Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
reading

রাস্তাঘাটে বাংলা বই ‘পড়তে নেই’, একে ফ্যাশন বলে দুষছেন অনুপম-ঋদ্ধিরা

বই পড়ার ক্ষেত্রে কি তাঁদের কাছে ব্রাত্য মাতৃভাষা? নাকি শুধুমাত্র রাস্তায় তাঁরা ইংরেজি বই পড়েন?

রাস্তায় বই পড়লে, সেখানে কি ব্রাত্য বাংলা ভাষা?

রাস্তায় বই পড়লে, সেখানে কি ব্রাত্য বাংলা ভাষা? ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৬:৫৭
Share: Save:

দৃশ্য ১: মেট্রোর দুই কামরার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে বই পড়ছে বছর কুড়ির এক যুবক। ট্রেন আচমকা ব্রেক কষায় হাত থেকে ছিটকে পড়ল পেপারব্যাক। দেখা গেল বইয়ের নাম ‘নরওয়েজিয়ান উড’। লেখকের নাম হারুকি মুরাকামি।

দৃশ্য ২: মধ্য কলকাতার এক কাফে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মুখের সামনে এক বই তুলে ধরেছেন তিরিশের কোঠার তরুণী। কাফের বাইরের রাস্তা থেকে মলাট স্পষ্ট। লেখক হেনরি মিলার। বইয়ের নাম ‘ট্রপিক অব ক্যানসার’।

দৃশ্য ৩: বারাসত থেকে বিমানবন্দরগামী বাস জানলার ধারে বসে বই পড়ছে স্কুল ফেরত এক পড়ুয়া। নির্দিষ্ট স্টপেজ আসছে টের পেতেই কোলের উপরে রাখা বই বন্ধ করে ব্যাগে ঢোকাল সে। বইয়ের নাম ‘আ স্টর্ম অব সোর্ডস’। লেখক জর্জ আর আর মার্টিন।

৩টি দৃশ্যের ৩ জনের নাম যথাক্রমে সাত্যকি বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বাতীলেখা বসু এবং সৌরভ দত্ত। নাম থেকেই পরিষ্কার, ৩ জনেই বাঙালি। কথাও বলেন স্পষ্ট বাংলায়। কিন্তু বই পড়ার ক্ষেত্রে কি তাঁদের কাছে ব্রাত্য মাতৃভাষা? নাকি শুধুমাত্র রাস্তায় তাঁরা ইংরেজি বই পড়েন? বাংলা বই পড়তে গেলে, তা কি শুধু বাড়িতে সীমাবদ্ধ?

সাত্যকির বক্তব্য, বন্ধুদের মধ্যে যত জন বই পড়েন, তাঁদের বেশির ভাগই ইংরেজির পাঠক। তাই তাঁদের সঙ্গে বই নিয়ে কথা বলতে বলতে ইংরেজি বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে। বাংলার বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়েনি। সৌরভ ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের ছাত্র। ‘‘বাবা-মা বাংলা বই পড়েন। আমি ভাল করে পড়তে পারি না। কিন্তু গল্পের বই পড়তে ভাল লাগে। তাই ইংরেজি বই’’, বক্তব্য তাঁর। আর স্বাতীলেখার দাবি, তিনি নিয়মিত বাংলা বই পড়েন। কিন্তু তার বেশির ভাগই বাঁধাই করা (হার্ডবাউন্ড)। তাই বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে পড়া সম্ভব নয়।

স্মার্টফোনের জমানা শুরু হওয়ার পর থেকে এমনিতেই বই পড়ার প্রবণতা কমেছে। রাস্তায় বা যানবাহনে এখন বই পড়তে খুব কম মানুষকেই দেখা যায়। যে ক’জন পড়েন, তাঁদের অধিকাংশের হাতেই ইংরেজি বই। এর কারণ কি বাংলার প্রতি অনীহা, নাকি ইংরেজি বই জনসমক্ষে পড়ার মধ্যে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার প্রবণতা রয়েছে? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এমনই প্রশ্ন তুলল আনন্দবাজার ডিজিটাল। মনোবিদ জয়িতা সাহা বলছেন, ‘‘এখন বহু বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পড়াতে চান। বাংলা পড়লে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত— এমন একটা ধারণা অনেকের মনেই জন্মেছে। এই সব বাড়ির ছেলেমেয়েদের অনেকেই বাংলাটা পড়তে জানেন না। ফলে গল্পের বই পড়তে গেলে, ইংরেজিই তাঁদের ভরসা।’’

চিত্রটা যদি এ রকম হয়, তা হলে বাংলার পাঠকের সংখ্যা যে কমেছে— এটা মেনে নিতে হবে। এমনই মত গায়ক অনুপম রায়ের। ‘‘বাংলা ভাষা নির্ভর কাজ করলে ভবিষ্যৎ যতটা উজ্জ্বল হবে, ইংরেজি বা বিদেশি ভাষায় করলে তার চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল হবে— এটাই ধরে নিচ্ছেন অনেকে। ফলে ছোট বয়স থেকেই শিশুদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইংরেজি বই। গল্পের বই পড়তে গেলেও সেই শিশুরা বেছে নিচ্ছে ইংরেজিকেই’’, বলছেন অনুপম।

দেখনদারির জন্যই কি ইংরেজি বইয়ের প্রতি প্রেম?

দেখনদারির জন্যই কি ইংরেজি বইয়ের প্রতি প্রেম? ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু বিষয়টা কি শুধুমাত্র বাংলা না জানার? নাকি অন্য কোনও মানসিকতাও কাজ করে এর পিছনে? জয়িতার মতে, ঔপনিবেশিক মানসিকতার একটা ভূমিকাও আছে এর পিছনে। ‘‘যা পাশ্চাত্যের, তা ভাল— এমন ধারণা তেকেই তো মানুষ এখনও সাদা ত্বক পাওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের ক্রিম ব্যবহার করেন। ইংরেজি বইয়ের ক্ষেত্রেও তা-ই। প্রকাশ্যে ইংরেজি বই পড়ছি মানে, আমি বাকিদের থেকে এগিয়ে। এ রকম একটা মনোভাব তো অনেকর মধ্যেই আছে’’, মত তাঁর। তবে অনুপমের মতে, ‘‘স্টাইলের জন্য যদি কেউ প্রকাশ্যে বই পড়েন, সেটা অন্য বহু ভাবে স্টাইল দেখানোর থেকে ভাল। কিন্তু যদি ধরে নিই, যাঁরা প্রকাশ্যে বই পড়ছেন, তাঁদের ২০ শতাংশ প্রকৃতই পাঠক— তা হলেও বুঝতে হবে, বাংলা ভাষার সঙ্গে পাঠকের দূরত্ব বাড়ছে।’’

প্রকাশ্যে ইংরেজি বই পড়ার ক্ষেত্রে প্রদর্শনের মানসিকতা কতটা কাজ করে? অভিনেতা ঋদ্ধি সেন বলছেন, ‘‘কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের কাছে এ ধরনের ক্ষেত্রে পড়ার চেয়ে দেখানোটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু পথঘাটে নয়, নেটমাধ্যমেও বই হাতে ছবি পোস্ট করলে এমন মানসিকতা কাজ করে।’’ ইংরেজি ভাষা বা বাংলা বই পড়া, সিনেমা দেখার মধ্যে কোনও ভেদাভেদ করতে চান না ঋদ্ধি। তবে তাঁর মতে, মাতৃভাষার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের যোগাযোগ যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তার পিছনে বাবা-মা এবং স্কুলগুলোর ভূমিকা রয়েছে। অভাব রয়েছে সচেতনতার।

মোদ্দা কথায়, মাতৃভাষা দিবসে মায়ের ভাষার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের দূরত্ব, মায়ের ভাষায় লেখা বইকে প্রকাশ্যে ভালবাসতে না পারার পিছনে কেরিয়ার-কেন্দ্রিক মানসিকতা এবং সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন এই ৩ জন।

অন্য বিষয়গুলি:

reading International Mother Language Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy