Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
mask

করোনাকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচবেন কী করে?

কোন কোন নিয়মে করোনা এড়িয়ে সুস্থ থাকবেন?

ধীরে ধীরে অদৃশ্য এই শত্রুর সঙ্গে বসবাসের কৌশল শিখে নিতে হবে। ছবি: পিটিআই।

ধীরে ধীরে অদৃশ্য এই শত্রুর সঙ্গে বসবাসের কৌশল শিখে নিতে হবে। ছবি: পিটিআই।

সুজাতা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২০ ১৭:৩৮
Share: Save:

প্রথমে মনে হয়েছিল ঘরে থাকলে ও খুব করে নিয়ম মানলে করোনা ঘেঁষতে পারবে না কাছে। এক জন থেকে অন্য জনে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শৃঙ্খল ভেঙে যাবে। কমবে অতিমারির প্রকোপ। তত দিনে গরম এসে যাবে, কিছু ভাইরাস মরবে দাবদাহে। আর বিজ্ঞানীদের গবেষণা তো চলছেই। ওষুধ বা টিকা কিছু একটা বেরলে সমস্যা মিটবে পুরোপুরি।

কিন্তু কোনওটাই হল না। কিছু মানুষ লকডাউন মানলেন, কিছু মানলেন না। কেউ কেউ মানতে পারলেন না। ফলে সংক্রমণের গ্রাফ ঊর্ধমুখী রইল। গরম ও গবেষণা কোনও সুখবর নিয়ে এল না। শেষমেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েই দিল, এ বার ধীরে ধীরে অদৃশ্য এই শত্রুর সঙ্গে বসবাসের কৌশল শিখে নিন। যেমন ভাবে ডেঙ্গি, এডসের সঙ্গে মিলেমিশে আছেন, সে ভাবে।

অর্থাৎ এ বার বাড়িতে পরিচারিকা ঢুকবেন। ধরাচুড়ো পরে অফিস যেতে হবে। উঠতে হবে গণপরিবহণে। কাজেই আগে যেমন সপ্তাহে এক বার মাত্র বাজার যেতেন, প্লাস্টিকের চটি পরে, চোখে রোদচশমা ও নাকে এন-৯৫ এঁটে, ফিরে এসে জামা-জুতো-ব্যাগ থেকে শুরু করে নিজেকেও আপাদমস্তক সাবান-জলে রগড়ে ধুয়ে নিতেন, সবার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতেন, ঘণ্টায় ঘণ্টায় হাত ধুতেন, সে সব আর হবে না। তার উপর ‘করোনা সামলাতে’ যে সব দাওয়াই চলত নিমেষে নিমেষে— গরম জল, আদা-তুলসী-লবঙ্গ-গুড়ুচি ইত্যাদির ক্কাথ্, লেবু-জল, চা, ভিনিগার, কমলালেবু, রান্নায় আদা-রসুন-জিরে-হলুদ দিতেন আচ্ছা করে, ভাবতেন এই পথেই বাড়বে ইমিউনিটি, বিদায় নেবে করোনা, সময়ের অভাবে অত খুঁটিনাটি করতে পারবেন না। চড়া রোদে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে ভাইরাস ও নিজেকে পুড়িয়ে ঝামা করার যে কৌশল নিয়েছিলেন, তা-ও হবে না। বরং অফিসে কাজের ফাঁকে অন্যের হাতে বানানো এক-আধ কাপ চা-কফি খেতে হবে। টিফিন না বানাতে পারলে বাজারের ঝালমুড়ি বা ধোকলা খেতে হতে পারে কখনও। দামি জামা-কাপড়, চটি-জুতো, বেল্ট ইত্যাদি রোজ ধুতে ধুতে তাদের হাল খারাপ হবে। এমনকি, বাড়ি ফিরে চুল ভিজিয়ে শ্যাম্পু করে স্নানও করে উঠতে পারবেন না সবাই। ফলে যা হবে, তা হল প্রবল মানসিক অশান্তি, এই বুঝি রোগ ঢুকে পড়ল, আর বয়কট করল সবাই। এ ভাবে বাঁচা যাবে!

আরও পড়ুন: করোনা রুখতে ঘরবাড়ি পরিষ্কার তো রোজই করছেন, কিন্তু এ সব মেনে চলছেন কি?

মাস্ক পরার অভ্যাস চালিয়ে যেতে হবে আপাতত।

তা হলে বাঁচার পথ কী?

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী বললেন, “নিয়ম মানলে তো ভাল। কিন্তু যা হচ্ছে তা কোনও নিয়ম নয়। অবৈজ্ঞানিক সব ব্যাপার। এই যে গরমের মধ্যে ঘণ্টায় ঘণ্টায় গরম জল খাচ্ছেন, চা খাচ্ছেন, কী এর কারণ? ভাইরাস মরবে? ভাইরাসকে মারতে গেলে জলের তাপমাত্রা যা হতে হবে, তাতে তো মানুষই মরে যাবে! অত চা খেলে অম্বল বাড়বে না!’’ অমিতাভবাবু বলছেন, কেউ আবার রোদে দাঁড়িয়ে থাকছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারণ তাতে ভিটামিন ডি তৈরি হবে, করোনা পালাবে! ভিটামিন ডি দরকার। এখন বলে নয়, সব সময়েই দরকার। কিন্তু বাড়াবাড়ি করলে তো বিপদ। তাঁর অভিমত: ‘‘আসলে মানুষকে ভাল করে বোঝানো হচ্ছে না। স্রেফ বলে দেওয়া হচ্ছে এটা করো, ওটা করো। কেন করতে হবে, না করলে কী হবে তা না বুঝলে যা হয়। কেউ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কেউ বাড়াবাড়ি করছেন। আর রোগ থেকে যাচ্ছে রোগের মতো। অতিমারির মোকাবিলা এ ভাবে হয় না।’’ তাঁর পরামর্শ, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে হয়। ট্রেনিং দিতে হয় লাগাতার। তারপর সবাই যখন বোঝেন এই পথে চললে ভাল হবে, তাঁরা নিজেরাই ঠিকঠাক নিয়ম মানেন, উপর থেকে চাপিয়ে দিতে হয় না।”

ঠিকঠাক নিয়মগুলি কী কী

• ‘‘রোগ ঠেকানোর ৮০ শতাংশ চাবিকাঠি আছে হাত ধোওয়ার মধ্যে।” বলছেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী, “কিন্তু তার মানে এই নয় যে ঘণ্টায় ঘণ্টায় হাত ধুতে হবে। আপনি যদি এমন জায়গায় হাত দেন যেখানে জীবাণু থাকার আশঙ্কা আছে, যেমন গণপরিবহণে উঠলে, ভিড় কাটিয়ে বেরলে, লিফটের বোতাম-দরজার হাতল বা সিঁড়ির রেলিং ধরলে, পাঁচ জন ব্যবহার এমন কিছুতে হাত দিলে, টাকা দেওয়া-নেওয়া করলে ইত্যাদি, সেই হাত নাকে-মুখে-চোখে বা অন্য কোথাও লাগার আগেই ভাল করে ধুয়ে নিতে হয়। ধুতে হয় খাওয়ার আগে, টয়লেট থেকে এসে। কাজেই বাইরে বেরনোর সময় সঙ্গে ছোট একটা সাবান ও ৭০ শতাংশ অ্যালকোহল আছে এমন স্যানিটাইজার নিন। কিছু টিস্যু পেপার বা পরিষ্কার রুমাল রাখুন। হাত ধোওয়ার সুযোগ থাকলে সাবান জলে হাত ধুয়ে নিন। না হলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। সাধারণ সাবান হলেই হবে। অ্যান্টিব্যাক্টিরিয়াল সাবানের কোনও দরকার নেই। তার আলাদা কোনও ভূমিকা নেই। তা ছাড়া আপনার লড়াই তো ব্যাক্টিরিয়ার বিরুদ্ধে নয়, ভাইরাসের বিরুদ্ধে।”

• সাধারণ মানুষের গ্লাভস পরার দরকার নেই। নিয়ম মেনে না পরলে উল্টে বিপদের আশঙ্কা বেশি। তার চেয়ে হাত ধুয়ে নেওয়া অনেক নিরাপদ।

• রাস্তায় বেরলে মাস্ক বাধ্যতামূলক। অফিসেও পরে থাকবেন। কাপড়ের ট্রিপল লেয়ার মাস্ক সবচেয়ে ভাল। তবে গরমে অসুবিধে হলে ডাবল লেয়ারই পরুন। বেশ বড় মাপের। নাকের উপর থেকে চিবুকের নীচ ও কান পর্যন্ত গালের পুরোটাই ঢাকা থাকতে হবে। আপনার ৬ ফুটের মধ্যে কেউ যেন মাস্ক না পরে আসেন, সে দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ি ফিরে সাবান জলে মাস্ক ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। বা যদি ৫টা মাস্ক থাকে ও আলাদা করে রাখার জায়গা থাকে, পর পর ৫ দিন আলাদা আলাদা মাস্ক পরে আবার ষষ্ঠ দিন আবার এক নম্বর মাস্ক দিয়ে শুরু করতে পারেন। রোগ ঠেকানোর ২০ শতাংশ দায়িত্ব আছে মাস্কের উপর।

• মাস্ক পরছেন বলে মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখবেন না, এমন যেন না হয়। ৬ ফুটের বেশি দূরত্ব রাখতে পারলে সবচেয়ে ভাল। নয়তো কম করে ৩ ফুট।

আরও পড়ুন: শুধু খাওয়াদাওয়ায় নজরই নয়, শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান এই সব উপায়েও

• চোখে চশমা থাকলে আর কোনও সাবধানতা লাগবে না। না থাকলে রোদচশমা পরে বেরন। কারণ চোখ দিয়েও কিন্তু জীবাণু ঢুকতে পারে।

• বড় চুল হলে চুল ভাল করে বেঁধে স্কার্ফ বা ওড়নায় মাথা ঢেকে নেবেন। কারণ বাসে-ট্রামে খোলা চুল অন্যের নাকে-মুখে উড়ে লাগতে পারে। তাঁদের রোগ আছে কি না তা তো জানেন না। সেই চুল আপনার নাকে-মুখে লাগলে বিপদ হতে পারে। তা ছাড়া বড় চুলে রোজ শ্যাম্পুও করা যায় না। বিপদ বাড়ে তা থেকে। জানালেন চিকিৎসক গোস্বামী।

• নিয়মিত ধোওয়া যায় এমন চটি বা জুতো পরে বেরবেন।

• গয়নাগাটি পরে বেরবেন না। কারণ ধাতুর উপর প্রায় পাঁচ দিন থেকে যেতে পারে জীবাণু। ঘড়ি পরারও দরকার নেই।

• অফিসে নিজস্ব কাপ রেখে দেবেন। সাবান-জলে ধুয়ে সেই কাপে চা বা কফি খাবেন। ক্যান্টিন থেকে যে পাত্রেই আসুন, চা-কফির তাপে সেখানে জীবাণু থাকবে না। ভয় নেই।

• বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে যাবেন। নয়তো খোসা ছাড়িয়ে খেতে হয় এমন ফল খাবেন। প্যাকেটের বিস্কুট বা বাদাম খেতে পারেন মাঝেমধ্যে। প্যাকেট খুলে পরিষ্কার করে ধোওয়া পাত্রে ঢেলে তারপর হাত ধুয়ে খাবেন।

• রাস্তার কিছু খাওয়া এ সময় ঠিক নয়। বড় রেস্তরাঁয় যদি সব নিয়ম মেনে খাবার বানানো হয়, এক-আধ বার খেতে পারেন। তবে সে সবও যত এড়িয়ে যেতে পারবেন তত ভাল। খাবার বাড়িতে এনে গরম করে খেলে অবশ্য অসুবিধে নেই।

• জুতো বাইরে খুলে ঘরে ঢুকবেন। পাঁচ জোড়া জুতো থাকলে এক এক দিন এক একটা পরতে পারেন। ষষ্ঠ দিনে আবার প্রথম জোড়াটা পরবেন। কারণ ৫ দিন পর্যন্ত ভাইরাস লেগে থাকতে পারে জুতোয়। না থাকলে সাবান-জলে জুতো ধুয়ে তবে ঘরে ঢোকাতে পারবেন। এর পর নির্দিষ্ট কাবার্ড বা ঝোলায় ব্যাগ রেখে বাথরুমে গিয়ে জামাকাপড়, চশমা সাবান-জলে ধুয়ে, তুলোয় স্যানিটাইজার ভিজিয়ে মোবাইল পরিষ্কার করে ভাল করে সাবান মেখে, শ্যাম্পু করে স্নান করবেন।

• বাড়িতে কাজের লোক বা অন্য কেউ এলে ঘরে ঢোকার আগে হাত এবং পা ভাল করে সাবান জলে ধুয়ে নিতে হবে। ধোওয়া মাস্ক পরতে হবে। স্নান করে জামাকাপড় বদলে নিতে পারলে আরও ভাল।

• খাওয়াদাওয়ার দিকে নজর দিতে হবে। বাহুল্য বর্জিত হালকা খাবারই ভাল এই সময়। ঘরে বানানো সাধারণ বাঙালি খাবার। ভাজা-মিষ্টি একটু কম খাওয়া ভাল। ফল খাবেন সুবিধেমতো। মাছ-মাংস-ডিম, যাঁর যেমন সুবিধে।

আরও পড়ুন: করোনাকে হয়তো পুরোপুরি ধ্বংস করা যাবে না, মত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার

বাসে-ট্রেনে ওঠার সময় নিয়ম মেনে চলতে হবে।

• প্রচুর জল খাওয়ার কোনও দরকার নেই। শরীর যতটুকু চায় ততটুকু খেলেই হবে।

• ভেষজ উপাদান খেতে ইচ্ছে হলে খাবেন। না খেলেও ক্ষতি নেই। কারণ আদা, ভিনিগার ইত্যাদিরা ভাইরাস মারতে পারে না। পুষ্টিকর সহজপাচ্য খাবার খেলে, অল্প ব্যায়াম করলে ও ভাল করে ঘুমোলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিই ঠিক থাকবে।

• গায়ে হালকা রোদ লাগানো খুবই দরকার। সকালের দিকে একটু মর্নিং ওয়াকে গেলে ব্যায়ামও হবে, রোদও লাগবে গায়ে। ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেরায় না। কাজেই ভয় নেই। সময় থাকলে একটু বেলার দিকেও বেরতে পারেন। চড়া রোদ ঠেকাতে ছাতা নিয়ে নেবেন। মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখাও সহজ হবে।

• অনেকের ধারণা সনা বাথ নিলে ভাইরাস মরে। ভুল ধারণা। গরমের মধ্যে ও সব করার দরকার নেই।

• জিম বা বিউটি পার্লারেও এখনই যাওয়ার দরকার নেই।

শেষ কথা

যতটা সম্ভব স্বাভাবিক জীবনযাপন করুন। নিয়ম মানুন। অতিরিক্ত কিছু করার দরকার নেই। করে লাভও নেই। কারণ কিসে ভাইরাস মরবে, তা কেউ জানে না। কাজেই তার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

অন্য বিষয়গুলি:

Mask COVID-19 coronavirus Pandemic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy