পরিস্থিতি সহজ নয়। অতিমারির সঙ্গে লড়াই চলছে গোটা বিশ্বের। দেশে আছড়ে পড়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। আগের বারের চেয়ে এ বার বেশি সংক্রামক কোভিড ১৯ ভাইরাস। গত কয়েক সপ্তাহে দেশে করোনা আক্রান্তের রেখচিত্র ঊর্ধ্বমুখী। আর এই গ্রাফে এ বার নজরে পড়ছে করোনা আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা। আগের বারের চেয়ে এ বার শিশুদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি।
করোনা পরিস্থিতিতে শিশুরা কতটা নিরাপদ?
মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘আমার কাছে এমন অনেক পরিবার আসছেন, যাঁদের মধ্যে মা-বাবা ও সন্তান... সকলের করোনা রিপোর্টই পজ়িটিভ। দশ থেকে আঠেরোর মধ্যে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা এ বার অনেক বেশি। আগের বার মা-বাবা আক্রান্ত হলেও দেখা গিয়েছে, সন্তানের হয়তো কিছু হয়নি। এ বার কিন্তু চিত্রটা বদলাচ্ছে। পরিবারের একজনের করোনা হলেই সেই পরিবারের শিশুরও করোনা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। এর থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, কিয়দংশে এই ভাইরাস বায়ুবাহিত হতেও পারে।’’ এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, কোভিড-১৯-এর জন্য দায়ী সার্স-কোভ-টু ভাইরাস বায়ুবাহিত বলে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক জার্নাল ল্যানসেট। সেই গবেষণা থেকে উঠে এসেছে কিছু তথ্য— কোভিড আক্রান্তের ঘরের বাতাসে পাওয়া গিয়েছে ভাইরাস, কোভিড হাসপাতালের এয়ার ফিল্টারেও পাওয়া গিয়েছে এই ভাইরাস। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তি পাশের ঘরে রয়েছেন, তাঁর মুখোমুখি না হয়েও পরিবারের কোনও সদস্য করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে মা-বাবার কাছ থেকে শিশুর সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে গবেষণা চলছে।
শিশুদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার প্রসঙ্গে শিশুচিকিৎসক ডা. অপূর্ব ঘোষ বললেন, ‘‘শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হলে কখনও উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, কখনও দেখা দিচ্ছে না। শিশুদের করোনা হলে তা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে বোঝাও একটু কঠিন। কারণ ওদের সোয়াব টেস্ট করা কষ্টকর। অনেকের জ্বর আসছে বা কোনও উপসর্গ দেখা দিলে, তার থেকে আন্দাজ করে টেস্ট করতে দেওয়া হচ্ছে। শিশুদের নিউমোনিয়া হলে বা বুকে জল জমতে দেখা গেলে আগে হয়তো অন্য কিছু ভাবা হত না। কিন্তু এখন টেস্ট করা হচ্ছে। আবার কারও সার্জারির আগে করোনা টেস্ট করতে দিলে হয়তো রিপোর্ট পজ়িটিভ আসছে।’’
করোনার নতুন স্ট্রেনই কি দায়ী?
এসএসকেএম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান তথা রাজ্যের কোভিড মনিটরিং দলের নোডাল অফিসার সৌমিত্র ঘোষ একটি দিক উল্লেখ করলেন, ‘‘এ বার করোনা সুপার স্প্রেডার হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে ভাইরাসটির জেনেটিক মিউটেশন ঘটেছে। সে চরিত্র বদল করে নতুন রূপে এসেছে। আর এ বার দেখা যাচ্ছে ডাবল মিউট্যান্ট ভ্যারাইটি। এরা অনেক বেশি ছোঁয়াচে ও ইনফেকশন বেশি হচ্ছে। গত বারও বাচ্চাদের মধ্যে করোনা দেখা গিয়েছিল, কিন্তু তার সিভিয়রিটি এত বেশি ছিল না। এ বার শিশুদের হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন পড়ছে বেশি। সর্দি-কাশির তুলনায় ডায়েরিয়া নিয়ে ভর্তি হচ্ছে অধিকাংশ শিশু। আর একটা কথা মনে রাখবেন, শিশুদের মধ্যে ইনফেকশন থাকলে তাঁরা অন্যদের কাছেও ইনফেকশন বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে শিশুরা যেমন নিজেরা আক্রান্ত হচ্ছে, তেমনই বাহকও হচ্ছে এই ভাইরাসের। কারণ মা-বাবা থেকে শুরু করে দাদু, দিদিমা, ঠাকুমা... সকলের কাছেই ওদের অবাধ যাতায়াত।’’
করণীয় কী?
• এই যুদ্ধের বর্ম মাস্ক। এই বিষয়ে সহমত প্রায় সব চিকিৎসক। মা-বাবাকে রোজ নানা কাজে বাইরে যেতে হয় বা বাইরের লোকের সম্মুখীন হতে হয়। মা-বাবা মারফতই ছোটদের সংক্রমণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তাই মা-বাবাকে মাস্ক পরে থাকতে হবে। সন্তান বড় হলে তাকে আলাদা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করাই ভাল। সন্তান যদি বয়সে ছোট হয়, তাকে তার মতো করে বিষয়টা বোঝাতে হবে। সন্তান ব্রেস্টফিড করলে মাকে এবং কেয়ারগিভারকে মাস্ক পরতে হবে। কোলের শিশুকে মাস্ক পরানো সম্ভব নয়, তাই পরিবারের সদস্যদের এটুকু কষ্ট করতেই হবে। শিশুর দুধের বোতল থেকে শুরু করে জামাকাপড়, বিব, খেলনা ধরার আগেও হাত স্যানিটাইজ় করতে হবে। কারণ বাচ্চারা প্রায় সবই মুখে পুরে দেয়।
• তিন বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স, তাদের চেনা গণ্ডির মধ্যেই রাখতে হবে অর্থাৎ বাড়ির মধ্যে। বাইরে আরও দশটা শিশুর সঙ্গে খেলতে গেলে সে মাস্ক পরছে কি না, কখন খুলছে, তার খেলার সঙ্গীরা মাস্ক পরেছে কি না... সব কিছু নজরে রাখা সম্ভব নয়। সেখানে যে শিশুরা খেলতে আসছে, তাদের মধ্যে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলেও উপসর্গহীন হতে পারে। ফলে তার কাছ থেকেও সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। তাই পরিস্থিতি কিছুটা ঠিক না হওয়া অবধি বাড়িতেই ওদের খেলাধুলোর ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা করতে পারেন। এতে কিন্তু ওদের মন ভাল থাকবে।
• রাস্তাঘাটে না বেরিয়ে অনেকেই হাউসপার্টি করছেন। সে সবও এখন বন্ধ রাখতে হবে। কারণ সেখানে আর পাঁচ জন যাঁরা আসছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ করোনায় আক্রান্ত কি না সে বিষয়ে কিন্তু আপনি নিশ্চিত নন।
• আর একটি বিষয় মাথায় রাখতে বললেন ডা. অপূর্ব ঘোষ, ‘‘অনেক বাড়িতেই শিশুটি দাদু, ঠাকুমা, দিদিমা অর্থাৎ বাড়ির প্রবীণদের কাছেই বেশি সময় থাকে। তাদের কোলেপিঠে ওঠে, খেলা করে। এ সময়ে বয়স্কদের কাছে শিশুদের বেশি পাঠাবেন না। কারণ শিশুরা কিন্তু করোনার বাহক হতে পারে, সে করোনায় আক্রান্ত হলেও উপসর্গহীন হতে পারে। ফলে বাড়ির বয়স্কদের ঝুঁকি বাড়বে।’’
পরিবারে টিকাকরণ হয়ে গেলে ঝুঁকি কতটা?
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯ প্রতিষেধকের প্রথম ডোজ় নেওয়ার পরেও সেই ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তা হলে টিকা কতটা কার্যকর? ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘প্রতিষেধকের দ্বিতীয় ডোজ় নেওয়ার দু’সপ্তাহ পর থেকে সুরক্ষা পাবেন। তাই প্রথম ও দ্বিতীয় দু’টি ডোজ়ই নিতে হবে।’’ ডা. সৌমিত্র ঘোষ বললেন, ‘‘টিকা কতটা কার্যকর, সেটা বুঝতে হবে। টিকা ১০০ শতাংশ কার্যকর বলে কিন্তু কেউ দাবি করছে না। টিকা নেওয়ার পরে কিছুটা সম্ভাবনা থেকেই যায় সংক্রমণের। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, টিকা নিলে তাঁদের এই সংক্রমণ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে না। টিকা নিলে মৃত্যুহার অনেক কমবে। সংক্রমণ হলেও মৃত্যু আটকানো যাবে। তাই টিকা নেওয়া জরুরি। আর টিকা নেওয়ার পরেও মাস্ক পরতে হবে। কারণ মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে এখনও বহু শতাংশ মানুষ টিকা নেননি। তাই নিয়মবিধি মেনে চলতেই হবে।’’
চিকিৎসকদের মতে, পরিবারের সুরক্ষায় সবচেয়ে বড় ঢাল হতে পারে মাস্ক। তাই সচেতন থাকুন। দূরত্ববিধি বজায় রাখুন। যতই কষ্ট হোক, নিয়ম মেনে মাস্ক পরে চলুন। তবেই কিন্তু আগামীর পৃথিবীতে নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারবে আপনার সন্তান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy