মাছ বাঁচাতে কী করছেন বিজ্ঞানীরা। ছবি: সংগৃহীত।
সুন্দরবন বলতে শুধু রয়্যাল বেঙ্গলের আবাস বাদাবন বা ম্যানগ্রোভের পাঁচিল বোঝায় না। সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপ এবং অসংখ্য গ্রামে লক্ষ লক্ষ মানুষের বসবাস। যাঁদের অনেকেরই জীবন ও জীবিকা সুন্দরবনের পর্যটন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু সেই সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে বিপন্ন। একে তো অরণ্য ধ্বংস করে জনপদ গড়ে উঠছে, তার উপর দূষণ এতটাই থাবা বিস্তার করেছে যে, সুন্দরবনের চাষের জমিগুলিই শুধু নয়, নদীনালাগুলিও দূষিত। একটি সময় সুন্দরবনের জনপদ লাগোয়া নদী-খাড়িগুলিতে সারা বছর মিলত খলসে, তোপসের মতো স্বাদু দেশি ছোট মাছ। কিন্তু আজ সেই সব ছোট মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে।
জলবায়ু বদল আর দূষণ— এই দুইয়ের প্রভাবে সুন্দরবনের চাষাবাদ বিপর্যস্ত, পাশাপাশি বহু প্রজাতির মাছ কার্যত উবে গিয়েছে নদীনালা থেকে। ভাল করে ভেবে দেখুন না, দক্ষিণবঙ্গের নদীগুলিতে এক সময়ে তেলটুপি, পাথরকাটা, ক্যাচকেচি, ডানকিনা, খড়কুটি, চিকরা, চাদা, কাজলি, চ্যাং-এর মতো প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন এগুলির দেখাই পাওয়া যায় না। এর প্রধান কারণ নদীর জলের দূষণ, এ বিষয়ে একমত পরিবেশ বিজ্ঞানী এবং মৎস্যজীবীরাও। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের বিজ্ঞানী রীতা সাহা বলছেন, “পর্যটকদের আনাগোনা, ভুটভুটি-লঞ্চের দাপটে সুন্দরবনের নদীনালাগুলি দূষিত হচ্ছে। ছোট ছোট কলকারখানার রাসায়নিক তো রয়েছেই। ব্যাটারি তৈরি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ-সহ রয়েছে আরও বেশ কিছু কারখানাও। ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদীতে ও মাটিতে মিশছে। চাষের জমিতে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক সার। এক সময়ে সুন্দরবনের পরিবেশ থেকে আইসোপ্রিন পাওয়া যেত। কিন্তু এখন সেই সব গাছগাছড়া আর নেই। মাটির উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলিও ধ্বংস হচ্ছে, ফলে ফসলের ফলনও কমছে। নদীতে মাছও হারিয়ে যাচ্ছে।”
কী ভাবে দূষিত হচ্ছে নদী? রীতা বলছেন, লঞ্চ এবং ভুটভুটি চললে জলের উপরে জ্বালানি তেলের আস্তরণ তৈরি হয় যা জলজ প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর। তা ছাড়া, প্লাস্টিক দূষণও সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের প্রভূত ক্ষতি করছে। প্লাস্টিক এবং থার্মোকলে যথেচ্ছ ভাবে দূষিত হচ্ছে জল। ফলে লোকালয়ের কাছাকাছি এলাকায় নদীগুলিতে জলে অক্সিজেনের মাত্রা কমছে। সে কারণে স্বাভাবিক ভাবেই মাছের সংখ্যা কমছে।
মাছের স্বাভাবিক প্রজনন যখন বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে ধীরে ধীরে মাছের সংখ্যা কমতে থাকে, এমনটাই জানালেন ‘সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ় রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর মৎস্যবিজ্ঞানী অর্চনকান্তি দাস। তাঁর কথায়, “নদীতে মশারি জালের ব্যবহার, নদীর বুক অবৈধ ভাবে আটকে রেখে মাছের চলাচলের পথ নষ্ট করা, নদীর জলে বিষ মিশিয়ে, কার্বাইড ফেলে মাছ ধরা— এ সবের কারণে ছোট মাছের সংখ্যা কমছে। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবেশ দফতর দায়িত্ব নিয়ে ছোট মাছেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য ‘অভয়পুকুর’ তৈরি করছে। উদ্দেশ্য, নদী ও পুকুরে বাঁচতে পারে এই রকম হারিয়ে যাওয়া মাছ সংরক্ষণ করা।’’
গত প্রায় ১৫ বছরে আয়লা, বুলবুল, আমপান, ইয়াসের মতো ঝড় তো সামলাতে হয়েছে সুন্দরবনকে। এ ছাড়াও আরও অনেক প্রাকৃতিক বিপর্যয় সুন্দরবন ছুঁয়ে চলে গিয়েছে। যার প্রভাবে প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি সেখানকার মাটিও লবণাক্ত হয়ে গিয়েছে। অর্চনকান্তির বক্তব্য, সুন্দরবনের বেশির ভাগ চাষের জমিতেই ছোট ছোট জলাশয় তৈরি করে মাছের চাষ হয়। সেখানে ছোট মাছের চাষই বেশি হত এক সময়ে। কিন্তু চাষের জমির রাসায়নিক সার, লবণাক্ত জলের কারণে বিভিন্ন মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। সমুদ্রের জল ঢুকে সুন্দরবনের মাটি লবণাক্ত করছে। উচ্চ বদ্বীপ এলাকার অনেকগুলি নদী, খাল-বিল মজে যাওয়ায় তার মিষ্টি জল সেই ক্ষত মেরামত করতে পারছে না। তাই জলাভূমি সংস্কার করে জলকে নোনামুক্ত না করতে পারলে মাছচাষের সমস্যা থেকেই যাবে।
মৎস্যবিজ্ঞানীর মতে, সুন্দরবনের প্রায় প্রতি বাড়ির সঙ্গেই লাগোয়া ছোট ছোট জলাশয় বা ডোবা রয়েছে। সেখানে ছোট মাছের চাষ শুরু করা যেতে পারে। প্রতি বাড়ির মহিলারা দায়িত্ব নিয়ে সে কাজ করতে পারেন। মৌরলা মাছের চাষ তো খুবই ভাল হবে। মৌরলা মাছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন আছে যা অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য খুবই ভাল। ছোট ছোট ডোবাগুলিকে যদি মাছচাষের জন্য কাজে লাগানো যায়, তা হলে আর মাছের মীন ধরতে নদীতে নামতে হয় না মহিলাদের। হাজার হাজার মানুষ, প্রধানত মহিলা ও শিশুরা, বাধ্য হন ভেড়ির জন্য চিংড়ির পোনা ধরতে। কখনও গলাজলে, কখনও বুকজলে দাঁড়িয়ে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর মাছের মীন, কাঁকড়া ধরতে গিয়ে মারাত্মক সংক্রামক চর্মরোগ হয় তাঁদের। বিভিন্ন অসুখবিসুখ হানা দেয়। কখনও বাঘ, আবার কখনও কুমির-কামটের কামড়ে প্রাণও যায়।
জলবায়ু বদলও সুন্দরবনের ভূমি ও নদীর বাস্তুতন্ত্রকে ছাড়খাড় করছে বলেই মনে করছেন ‘সাউথ এশিয়ান ফোরাম অফ এনভায়রনমেন্ট’-এর চেয়ারম্যান দীপায়ন দে। তাঁর কথায়, “আয়লা থেকে আমপান, বার বার আক্ষরিক অর্থেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে সুন্দরবনের উপর বা চলে গিয়েছে গা ছুঁয়ে। মানুষের জীবনহানি অনেকাংশে কমানো গেলেও জীবিকার সঙ্কট তীব্রতর হয়েছে। চাষের জমি বন্যার জলে লবণাক্ত হয়ে বা পানের বরজ ঝড়ে ধ্বংস হয়ে চরম সঙ্কটে পড়েছেন, এমন মানুষ সুন্দরবনে লক্ষ লক্ষ। শয়ে শয়ে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হয়েছে, নদীনালায় মাছ কমেছে। এই সঙ্কট কাটাতে এখন সুন্দরবনের কৃষি ও মৎস্য চাষে বেশি নজর দিতে হবে।”
তার অনেক উপায়ও আছে বলে মনে করছেন দীপায়ন। ধানচাষ আর মৎস্যচাষকে পাশাপাশি নিয়ে চলতে হবে। ধানচাষের নিচু জমিতে জল জমিয়ে সেখানে ছোট মাছের চাষ শুরু করা যেতে পারে। লবণাক্ত জল যেখানে যেখানে রয়েছে, সেখানে চিংড়ির চাষ ভাল হবে। চিংড়ির উৎপাদন বাড়লে বিদেশে রফতানিও বাড়বে। যার থেকে আয়ও বাড়বে অনেকটা। এই বিষয়ে মৎস্যবিজ্ঞানী তিমির বরণ মণ্ডলের মত, “পকেট ভেড়ি তৈরি করতে হবে। সুন্দরবনে অজস্র নালা রয়েছে। সেখান থেকে জল নিয়ে চাষের জমির পাশেই ছোট ছোট ভেড়ি বানিয়ে নিতে হবে। ধানচাষের সঙ্গেই মাছচাষ হবে। একই সঙ্গে পোলট্রিও করা যেতে পারে। দেখা গিয়েছে, যে জলে হাঁস ঘুরে বেড়ায় সেই জলের অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ে। হাঁসের মলমূত্র মাছের ভাল খাদ্যও। তাই পরিকল্পনা করে কাজ করলে একই সঙ্গে শস্যচাষ, মৎস্যচাষ ও পোলট্রি ফার্মিং করা সম্ভব। এতে সুন্দরবনের সাধারণ বাসিন্দাদের কর্মসংস্থানও ভাল হবে।”
সেই সঙ্গে আরও একটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। বিজ্ঞানী দীপায়নের পরামর্শ, প্লাস্টিক দূষণ কমাতে হবে সুন্দরবনে। মাছের বিলুপ্তির জন্য সেটিও বড় কারণ। সুন্দরবনের পাখিরালা, সুধন্যখালি, সজেনখালি, দোবাঁকি-সব বিভিন্ন দ্বীপ পর্যটকদের মূল আকর্ষণ। ভ্রমণপিপাসু দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা ঘুরতে আসেন সুন্দরবনে। আর যত্রতত্র প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক, থার্মোকলের থালা-বাটি এবং আরও টুকিটাকি বিভিন্ন জিনিস ছড়িয়ে যান। সেগুলি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি, নদীবাঁধগুলির সংস্কার করা প্রয়োজন যাতে যথেচ্ছ ভাবে সমুদ্রের নোনাজল ঢুকে পড়তে না পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy