রক্তপরীক্ষা করে দেখে নেওয়া হয় মায়ের শরীরে কোনও রকম সংক্রমণের উপস্থিতি আছে কি না।
জীবন কখনও এক রেখায় চলে না। নানা পর্যায়ে তাতে নানা বাঁক আসে। কিছু থাকে অপ্রত্যাশিত, তার জন্য আগাম প্রস্তুতির সময় মেলে না। আর কিছু প্রত্যাশিত, একটু ভাবনাচিন্তা করলেই সুন্দর ভাবে সেই নতুন পর্বটিকে গ্রহণ করা যায়। যেমন বিয়ে। তাকে ঘিরে কত পরিকল্পনা, কত স্বপ্ন বোনা। ঠিক তেমনই দম্পতির জীবনে প্রথম সন্তান আসার আগেও কিছু ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন হয়, পোশাকি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং’। বিশেষ করে একটি মেয়েকে এই সময়ে মনের সঙ্গে শারীরিক ভাবেও নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। কারও আগে থেকে কোনও অসুস্থতা থাকলে, অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ফ্যামিলি প্ল্যানিং শুরু করা উচিত। এই বিষয়ে আমরা কথা বললাম স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
কী কী দেখতে হবে
গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার পর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথমেই রক্তের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস করে দেখে নেওয়া উচিত থ্যালাসেমিয়া স্টেটাস। হবু মা যদি থ্যালাসেমিয়া বাহক হন, তা হলে বাবাকেও পরীক্ষা করাতে হবে। কারণ, দু’জনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় যথেষ্ট বেশি। এবং করাতে হবে রুবেলা আইজিজি পরীক্ষা। কারও যদি রুবেলা ইমিউনিটি না থাকে, তাঁকে রুবেলা ভ্যাকসিন দিয়ে তিন মাস পর গর্ভধারণের পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ, রুবেলা এমন এক রোগ, যেটা মায়ের হলে বোঝা যাবে না। কোনও উপসর্গ থাকবে না। কিন্তু গর্ভস্থ বাচ্চার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট থেকে হার্টে ফুটো-সহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেই জন্য মাকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। একই সঙ্গে রক্তপরীক্ষা করে দেখে নেওয়া হয় মায়ের শরীরে কোনও রকম সংক্রমণের উপস্থিতি আছে কি না।
পেরিকনসেপশনাল কাউন্সেলিং
ফ্যামিলি প্ল্যানিং শুরু করার পরে হবু মায়ের যদি সুগার বা প্রেশারের সমস্যা থাকে, তা হলে সেটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। যাঁরা সুগার, প্রেশার বা থাইরয়েডের ওষুধ নিয়মিত খান, দেখে নিতে হবে তাঁদের ওষুধ গর্ভাবস্থায় নিরাপদ কি না। কয়েক ধরনের ওষুধ গর্ভাবস্থায় খেলে তা গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শমতো গর্ভাবস্থার পক্ষে নিরাপদ ওষুধ খাওয়া শুরু করতে হবে। এ সময় থেকে ফলিক অ্যাসিড খাওয়াও শুরু করতে বলা হয় মাকে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গর্ভধারণের আগে থেকেই যদি ফলিক অ্যাসিড খাওয়া শুরু করা যায়, তা হলে ‘নিউরাল টিউব ডিফেক্ট’ হয় না।
মায়ের হাইপো থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে বাচ্চার ব্রেন ডেভলপমেন্টে সমস্যা তৈরি হতে পারে। সুতরাং, থাইরয়েড লেভেলকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনাও একান্ত প্রয়োজন। ডা. চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ইদানীং অনেক মহিলাই অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট খান। বিশেষত লকডাউনের পরে এই প্রবণতা যথেষ্ট বেড়েছে। তাঁদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণের পরিকল্পনা শুরু করার সময় থেকেই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই সব কারণেই এই পর্যায়ে ‘পেরিকনসেপশনাল কাউন্সেলিং’-এর প্রয়োজন আছে।
এ ধরনের কাউন্সেলিংয়ে শুধুমাত্র ওষুধই নয়, জোর দেওয়া হয় স্বাস্থ্যকর অভ্যেস গড়ে তোলার উপরে। যেমন, কারও ওজন বেশি থাকলে তাঁকে তা কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এর সঙ্গে হাঁটাহাঁটি, হাল্কা ব্যায়াম শুরু করা যেতে পারে। সঙ্গে স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া করতে হবে।
কাউন্সেলিংয়ে ইন্টারকোর্সের উপযুক্ত সময় নিয়ে সচেতন করা হয় ভাবী মা-বাবাকে। সাধারণত পিরিয়ডসের ১২ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে ইন্টারকোর্সের পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই সময় মায়ের শরীরে ওভিউলেশন বা এগস তৈরি হয়। সুস্থ সন্তান জন্মানোর সম্ভাবনাও বাড়ে।
মিসক্যারেজের পর
ডা. চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, চিকিৎসকের কাছে যদি পাঁচ জন হবু মা প্রথম ট্রাইমেস্টারে প্রেগন্যান্সি নিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্যে এক জনের মিসক্যারেজ হবে। এই হার এতটাই বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর জন্য দায়ী এগ আর স্পার্মের সুস্থ ভ্রূণ তৈরি করতে না পারা। ফলে প্রাকৃতিক নিয়মেই শরীর তা বার করে দেয়। এক বার মিসক্যারেজ হলে চিকিৎসকরা সাধারণত কারণ অনুসন্ধান করেন না। কিন্তু বারবার মিসক্যারেজ হতে থাকলে, যাকে বলা হয় ‘রেকারেন্ট প্রেগন্যান্সি লস’, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা কারণ খোঁজার চেষ্টা করেন। সাধারণত চারটি কারণ দায়ী করা হয়—
জরায়ুর কোনও জন্মগত ত্রুটি। থ্রি-ডি আল্ট্রাসাউন্ডে তা ধরা পড়ে।
মা-বাবার জিনগত সমস্যা। রক্তপরীক্ষায় তা ধরা পড়ে।
ভ্রূণটির নিজস্ব কোনও জিনগত ত্রুটি।
অনেক সময়ে প্রেগন্যান্সি এলে মায়ের জরায়ুতে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা থেকেও মিসক্যারেজ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্লাড থিনার জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। কারণ জানা থাকলে সেইমতো চিকিৎসা করলে সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৮০ শতাংশেরও বেশি।
মা জটিল অসুখে আক্রান্ত হলে
জটিল অসুখ মানেই সন্তানধারণ করা যাবে না, এমনটা নয়। কিছু সতর্কতা মেনে চললে সাধারণত কোনও সমস্যা দেখা দেয় না। যেমন, মা অটোইমিউন ডিজ়িজ়ে আক্রান্ত হলে দেখে নিতে হবে, তিনি কোন ধরনের ওষুধ খাচ্ছেন। মেথোট্রেক্সেট জাতীয় ওষুধ খেলে সাধারণত গর্ভধারণ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। একমাত্র লো ডোজ়ের কর্টিকোস্টেরয়েড চললে গর্ভধারণে সমস্যা হয় না। কারণ এতে বাচ্চার কোনও ক্ষতি হয় না। তবে যদি প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে মায়ের ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যায়, তা হলে চিকিৎসকরা সন্তানধারণ করতে বারণ করেন। তখন সারোগেসির কথা ভাবতে বলা হয়।
মা অতীতে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন, অথচ এখন ঠিক আছেন, এমন অবস্থায় গর্ভধারণে সমস্যা হয় না। তবে অবশ্যই ক্যানসারের চিকিৎসা চলাকালীন গর্ভধারণ সম্ভব নয়। কেমোথেরাপি বা রেডিয়োথেরাপির মতো চিকিৎসা মিসক্যারেজ করিয়ে দেয়। সুতরাং, আগে থেকে একটু পরিকল্পনা করে, পরামর্শ মেনে চললে সন্তানধারণের ক্ষেত্রে অনেক অপ্রয়োজনীয় সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মায়ের তো বটেই, সন্তানের সুস্থ ভবিষ্যতের জন্যও তা জরুরি বইকি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy