হাঁটুতে বাতের চিকিৎসা কী কী। গ্রফিক: শৌভিক দেবনাথ।
হাঁটুর ব্যথায় কাবু এখন অনেকেই। সে বয়স ত্রিশ হোক, বা ষাট। কিছু ক্ষণ শুয়ে থাকার পর উঠতে গেলে ব্যথা, বসে থেকে দাঁড়াতে গেলে ব্যথা, সিঁড়ি ভাঙতে গেলেও টনটনিয়ে ওঠে হাঁটু। এমন সমস্যা ঘরে ঘরে দেখা যাচ্ছে।
হাঁটুর ব্যথার কারণ অনেক। জন্মগত কারণে হাড়ের গঠনে কোনও সমস্যা থাকলে, কোনও সংক্রমণ হলে, চোট লাগলে, আর্থ্রাইটিস হলে বা কার্টিলেজে আঘাত লাগলেও হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে। আবার কিছু কিছু টিউমারের কারণেও হাঁটুতে ব্যথা হয়। কলকাতার এক হাসপাতালের অস্থিরোগ চিকিৎসক বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায় জানালেন, হাঁটুর ব্যথার একশো রকম কারণ থাকলেও এখন মূলত দু’টি সমস্যা বেড়েছে। প্রথমত, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, দ্বিতীয়ত অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিস।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস প্রথমে ছোট ছোট অস্থিসন্ধিগুলির ক্ষতি করে। রোগটা যত বাড়তে থাকে, কব্জি, হাঁটু, গোড়ালি, কনুই, কাঁধে ব্যথা বাড়তে থাকে। আর অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিসের কারণ অনেক। চিকিৎসকের কথায়, “আগে ছিল বয়সজনিত সমস্যা। কিন্তু এখন জীবনযাপনের ধরন, খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চার অভাবের মতো বিভিন্ন কারণে ৩০ থেকে ৫০ বছরেও ব্যথা কাবু করছে।”
টানা ৭-৮ ঘণ্টা কম্পিউটারে বসে কাজ করেন যাঁরা, শরীরচর্চার ধাত নেই খুব একটা, তাঁরা ভুগছেন হাঁটুর ব্যথায়। গৃহবধূরাও যে ভুগছেন না, তা নয়। সর্ব ক্ষণ হাঁটু মুড়ে বসে কাজ করছেন যাঁরা, তাঁদেরও ব্যথা ভোগাচ্ছে। হয়তো জোরে হাঁটতে গেলেন বা পা মুড়ে মাটিতে বসতে গেলেন, অমনি যন্ত্রণায় হাঁটুটা অবশ হয়ে গেল। দুর্গাপুরের এক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক প্রবীরকুমার দত্ত যেমন বলেন, ‘‘জানলা-দরজা খোলা বন্ধ করতে যেমন হিঞ্জ বা কব্জা থাকে, হাঁটু ভাঁজ করা ও নাড়াচড়া করার নিয়মটাও তেমন। কব্জায় সমস্যা হলে জানলা-দরজা খারাপ হয়। শরীরের বৃহত্তম হিঞ্জ জয়েন্ট হাঁটুর ক্ষেত্রে একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।’’
মহিলারাই কি বেশি ভুগছেন?
ভারতে ২০ শতাংশ মানুষ অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিসের সমস্যা ভুগছেন। এমনটাই জানালেন সিউড়ির এক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক সুব্রত গড়াই। তাঁর কাছে হাঁটুতে ব্যথা নিয়ে অস্ত্রোপচার করাতে যাঁরা আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই মহিলা। তার মধ্যে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ, নানা বয়সের মহিলারা আছেন।
ইস্ট্রোজেন হরমোনের ওঠানামায় অনেক সমস্যা হয়। এই হরমোন মহিলাদের অনেক শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। চিকিৎসক প্রবীরবাবু জানাচ্ছেন, ঋতুবন্ধের সময়ে হাঁটুর ব্যথা বাড়ার সমস্যা নিয়ে মহিলারা আজকাল চিকিৎসকের কাছে বেশি যাচ্ছেন। কারণ, ঋতুবন্ধের পর ইস্ট্রোজেন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। তখন বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিতে থাকে। মেয়েদের হাড়ে ক্যালশিয়ামের পরিমাণ কমে যায়। মেয়েদের মধ্যে যাঁরা বাড়িতে বসে কাজ করেন, তাঁদের তো বটেই, এমনকি যাঁরা মাঠে কাজ করেন, তাঁদেরও অনেক সময়ে হাঁটু মুড়ে কাজ করতে হয়। ফলে হাঁটুতে হাড়ের সংযোগস্থলে চাপ অনেকটাই বেড়ে যায়। দিনের পর দিন হাড়ের সংযোগস্থল, অর্থাৎ হাঁটুতে চাপ পড়ায় তার ক্ষমতা কমে যায়। তাই চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাদের হাঁটুর সমস্যা বেশি দেখা দেয়।
মহিলাদের হাঁটুর গঠনও বাতের ব্যথার অন্যতম কারণ। এ বিষয়ে চিকিৎসক বুদ্ধদেববাবুর মত, “মহিলাদের হাঁটু তুলনামূলক ভাবে ছোট। তাই ঝুঁকে কাজ করা বা হাঁটু মুড়ে কাজের সময়ে তিন হাড়ের সন্ধিতে চাপ বেশি পড়ে। হাঁটু ভাঁজ করলে যে ‘বেন্ডিং মোমেন্ট’ বা চাপ তৈরি হয়, তার টানে হাঁটুর সামনের দিকে থাকা মালাইচাকি হাড়ের তলার অংশের কার্টিলেজে চাপ দেয়। এই চাপ যত বাড়ে, ততই হাঁটুর হাড়ে ক্ষয় হতে থাকে। মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়।”
পুরুষরাও কাতর হাঁটুর ব্যথায়
কখনও ধূমপান করেননি, বাইরের খাবারও বিশেষ খান না, এমন লোকজনও ভুগছেন হাঁটুর ব্যথায়। চিকিৎসক বুদ্ধদেববাবুর ব্যাখ্যা, বছর পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে পুরুষেরা হাঁটুর সমস্যায় বেশি ভোগেন। তার প্রথম কারণ হল বয়সজনিত হাড়ের ক্ষয় ও দ্বিতীয়ত অবসরের পর অধিকাংশ সময়ে বাড়িতে থাকায় সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি পাচ্ছেন না তাঁরা।
চিকিৎসক প্রবীরবাবুর মতে, আমাদের দেশে কড লিভার অয়েল তেমন পাওয়া যায় না। আর যা যা খাবার থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যেতে পারে, সে সব খাওয়ার চলও আমাদের দেশে কম। কয়েক রকম বাদাম, সব্জি থেকে যতটুকু ভিটামিন ডি পাওয়া যায়, তা শরীরের জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ, সে সব খাবার আমরা মাঝেমধ্যে খাই। তাই ভিটামিন ডি-র সবচেয়ে ভাল উৎস হল সূর্যের আলো। রোদে কিছু ক্ষণ শরীর সেঁকলে সেই প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি পাওয়া যাবে। মাঝদুপুরের চড়া রোদে থাকতে বলা হচ্ছে না, তবে দিনে কিছুটা সময় সূর্যের আলো গায়ে লাগাতেই হবে।
ব্যথা মানেই কি হাঁটু বদলাতে হবে?
হাঁটুর ব্যথার তিনটি পর্যায় আছে। ‘মাইল্ড’, ‘মডারেট’ ও ‘সিভিয়ার’। প্রথমটাতে, ব্যথা ততটা মারাত্মক নয়। ধরুন হাঁটতে গেলেন আর ব্যথা শুরু হল। কিন্তু বসে পড়লে ব্যথা কমে গেল। এটা হল ‘মাইল্ড’। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, ব্যথা সহজে কমবে না। হাঁটার সময়, সিঁড়ি ভাঙতে গেলে, বসে থেকে ওঠার সময়ে একটানা চিনচিনে ব্যথা হতেই থাকবে। এটা ‘মডারেট’। আর তৃতীয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ, ‘সিভিয়ার’ হলে হাঁটুর হাড়ের জরাজীর্ণ দশা হবে। তখন সারা ক্ষণই প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতে থাকবে। কিছুতেই কমবে না। হয়তো দেখলেন হাঁটাচলা আর করতেই পারছেন না।
অস্থি চিকিৎসকেরা বলছেন, হাঁটুতে ব্যথা মানেই হাঁটু প্রতিস্থাপন নয়। বিকল্প উপায়ও আছে। সেগুলি কী কী?
১) অল্প ব্যথা হলে কিছু নির্দিষ্ট ব্যায়াম করে দেখা যায়। হাঁটুর ব্যথা হলে পা লম্বা করে এক বার শক্ত এবং এক বার ঢিল দিতে হবে। এমন করলে হাঁটুর হাড়ের শক্তি বেড়ে যায়।
২) ব্যথার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় হালকা ব্যথানাশক ওষুধ, মলম, স্প্রে দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তাতেও কাজ না হলে তখন কিছু ইঞ্জেকশন আছে।
৩) ‘ভিসকো সাপ্লিমেন্টেশন’ নামে এক ধরনের ইঞ্জেকশন আছে, যেটা অনেকটা জেলির মতো। তাতেও ভাল কাজ হয়। ব্যথা নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর রোগীকে বলে দেওয়া হয়, মাটিতে বসে কাজ করবেন না।
৪) এই ব্যথা যে হেতু ওঠানামা করে, তাই এক বার ওষুধ খেয়ে বা ইঞ্জেকশন দিয়ে কাজ হবে, তেমনটা নয়। ব্যথা বাড়লে ৬ মাস অন্তর, না হলে ৬ সপ্তাহ অন্তর ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। চিকিৎসক সুব্রত গড়াই জানাচ্ছেন, ৬ মাস অন্তর যে ইঞ্জেকশন দিতে হয়, তার দাম দশ হাজার টাকার মতো। আর ৬ সপ্তাহ অন্তর লাগাতার দিতে হলে তার দাম কম।
৫) ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। ওজন যত বাড়বে, ততই দুই হাঁটুর উপর চাপ পড়বে। তখন ওষুধ বা ইঞ্জেকশনেও কাজ হবে না।
৬) হাঁটুর ব্যথা বাড়লে জিমে গিয়ে ট্রেডমিলে হাঁটা বা দৌড়নোর মতো কাজ করবেন না। কারণ, ব্যথা কী কারণে হচ্ছে, সেটা আগে চিহ্নিত করা দরকার। ব্যথা নিয়ে ভারী ব্যায়াম করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
৭) বেশি সময় ধরে মাটিতে না-বসা, কমোড ব্যবহার করা, ঘুম থেকে ওঠার সময়ে কাত হয়ে ওঠা, ঝুঁকে বা দাঁড়িয়ে স্নান না-করে টুলে বসে করা, এক জায়গায় অনেক ক্ষণ বসে টিভি বা কম্পিউটার না-দেখা, বেশি উঁচু এবং সরু হিলের জুতো না-পরা— এগুলিও মেনে চলা জরুরি।
হাঁটুর অস্ত্রোপচার মানেই আতঙ্ক নয়
যদি পঞ্চাশোর্ধ্ব বা ষাটোর্ধ্ব কারও অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিস শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ে, তা হলে হাঁটু প্রতিস্থাপন করারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। না হলে জীবনযাত্রার ধরন বদলে, ওজন কমিয়ে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখারই নিদান দেওয়া হয়।
কী ভাবে হয় অস্ত্রোপচার? চিকিৎসক প্রবীরবাবু জানাচ্ছেন, যে হাড়গুলি ক্ষয়ে গিয়েছে, সেগুলির মাথা কেটে একটি আকারে নিয়ে আসা হয়। তার পর ফিমারের উপর ধাতুর ক্যাপ ও টিবিয়ার উপর ধাতুর ট্রে বসিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষয়িষ্ণু হাড়গুলিকে ধরে রাখার জন্য আরও কিছু পদ্ধতির প্রয়োগ হয়।
আর যদি বয়স ত্রিশ বা চল্লিশ হয়, তা হলে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপন না করে আংশিক প্রতিস্থাপন করা হয়। বছর কুড়ি পরে যদি ফের হাঁটুতে সমস্যা দেখা দিতে থাকে, তা হলে রোগীর শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে তবেই ফের প্রতিস্থাপনের কথা ভাবা হয়।
তবে হাঁটুর সমস্যার শুরুতেই যদি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কয়েকটি ব্যায়াম শুরু করা যায় এবং রোজকার জীবনযাত্রায় কিছুটা বদল আনা যায়, তা হলে আর সাংঘাতিক হাঁটুর ব্যথায় কষ্ট পেতে হয় না। নাগাড়ে হাঁটু ভাঁজ করে মাটিতে বসে কাজ করা, বার বার সিঁড়ি চড়া ও নামার কারণে হাঁটুর ব্যথা বাড়তে পারে। এই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। একসঙ্গেই ওজন বাড়তে দিলে চলবে না এবং নিয়ম করে ব্যায়াম করতে হবে। এখন অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিসের অন্যতম কারণই হল ওজন বৃদ্ধি। কমবয়সিদের সে কারণেই হাঁটু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তা ছাড়া, অতিরিক্ত ধূমপান, মদ্যপান তো আছেই। সুষম খাবার খাওয়াটাও জরুরি। ভাজাভুজি, বেশি তেল জাতীয় খাবার খাওয়া চলবে না। এ সব নিয়ম মানলেই হাঁটু ভাল থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy