে পোশাকশিল্পী অভিষেকের সঙ্গে লিয়েন্ডার পেজ় এবং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: দেবর্ষি সরকার।

অভিষেক রায়

অভিষেক রায়

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:৫৭
Share
Save

নিজের কাজ গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরব। উৎসাহ-চিন্তা সব নিয়েই গিয়েছিলাম। তবে তার চেয়ে অনেক বেশি নিয়ে ফিরলাম।

মুম্বইয়ে বছরে এক বার সকলে জড়ো হন ফ্যাশন-উৎসবে অংশ নিতে। তারকায় ঝলমল করে মঞ্চ থেকে দর্শকাসন। আট বছর আগে চেষ্টা করেছিলাম সেখানে কাজ দেখানোর সুযোগ পেতে। পাইনি। এ বার সেই ‘ল্যাকমে ফ্যাশন উইক’ নিজে থেকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিল। ফ্যাশন ডিজ়াইন কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার বার্ষিক এই আয়োজন সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের মতো তারকা পোশাকশিল্পীকে এক সময়ে পরিচয় করিয়েছে জগতের সঙ্গে। করিনা কপূর থেকে সুস্মিতা সেন— বিভিন্ন সময়ে খ্যাতনামী সব তারকা শোস্টপার হয়েছেন এই ফ্যাশন সংস্থার বিভিন্ন শোয়ে।

(বাঁ দিকে) অনামিকা খন্নার পোশাকে অনন্যা; অমিত আগরওয়ালের পোশাকে ভূমি (ডান দিকে)।

(বাঁ দিকে) অনামিকা খন্নার পোশাকে অনন্যা; অমিত আগরওয়ালের পোশাকে ভূমি (ডান দিকে)। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া।

আমার মতো কলকাতার এক বাঙালি পোশাকশিল্পী এমন মঞ্চে জায়গা পেয়েছে শুনে অনেকেই আনন্দ পেয়েছেন। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) চরম ব্যস্ততার মাঝে আমার জন্য প্রথম বার এই ফ্যাশন-উৎসবের র‌্যাম্পে হাঁটতেও রাজি হয়ে যান। লিয়েন্ডার পেজ়ও উৎসাহ দেখান আমার কাজে। সব মিলে উত্তেজনা ছিলই। মুম্বই গিয়ে তা আরও বাড়ল। তা-ও কলকাতারই এক জনের কারণে।

গোটা বিশ্ব যে ফ্যাশন উৎসবের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার সূচনাই হল এ বার কলকাতা শহরের এক কন্যার হাতে।

পোশাকশিল্পী অনামিকা খন্না বহু বছর ধরেই মুম্বইয়ে কাজ করছেন। বহু খ্যাতনামীকে তাঁর তৈরি পোশাকে দেখা যায়। তবে এই ফ্যাশন মহোৎসবের মঞ্চে আলো জ্বলল তাঁর তৈরি পোশাকে, সেটি একেবারেই অন্য রকম।

অনামিকা খন্নার পোশাকে যীশু-কন্যা সারা।

অনামিকা খন্নার পোশাকে যীশু-কন্যা সারা। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

নিজের ‘একে ওকে’ ব্র্যান্ডের উদ্বোধন করলেন অনামিকা। অনামিকার ‘সিলভার কলার’-এর র‌্যাম্পে যীশুদার (যীশু সেনগুপ্ত) মেয়ে সারাকে দেখে খুব আনন্দ হল। সারাও তো কলকাতারই মেয়ে। অনন্যা পাণ্ডে ছিলেন শোস্টপার। তাঁর মতো অন্য সকল মডেলের শরীরের অধিকাংশটাই রুপোয় মোড়া। শুরুর সন্ধ্যা এক লহমায় রুপোলি হয়ে উঠল।

সেখানেই তো শেষ নয়। তার পর এল একের পর এক চমক। এত কিছুর মাঝে নিজের কাজ দেখানোর আনন্দ বাড়ল।

খাদির একাধিক ব্র্যান্ড একযোগে মঞ্চে উঠেছিল সে দিনই। প্যাটার্ন, রং, ব্যবহার, সব কিছুতে খাদি কী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের দেশের সঙ্গে, কেমন ভাবে আধুনিক জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে, তারই প্রতিফলন দেখা যায় র‌্যাম্পে।

মুম্বইয়ে শো-এর আগে অভিষেকের প্রস্তুতিপর্ব।

মুম্বইয়ে শো-এর আগে অভিষেকের প্রস্তুতিপর্ব। ছবি: দেবর্ষি সরকার।

এ সব দেখার পরে গোটা দেশের সামনে এনে দাঁড় করালাম বাংলার নবাবি সংস্কৃতিকে। প্রথম বার নিজের কাজকে এই মঞ্চে মেলে ধরতে পারলাম। ‘নওয়াব্‌স অফ বেঙ্গল’ নাম দিয়েছিলাম এই সম্ভারের। বাংলার বস্ত্রশিল্প, সূক্ষ্ম হাতের কাজের তুলে ধরা হয়েছে আমাদের এই পোশাকের সম্ভারে। সেখানে যেমন বাংলার জামদানি আছে, আছে জরদৌসি, ভেলভেটের ছোঁয়াও। ঐতিহ্যবাহী সিলুয়েটকে আধুনিক রূপ দেওয়া হয়েছিল। বাংলার নবাবদের ধুতিও অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। বঙ্গে মোগল সংস্কৃতির যে প্রভাব রয়েছে, তাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই কাজে। প্রত্যেককে সুরমা পরানো হয়েছিল সাজে অন্য মাত্রা দিতে।

মনে পড়ে যায়, আট বছর আগে আবেদন করেছিলাম এই শো-এ অংশ নেওয়ার জন্য। আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু এক ধাক্কায় প্রত্যাখ্যাত হতে হয় তখন। আট বছর পরে ঠিক সেখান থেকেই বাড়ি বয়ে আমন্ত্রণ এল। ফোনটা আসে মাত্র দু’সপ্তাহ আগে। জানানো হয়, পুরুষদের সাজপোশাক নিয়েই কাজ হবে এ বারের ফ্যাশন উইকে। প্রয়োজন, মোট ১৬টি পোশাক। অধিকাংশ পোশাকই তৈরি ছিল না আমার। রাতারাতি কাজ শুরু। আঁকিবুকি থেকে সেলাই। প্রায় ২০ জন কারিগর দিন-রাত এক করে আমার জন্য পোশাক সেলাই করেছেন। আমার কাজ তো ভাবনাচিন্তার স্তরে। আর তাঁরা সেই সব ভাবনাকে জীবন্ত করে তুলেছেন। সেই শিল্পীদের সাহায্য না পেলে বৃহস্পতি-সন্ধ্যায় র‌্যাম্পে পা রাখার সুযোগ হত না আমার।

অভিষেকের পোশাকে কলকাতার দুই তারকা।

অভিষেকের পোশাকে কলকাতার দুই তারকা। ছবি: দেবর্ষি সরকার।

বুম্বাদা আর লিয়েন্ডারের সাজ দেখে দর্শকাসনের উল্লাস এবং হাততালির আওয়াজ এখনও কানে বাজছে আমার। কলকাতা থেকে ১৯ ঘণ্টা টানা শুট করে এসে, এক বারও চোখের পাতা এক না করে, শুধু কফি খেয়ে আমার জন্য হেঁটেছেন বুম্বাদা। অন্য দিকে, মুম্বই আসার দু’দিন আগে লিয়েন্ডারের সঙ্গে অন্য একটি শুট ছিল আমার। সেখানে লিয়েন্ডার আমার কাজের প্রশংসা করতে করতে নিজে থেকেই বললেন, ‘‘শো ওপেন করার জন্য আমার কথা ভাবতে পারো।’’ সত্যিই, ঈশ্বর যখন দান করেন, কার্পণ্য করেন না।

পরের দু’টি দিন নামজাদা পোশাকশিল্পীদের কাজ দেখেছি, অনেকের সঙ্গে আলাপও হয়েছে। যেমন, অমিত আগরওয়ালের কাজ আমার খুবই পছন্দ। তাঁর বেনারসি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সকলের কাছে উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। এই বছর তিনি তাঁর সম্ভারে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রযুক্তি এবং ভবিষ্যতের নকশাকে। শোস্টপার ভূমি পেডনেকরের সিল্কের শার্ট, কালো বেলুন প্যান্ট, তার সঙ্গে বেনারসির কর্সেটে যে সূক্ষ্মতার প্রকাশ পেয়েছে, তা ল্যাকমের মতো মঞ্চকে আরও রাজকীয় করে তুলেছে বলেই আমার বিশ্বাস। মস্কোর পোশাকশিল্পী জ়া জ়া-র কলেকশনে স্পষ্ট ছিল ভারতীয় এবং রাশিয়ার শিল্পের মেলবন্ধনের ছাপ।

তা ছাড়া, প্রত্যেকের কাজের প্রদর্শনী হয়েছে সেখানে। আমারও স্টল ছিল। সেই সূত্রে আরও কত মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। নানা দেশের মানুষ আমাদের কাজ দেখতে এসেছিলেন। কিনেওছেন পছন্দ করে। তা ছাড়া, ফ্যাশনের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাবার্তা হল। অন্য পোশাকশিল্পীরাও একে অপরের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। একজন শিল্পীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত বোধহয় সেটাই, যেখানে অন্যের সঙ্গে শিল্পচিন্তা আদানপ্রদান করার সুযোগ আসে। শেষ দিন সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল স্টলগুলি।

প্রথম দিন থেকেই মুখিয়ে ছিলাম ফিনালের জন্য। ২৫তম ফ্যাশন উইকের শেষ দিন কী হবে, তার আঁচ পেতে দেওয়া হচ্ছিল না কাউকে। কেউ জানতেন না, কী হতে চলেছে, কারা আসছেন, কাদের শো। তার কারণ বুঝেছি পরে।

শেষ দিনের অভিজ্ঞতা সারা জীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার কাছে। মহোৎসবের জমকালো ওই রাতে এক ছাদের তলায় জড়ো হয়েছিলেন ফ্যাশন-জগতের কালজয়ীরা। ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান অভিনেতা তথা কৌতুকাভিনেতা ক্যাল পেন ছিলেন শো-এর সূত্রধর। দেশের তারকা পোশাকশিল্পীদের ভিড় জমেছিল মুম্বইয়ে। মণীশ মলহোত্র, তরুণ তাহিলিয়ানি, শান্তনু-নিখিল প্রমুখের মতো তাবড় তারকাদের পাশে একই ভাবে উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন কেশসজ্জা শিল্পী, রূপটান শিল্পী, কোরিয়োগ্রাফার, আলো-সেট-আবহের শিল্পীরাও। যাঁদের ছাড়া ফ্যাশন অসম্পূর্ণ। কেবল তা-ই নয়, আজ পর্যন্ত এই মহোৎসবে যে মডেলেরা নিজেদের স্বাক্ষর রেখে গিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে মঞ্চে তোলা হয়। তাঁরা সেজেছিলেন কালজয়ী পোশাকশিল্পীদের বানানো পোশাকে। লিজ়া রে, ইন্দ্রাণী দাশগুপ্ত, লিজ়া হেডন-সহ আরও অনেকে।

উৎসবের শেষ দিনে মঞ্চে উঠলেন বিখ্যাত পোশাকশিল্পীরা।

উৎসবের শেষ দিনে মঞ্চে উঠলেন বিখ্যাত পোশাকশিল্পীরা। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

পর্দা ফেলার আগে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ান প্রত্যেক পোশাকশিল্পী। ফ্যাশন-যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নপূরণের আশায় হাতে হাত রাখেন তাঁরা। ইতিহাসে লেখা থাকবে এই উৎসবের রজতজয়ন্তীর শেষ রাত।

(লেখক কলকাতার পোশাকশিল্পী)

Abhishek Roy designer Kolkata designer abhishek lakme fashion week fashion in kolkata Prosenjit chatterjee in lakme fashion week

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}