এমন বাড়ির দৃশ্য খুব অস্বাভাবিক নয়, যেখানে একই ঘরে মা, বাবা, ছেলেমেয়ে সকলেই উপস্থিত। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। সকলেই যে যার ফোনে ব্যস্ত। এমনকি বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য হাতে ফোন ধরিয়ে দেওয়াটাও যেন দস্তুর হয়ে গিয়েছে। খেতে খেতে ফোন, হাঁটতে হাঁটতে কানে গান, শুয়ে শুয়ে চোখের সামনে সিনেমা... ইন্দ্রিয় বুঁদ হয়ে আছে মুঠোফোনের মায়ায়। অতিরিক্ত মোবাইলের ব্যবহার কি অজান্তেই অসুখ ডেকে আনছে? তার জন্য আগে ভাল করে জানতে হবে মোবাইলের খুঁটিনাটি।
মোবাইল কী ভাবে কাজ করে?
সাধারণত কল করা, মেসেজ পাঠানো, ছবি শেয়ার করার মতো কাজই ফোনে রোজ করা হয়ে থাকে। এই কাজগুলি করার সময়ে রেডিয়োওয়েভ এবং মাইক্রোওয়েভ নির্গত ও গ্রহণ করে মোবাইল। এই ওয়েভের রেঞ্জ প্রায় ৮০০ থেকে ২৬০০ মেগাহার্টজ়। অবশ্য দেশ ও ফোনের নেটওয়র্কের উপরে নির্ভর করে এই মাত্রার ওঠানামা। এই মাইক্রোওয়েভ থেকেই কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত। সহজ ভাবে বলতে গেলে ‘বেনীআসহকলা’কে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। বেনীআসহকলার লালের ওয়েভলেংথ সবচেয়ে বেশি। ফলে তা অনেক নিরাপদ। অন্য দিকে বেগুনির ওয়েভলেংথ কম। ফলে এর প্রভাবে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মি থেকে আমাদের শরীরে ক্ষতি বেশি হয়। মনে রাখতে হবে, ওয়েভ যত মাইক্রো বা সূক্ষ্ম হবে, তার প্রভাব পড়বে বেশি। ঠিক যেমন আতসকাচে আলো পড়লে উল্টো দিকে তার ফোকাসে থাকা কাগজে আগুন ধরে যায়। ঠিক সে ভাবেই মাইক্রোওয়েভ নির্দিষ্ট জায়গা আক্রমণ করতে সক্ষম। সমস্যার সূত্রপাত সেখানেই।
সমস্যা কোথায়?
সারাক্ষণ ফোনে কথা বললে ক্যানসার হয়? ফোনে সিনেমা দেখলে চোখ নষ্ট হয়ে যায়? এমন অনেক প্রশ্ন উঠছে বটে! তবে তা প্রশ্নই থেকে যাচ্ছে। এখনও তা প্রমাণিত হয়নি। তবে মোবাইল ফোনের মাইক্রোওয়েভ দিয়ে মস্তিষ্কে আঘাত হানা যায়। এই ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যায় ‘ফ্রে এফেক্ট’ দিয়ে। ধরুন, অনেকক্ষণ ধরে একটা ভনভন বা বিনবিনে যান্ত্রিক আওয়াজ যদি শোনেন, দেখবেন মাথা ধরে যাবে। ফোনের মাধ্যমে যে আওয়াজটা আপনার কানে এসে পৌঁছচ্ছে, একটু দূর থেকে ফোন ধরলে দেখবেন, শব্দটি তেমনই শোনাবে। গত শতাব্দীর শেষ দিকে আমেরিকান বিজ্ঞানী অ্যালান ফ্রে লক্ষ করেন, দূর থেকে মাইক্রোওয়েভের সাহায্যে মানুষের মস্তিষ্কে আঘাত হানা যায়। মোবাইলে আমরা যা শুনি, তা শব্দ। সেটি মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছয়। পরীক্ষায় ফ্রে দেখলেন, ফোকাস করার ফলে মাইক্রোওয়েভ সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব অংশে। মস্তিষ্ক তখন তা শনাক্ত করছে শব্দ হিসেবে। সুতরাং এর থেকে মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ক্ষতি হতে পারে শ্রবণেন্দ্রিয়েরও।
মেডিসিনের চিকিৎসক সুবীর মণ্ডল বলছেন, ‘‘মোবাইল থেকে যে রেডিয়েশন হয়, তা কিছুটা হলেও শরীরের ক্ষতি করছে। অনেকক্ষণ ফোনে কথা বলার পরে দেখবেন, ফোন ও কান দুই-ই গরম হয়ে ওঠে। সাধারণত শরীর থেকে কিছুটা দূরে মোবাইল রাখলেই ভাল। রাস্তায় যাতায়াতের সময়ে হাতে না নিয়ে একটা ব্যাগে মোবাইল নিন। চার্জ দেওয়ার সময়েও মোবাইলে কথা বলা ঠিক নয়। কারণ সে সময়ে মোবাইলের চার পাশে একটা ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়। তাই চার্জ অফ করে কথা বলুন। এখন অনেকের কাজই মোবাইল-কেন্দ্রিক। সে ক্ষেত্রে ফোনের পরিবর্তে ব্লু-টুথে কথা বলা যায়। অনেক বাইক আরোহী যাতায়াতের সময়ে হেলমেটের মধ্যে মোবাইল ঢুকিয়ে কথা বলতে বলতে যান। তাঁরা কিন্তু অনায়াসেই ব্লু-টুথ ব্যবহার করতে পারেন, নিদেনপক্ষে হেডফোন।’’
নার্ভের সমস্যা: অনেকে বাঁ হাতে, অনেকে আবার ডান হাত দিয়েই মোবাইল ঘাঁটতে অভ্যস্ত। সারাক্ষণ মোবাইল স্ক্রল করতে গিয়ে হাতের কয়েকটি বিশেষ আঙুলের উপরে চাপ পড়ে। আবার ফোন ধরার জন্য কনুই ভাঁজ করে রাখায় ‘সেল ফোন এলবো’র শিকারও হতে পারেন। এতে হাতের কনিষ্ঠা ও অনামিকা অসাড় হয়ে যায়। ফোরআর্মেও ব্যথা হতে পারে। রোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাও বাড়তে থাকে।
চোখের সমস্যা: ঠায় মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকায় চোখের সমস্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। সোশ্যাল নেটওয়র্কিং সাইটে আড্ডা মারা থেকে শুরু করে, মোবাইলে টানা সিনেমা দেখা... রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটানা স্ক্রিন দেখার ফলে ড্রাই আইজ়ের সমস্যা বাড়ছে। চোখে পাওয়ার বাড়ার সমস্যাও বিরল নয়। চোখের ডাক্তার সুমিত চৌধুরীর কথায়, ‘‘অনেক মা-বাবাই সন্তানদের নিয়ে আসেন চোখের সমস্যা হওয়ায়। ছোট ছোট বাচ্চারা একটানা ফোন দেখে। ফলে চোখে চাপ পড়ে। সে ক্ষেত্রে আমরা কিছু লুব্রিকেটিং ড্রপ দিয়ে থাকি। বিশেষত যাদের মাইনাস পাওয়ার, তাদের সেই পাওয়ার দ্রুত বেড়ে যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, স্ক্রিন টাইম কমালে এই পাওয়ার বাড়ার হার অনেক কমেছে। রাতে অন্ধকার ঘরে ফোন দেখার ফলেও কিন্তু চোখে চাপ পড়ে।’’
অনিদ্রা: ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চোখের সামনে ফোন ধরে থাকলে ঘুমের বারোটা বাজবে। এতে মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে যায়। ফলে নিদ্রাহীনতার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
এ তো গেল অসুখ-বিসুখের কথা। চরিত্রগঠনেও মোবাইলের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। ছোট থেকেই বাচ্চার হাতে দীর্ঘ সময়ের জন্য ফোন তুলে দিলে একে তো সে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে, তার উপরে তার চরিত্র গঠনেও বাধা সৃষ্টি হবে। সকলের সঙ্গে মিশতে শিখবে না। মা-বাবার কথা না শুনে বায়না করতে পারে। ছোট থেকেই মোবাইল দেখতে থাকলে বয়ঃসন্ধিতে সে অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। মোবাইলের জগতে অনেক কিছুরই ফাঁদ পাতা। আপনি যেই মুহূর্তে ফোনের ডেটা অন করে সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে কিন্তু বাচ্চার উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। আপনি একটা কার্টুন খুলে সন্তানের হাতে ধরিয়ে দিলেও সে স্ক্রল করে অন্য দিকে চলে যেতে পারে। সুতরাং সন্তানের কম বয়স থেকেই মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে।
সতর্ক থাকুন
• টানা ফোনের দিকে না তাকিয়ে চারপাশে তাকানোর অভ্যেস রাখুন।
• যদি টানা অনেকক্ষণ কথা বলতে হয়, তা হলে ব্লুটুথে বা হেডফোনে নিয়ন্ত্রিত ভলিউমে কথা বলাই শ্রেয়।
• মাথার কাছে ফোন নিয়ে শোবেন না। ঘরের বাইরে ফোন রেখে দিন।
• বাচ্চাদের চুপ করে বসিয়ে রাখার জন্য ফোনের দ্বারস্থ না হওয়াই ভাল। বরং নিজেও সন্তানের সঙ্গে খেলা করুন। এতে ওরও সময় কেটে যাবে। আর আপনারও ভাল লাগবে।
দৈনন্দিন জীবনে ছোট বদল আপনার জীবন অনেকটাই পাল্টে দিতে পারে। মোবাইল জীবনের একটা অংশ হয়ে উঠেছে ঠিকই। কিন্তু খেয়াল রাখবেন, সেটাই যেন জীবন না হয়ে যায়।
মডেল: সুস্মেলী দত্ত, মুনমুন রায়, প্রমিত সোম, শিবাঙ্গী মুখোপাধ্যায়; ছবি: জয়দীপ মণ্ডল, অমিত দাস (শিবাঙ্গী); মেকআপ: চয়ন রায়; পোশাক: আনোখি, ফোরাম মল; লোকেশন: লাহা বাড়ি, বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy