গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কবি হয়েছেন, এমন ঘটনা আমরা জানি। কিন্তু কবিতা ছেড়ে দিয়ে আঁকজোক করতে শিখেছেন, এমন উদাহরণ বোধ হয় সারা পৃথিবীতে মাত্র একটিই আছে।
আবার যে-সে আঁকজোক নয়। পাঠশালার নামতা বা কলেজের জ্যামিতিও নয়। এ হল সেই অঙ্ক, যা মানুষের চিন্তাকে জ্ঞানের সীমান্তে নিয়ে যায়। সেই অনাবিল জ্ঞান, যা পরিচিত যুক্তি-তর্কের সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে।
জুন হা। আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের স্যর। এ বছর ফিল্ডস মেডেল পেয়েছেন। অঙ্কের চর্চায় বিশেষ অবদানের জন্য চার বছর অন্তর দেওয়া হয় এই পুরস্কার। চল্লিশ-অনূর্ধ্ব বিজ্ঞানীরা পেয়ে থাকেন এই পদক। চার বছরে এক বার দেশবিদেশের অঙ্কের গবেষকরা জড়ো হন পৃথিবীর কোনও একটি শহরে। হয় অঙ্কের সবচেয়ে নামী কনফারেন্স। ‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ম্যাথামেটিশিয়ান্স’-এর জমায়েতেই ঘোষণা করা হয় সে বছরের ফিল্ডস মেডেল জয়ীদের নাম।
জ্ঞানের স্বীকৃতিতে এই সম্মানকে ধরা হয় নোবেল পুরস্কারেরও উপরে। জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে থাকলেও অঙ্কে নোবেল দেওয়ার চল নেই। এর পিছনে একটি সামগ্রিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। অ্যালফ্রেড নোবেল নাকি শুধু এমনই বিজ্ঞানীদের কাজকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন, যাঁদের গবেষণায় উন্নত হবে সাধারণের জীবন। আর সে কারণেই একটি প্রচলিত মশকরাও রয়েছে। অনেকেই আলোচনা করে থাকেন, অ্যালফ্রেড নোবেলের স্ত্রী এক গণিতবিদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আর সেই রাগেই নোবেলজয়ীদের তালিকায় কখনও জায়গা পান না কোনও গণিতজ্ঞ। এ তথ্যে অবশ্য খানিক ভুল আছে। অ্যালফ্রেড নোবেল কখনও বিয়ে করেননি। তবে তাঁর প্রেমিকা কোনও গণিতজ্ঞের প্রেমে পড়ে থাকতেই পারেন!
ফিল্ডস মেডেল পেয়ে খানিকটা অবাক জুন হা।
নোবেল পুরস্কার না থাকলেও গণিতচর্চায় স্বীকৃতি দেওয়া শুরু হতে খুব সময় লাগেনি। প্রথম নোবেল দেওয়া হয়েছিল ১৯০১ সালে। আর তার ৩৫ বছরের মাথায় চালু হয় ফিল্ডস মেডেল। নোবেল পাওয়ার কোনও বয়সের সীমা নেই। কিন্তু ফিল্ডস মেডেল দেওয়া হয় বয়স ৪০ পার হওয়ার আগে। অর্থাৎ, যাঁরা কম বয়সে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, তাঁরাই পান এই সম্মান।
জুন সে কারণেই অবাক হয়েছেন এমন স্বীকৃতি পেয়ে। তিনি যে মন দিয়েই অঙ্ক করেন, তা তাঁর নিজেরও অজানা নয়। তাই বলে এমন সম্মান! তিনি তো কখনও এত গোছানো জীবনে অভ্যস্ত নন।
ছোটবেলায় জুন অঙ্ক করতেই ভালবাসতেন না। বাবা ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ায় রাশিবিজ্ঞানের শিক্ষক। তিনিই অঙ্ক করতে বসাতেন স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে। কিন্তু ও সব অঙ্ক কষতে ভাল লাগত না জুনের। বইয়ের পিছনের পাতায় যেখানে উত্তর দেওয়া থাকত, সেখান থেকে উত্তর টুকে দিতেন জুন। এক দিন রাগ করে বইয়ের পিছনের পাতাগুলি ছিঁড়ে দেন বাবা। কিন্তু তা বলে কি তাঁর পুত্র অঙ্ক কষে সময় নষ্ট করবেন? জুন একেবারে বইয়ের দোকানে গিয়ে অঙ্কের উত্তর টুকে নিয়ে চলে আসতেন। এর পর অবশ্য হাল ছেড়ে দেন বাবা।
এ সব শুনলে তো মনে হবে, এই মানুষটি স্বভাবকবি। এর জীবনে আবার অঙ্ক এল কোথা থেকে?
সারাদিনে মাত্র তিন ঘণ্টা কাজ করেন জুন। তার মধ্যেই লেখাপড়া, বা়ড়ির কাজ, সন্তানদের যত্ন।
কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি নিজেই। কবিতা লিখতে লিখতে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিলেন। এক সময়ে মনে হয়েছিল, সেরা কবিতা লেখার দিকে যত না মন যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা বাড়ছে। সাহিত্য জীবনে ছন্দপতন। ‘রিবাউন্ড’ সম্পর্কের মতো চলে আসে অঙ্ক। কবিতা স্বার্থপর করে। অঙ্ক সে সুযোগ দেয় না। কবিতায় শব্দ আছে, যা নিজের মতো ব্যবহার করা যায়। অঙ্ক সংখ্যানির্ভর। সংখ্যা নিরপেক্ষ।
কবিতা ছাড়ার পর জুন প্রথমে ভেবেছিলেন বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করবেন। তার পর ঠিক করেন পদার্থবিদ্যা আর জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা করবেন। কিন্তু দু’টির মধ্যে কোনটি ভাল পারেন, তা নিয়ে দ্বন্দ্বে ছিলেন।
কবিতা গেল। পদার্থবিদ্যা গেল। জ্যোতির্বিদ্যাও গেল। ঠিক করলেন, সংখ্যা নিয়ে নাড়াচাড়া করবেন। ছ’বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করেন জুন। গণিতের বৃহৎ জগতের প্রতি আকৃষ্ট হন। জ্যামিতি নিয়ে কথা বলতে বলতে বুঝতে পারেন যে, গোটা ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে আলোচনা করা যায়। উপলব্ধি করেন, গণিতচর্চা তাঁকে সেই সুখ দিতে পারে, যা কবিতা পারেনি।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে। কিন্তু অঙ্কের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক খুব দূরের নয়। স্বয়ং পল ভ্যালেরি, যাঁকে বলা যেতে পারে কবিদের কবি, কবিতা লেখা বন্ধ করে ২০ বছর শুধু অঙ্ক কষেছেন। আমাদের বিনয় মজুমদার এ ব্যাপারে সব্যসাচী। কবিতা লিখতেন, অঙ্কও করতেন। কবি জয় গোস্বামী বলেন, ‘‘তিনি ঝড়ের বেগে, ঘোরের মধ্যে কবিতা লিখতেন। আবার একই ভাবে ঝড়ের গতিতে অঙ্ক কষে যেতেন। খাতার পর খাতায়।’’
জয় নিজে কিন্তু অঙ্ক করতেন না। তিনি বলেন, ‘‘পরিচিতদের মাধ্যমে কিছুটা গণিত বোঝার চেষ্টা করি মাত্র। অঙ্ক আমি করতে পারতাম না।’’
জুন কবিতা না হয় ছাড়লেন। কিন্তু লং কোভিডের মতোই তাঁকে ছাড়ল না কবিসুলভ পাগলামি। সারাদিনে মাত্র তিন ঘণ্টা কাজ করেন জুন। তার মধ্যেই লেখাপড়া, বাড়ির কাজ, সন্তানদের যত্ন। মনে করেন, এর চেয়ে বেশি সময় ধরে কাজ করলে সে কাজ ভাল হয় না। দিনের বাকি অংশ নিজের মতো কাটান। আর যা-ই করুন না কেন, ‘কাজ’ করেন না!
তাই বলে মাত্র ঘণ্টা তিনেক লেখাপড়া করে সোজা ফিল্ডস মেডেল! এমনও হয়?
ছোটবেলায় অঙ্ক করতেই ভালবাসতেন না জুন। হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবাও।
স্নাতকোত্তর স্তরে মূলত অ্যালজেব্রেইক জ্যামিতি নিয়ে লেখাপড়া করেছিলেন জুন। পরবর্তী কালে সেই কাজই এগিয়ে নিয়ে যান। চলে গবেষণা। অ্যালজেব্রেইক জ্যামিতির যোগাযোগ স্থাপন করেন কম্বিনেটরিক্সের সঙ্গে। ফিল্ডস মেডেল পাওয়াও সেই সূত্রেই। তবে সবই হয়েছে দিনে সেই তিন ঘণ্টা কাজের মধ্যে।
সাধারণত পণ্ডিতমশাইরা কিন্তু একেবারেই এমন নন। নাওয়াখাওয়া ভুলে তাঁরা শাস্ত্রচর্চা করেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসু সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে। সন্ধ্যাবেলায় নিজের ঘরে বসে পদার্থবিদ্যা আর অঙ্ক নিয়ে চর্চা করছেন। বিকেলের চা-ও খাননি। ৭টা নাগাদ গৃহভৃত্য এসে বললেন, ‘‘মা খুব রাগারাগি করছেন। আপনার জন্য খাবার পাঠিয়েছেন। খেয়ে নিন।’’ বিজ্ঞানী লেখাপড়া থেকে মুখ না তুলেই বললেন, ‘‘রাখ ওখানে।’’
পরের দিন সকালে ভৃত্য ঘরে গিয়ে বললেন, ‘‘বাবু খাবার...।’’ সঙ্গে সঙ্গে প্রবল রেগে বিজ্ঞানী বললেন, ‘‘তোকে বললাম তো, ওখানে রাখ!’’ ইতিমধ্যে যে সাত-আট ঘণ্টা কেটে গিয়েছে, রাত গড়িয়ে ভোর হয়েছে, সে খেয়াল নেই তাঁরা। সত্যেন এসরাজ বাজাতেন। কবিতা কিন্তু লিখতেন না।
এখনকার বিজ্ঞানীরাও অবশ্য কম যান না। কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট’-এর ঋতব্রত মুন্সী গাড়িতে যেতে যেতে অঙ্ক করেন। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠেও জটিল ইকুয়েশনের সমাধান করেন। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘এক এক জনের কাজ করার ধরন এক এক রকম হয়। কেউ টানা অনেক ক্ষণ কাজ করেন। আবার আমিই যেমন কয়েক ভাগে কাজ করি। খানিকটা নিজের অফিসে বসে করি। বাকিটা বাড়িতে গিয়ে। কাজ চলতেই থাকে।’’ সব মিলিয়ে আট-দশ ঘণ্টা তো হবেই।
শুধু বঙ্গের বিজ্ঞানীরা নন, বিদেশের গবেষকরাও তেমনই। ইউরোপের লুক্সেমবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার বাঙালি অধ্যাপক অনুপম সেনগুপ্তও দিনরাত এক করে কাজ করেন। বাড়ি গিয়ে মাঝে শিশুপুত্রের দেখাশোনা করে মাঝেমধ্যেই রাতে আবার অফিসে ফেরেন। অনুপম বলেন, ‘‘কোনও কাজ শুরু করলে ঘণ্টার হিসেব রাখি না। ঘুম আসে না। আবার কখনও কখনও রাতে নিজের অফিসে ঘুমাই।’’ দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করেই থাকেন তিনি।
তবে বাঙালি বিজ্ঞানীরা যা-ই বলুন, ধরে নেওয়া যায় বাঙালি করণিককুল খুব অখুশি হবে না। কারণ, সরকারি কর্মচারীরা কাজ ছাড়া আর সবই করেন (জ্যোতি বসু এক বার রাগ করে বলেছিলেন, ‘‘কাকে কাজ করতে বলব! চেয়ার-টেবিলকে?’’)। যদি নামমাত্র সময় দিয়ে কাজ করেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হওয়া যায়, তা হলে বাঙালি করণিকরা আর কী দোষ করলেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy