সাইবার বুলিয়িংয়ের শিকার হয়ে ভেঙে পড়বেন না। তা প্রতিরোধ করার উপায় ও পদক্ষেপ করার ব্যবস্থাও রয়েছে। জেনে নিন বিশদে
কেউ পিং করলে এখনও আঁতকে ওঠে পিয়া। আবার তার নামে কোনও কমেন্ট সেকশনে দীর্ঘ আলোচনা হচ্ছে! একটা ছোট সিদ্ধান্তের ভুল, সামান্য প্রগলভতার ফসল আজ এই ক্রমাগত উৎকণ্ঠায় বেঁচে থাকা।
একটা সময় ছিল যখন মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ সহজ ছিল না। ব্যক্তিগত পরিসর সীমাবদ্ধ ছিল মুষ্টিমেয় কয়েক জনের মধ্যে। তাই ভুল ঠিক সমস্ত কিছুর প্রতিক্রিয়াও সীমাবদ্ধ ছিল ছোট গণ্ডির মধ্যে। তার পরে আমাদের জীবনে এল ইন্টারনেট। ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো...’ ভাবধারার হাত ধরে এল স্ক্রিনের আড়াল থেকে আক্রমণ, এককথায় যাকে সাইবার বুলিয়িং বলে। সম্প্রতি, বিশেষ করে কোভিড পরিস্থিতিতে প্রতিটি মানুষই ভীষণ ভাবে সমাজমাধ্যম-নির্ভর হয়ে পড়েছেন। বাদ যায়নি কিশোর-কিশোরীরাও। লেখাপড়া, বিনোদন সব কিছুই এখন ইন্টারনেট নির্ভর। ফলে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই ধরনের আক্রমণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোজ তিন জনের মধ্যে অন্তত এক জন কিশোর বা কিশোরী সাইবার বুলিয়িংয়ের শিকার।
কেন করা হয় সাইবার বুলিয়িং?
মজার ব্যাপার হল, স্ক্রিনের আড়ালে থেকে একটা মানুষকে দল বেঁধে (যাকে সমাজমাধ্যমে গ্যাং-আপ বলা হয়) আক্রমণ করে মাটিতে তাঁর আত্মসম্মানটি মিশিয়ে দেওয়ার মধ্যে অদ্ভুত এক ক্ষমতার স্বাদ খুঁজে পান অনেকেই। বলা চলে, নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত অতৃপ্তি মিটিয়ে দিতে পারে এই আক্রমণ। একজনের কথায় অচেনা মানুষটি আহত হয়ে ক্রমশ গুটিয়ে যাচ্ছেন। আর তাঁকে আহত করার মধ্য দিয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও সেই ব্যক্তি নিজের অপূর্ণতা ভুলে থাকছেমন। ক্লাসিক বুলিয়িং ও সাইবার বুলিয়িংয়ে মানসিকতার কিন্তু বিশেষ হেরফের হয় না। দুই তরফেই যিনি আক্রমণ করেন, তিনি ভিতু। সাইবার বুলিয়িংয়ের সুবিধে হল, নিজেকে আড়াল করার জন্য একটি স্ক্রিন ও পরিচয়হীনতার ঢাল থাকে। তথাকথিত বিশ্বজগতের সামনে একটি মানুষের আত্মসম্মান ও অস্তিত্বের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া যায় মেঘনাদ সেজে। ফলে, এই ধরনের আক্রমণে ক্ষতির পরিমাণ কিঞ্চিৎ বেশিই। যদি একটি তালিকা বানানো যায়, তবে দেখা যাবে মূলত ছ’টি কারণে মানুষ এই ধরনের আক্রমণ করে থাকেন।
বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম জানালেন, সাইবার বুলিয়িংয়ে ভীষণ ভাবে ‘মব সাইকোলজি’ কাজ করে। কেউ হয়তো একটি বিশেষ মতামত নিয়ে চলে। সাধারণ ভাবে সে হয়তো সেটা নিয়ে মুখ খোলে না। কিন্তু সমাজমাধ্যমে সে যখন দেখছে আরও ৫০ জন একই মত দিচ্ছে, তখন তার মনে হয় সে ভুল হতেই পারে না। সেই ‘অ্যাবসলিউট’ ভাবনা থেকে বীজ বপন হয় অন্য এক জনকে হেনস্থা করার, যে ওই মতামত সমর্থন করে না।
আক্রান্তদের অনুভূতি
ফিরে দেখা যাক ‘আমরেলা’ কাণ্ড। মেয়েটি বানান কেন ভুল বলল, তার পিছনে শিক্ষাব্যবস্থার ভাঙন, পারিবারিক পরিস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই শুরু হল হাসির কলরোল। আমোদগেঁড়ে জনতা ভুলে গেল, মেয়েটির বয়স এবং পরিস্থিতি। খবরের ক্লিপটুকু শেয়ার হতে শুরু করল ঝড়ের বেগে, বাড়তি পাওনা সেই ক্লিপ দিয়ে বিবিধ মিম। ‘ভুল’ উদ্যাপনের উৎসাহে আমরা প্রায় সকলেই ভুলে গেলাম, এই আক্রমণ তার কাছেও পৌঁছচ্ছে। আঙুলের চাপে লাইক-কমেন্টের বন্যার তোড়ে ভেসে গেল মেয়েটির মানসিক স্বাস্থ্য। ‘নিছক’ মজা করার মানসিকতার কাছে হেরে গেল সহমর্মিতা, সর্বোপরি মানবিকতাও। ফলাফল? কয়েক দিন পরেই কাগজের খবর... আত্মহত্যার কথা বলছে ওই কিশোরী। ঘরের বাইরে বেরোতে চাইছে না সে।
এই ঘটনাটি নিয়েই জয়রঞ্জন রামের মত, “সাইবার বুলিয়িং মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে মানুষের মনে। বিশেষত বয়ঃসন্ধিতে ও কম বয়সে মানুষের কাছে সমাজ ও তার পারিপার্শ্বিকের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময়ে সে ধীরে ধীরে সমাজে নিজের স্থান খুঁজে নিচ্ছে। সেখানে এমন আঘাতে আসলে তার মানসিক স্থিতির কাঠামোটাই ভেঙে পড়তে পারে।”
প্রায় একই কথা শোনা গেল শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের সদস্য ও মনোবিদ যশোবন্তী শ্রীমানীর মুখে। তিনি বললেন, “সমাজমাধ্যমে যাঁরা এই বুলিয়িং করেন, তাঁরা মূলত নিজেদের কোনও অ্যাগ্রেশন প্রকাশ করতে এই পথ বেছে নেন। এই বুলিংয়ের শিকার যাঁরা হন, তাঁদের প্রথমেই চোট লাগে আত্মবিশ্বাসে। প্রাথমিক ভাবে তাঁদের এই ধারণা হয় যে এই ঘটনা একমাত্র তাঁদের সঙ্গেই হয়েছে, এই লড়াইয়ে তিনি একা। তাঁর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সেই ভাবনা থেকেই ধীরে ধীরে গুটিয়ে যাওয়া, অবসাদ, উৎকণ্ঠায় ভোগা ও এক সময়ে আত্মহত্যার কথা ভাবা।
তা হলে উপায়?
যশোবন্তী জানালেন, সাবধানতাই একমাত্র উপায়। প্রাথমিক ভাবে বাবা মাকে সতর্ক থাকতে হবে। একই সঙ্গে, বন্ধুর মতো মিশতে হবে সন্তানের সঙ্গে। বড়দেরই অনেক সময় প্রবণতা থাকে, ইন্টারনেটে অচেনা কারও সঙ্গে আলাপ হলে তাকে সহজে সব কথা খুলে বলা। সে ক্ষেত্রে বাচ্চাদের, বিশেষ করে কিশোর বয়সে এই প্রবণতা তৈরি হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। সেই বিষয়েই তাকে সতর্ক করতে হবে। পাশাপাশি এটা বোঝাতে হবে যে, সে একা নয়। যদি ভুল কথা বা ভুল পোস্ট সে করেই থাকে, তা হলে তার জীবন শেষ হয়ে যাবে না। বাবা মা যদি সন্তানের সঙ্গে একটু বেশি সময় কাটান, গল্পচ্ছলে ধীরে ধীরে জানতে চান তার কী হয়েছে... তা হলে অনেকাংশে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
অনেক সময়ে, এই ধরনের হেনস্থার শিকার হলে মানুষের মধ্যে ইমপালস কাজ করে। তার মনে হয় তার জীবন শেষ হয়ে আসছে, সেখান থেকেই আইসোলেশন ও সুইসাইডের ভাবনা। তখন বাবা ও মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব তাকে সাহস ও শক্তি জোগাবে। তা ছাড়া এখন সাইবার বুলিয়িংয়ের ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা যায়। ফলে, উপায় রয়েছে একাধিক পদক্ষেপ করার।
জয়রঞ্জন রামের মতে, প্রথমেই সাইবার দুনিয়া সম্পর্কে সতর্ক ও শিক্ষিত হতে হবে। সমাজে কী ভাবে চলতে হবে, তা বাবা-মা, শিক্ষক ও বন্ধুদের কাছ থেকে জানা যায়। তুলনায় সাইবার দুনিয়া অনেক নতুন, সেখানে নিজেদের ব্যবহার তথা ‘এটিকেট’ কী হবে, সেই বিষয়ে মাথা ঘামানোর একটা সময় এসেছে।
সমাজমাধ্যমে কাউকে আক্রমণ করে নিজেকে শক্তিশালী মনে হলেও দিনের শেষে আয়নার সামনে দাঁড়ালে দেখা যায়, অপূর্ণতা রয়েছে নিজের মধ্যে। তাই, পরস্পরকে রক্তাক্ত করার বদলে যদি অনুভূতির পাঠ শেখা যায়, তা হলে এই নতুন সাইবার সমাজও বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।
শ্রেয়া ঠাকুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy