Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
novel coronavirus

ছুটি, স্বেচ্ছায় নয়, তাই চাপ॥ কেন, কী করবেন?

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা নিয়ে ভাবনা থেকে যে উদ্বেগ দানা বাঁধছে, তা ছাপ রেখে যাচ্ছে আমাদের বর্তমান জীবনযাপনেই।

করোনা আতঙ্ক ক্রমেই চেপে বসছে মাথায়। ছবি: শাটারস্টক।

করোনা আতঙ্ক ক্রমেই চেপে বসছে মাথায়। ছবি: শাটারস্টক।

মনীষা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২০ ১৫:০২
Share: Save:

ফেসবুকের মুখ ভার, থমথমে। টুইটারের কপালে ভাঁজ। হোয়াটসঅ্যাপ ঘোর দুশ্চিন্তায়। ইনস্টাগ্রাম গুরুগম্ভীর। বাড়িরও যেন মন খারাপ।

করোনা-আক্রান্ত দুনিয়ায় এরা ভাল নেই। আসলে, ভাল নেই আমরা কেউই। আমি-আপনি। আর তারই ছাপ পড়ছে আমাদের রোজনামচায়। বিশ্ব জুড়ে করোনা-আতঙ্কের সঙ্গে লড়তে যোগ হয়েছে সোশ্যাল ডিসট্যান্স বা দূরে দূরে থাকার নিদান। আর এতেই ভয়ের হাত ধরেছে একাকিত্ব ও বিষাদ। মানুষ সিনেমা ভুলেছে, খেলা ভুলেছে, রাজনীতিও ভুলেছে। ভুলেছে তার নিজস্ব পরিসর। দিনমান একমুখী করোনা-চিন্তায় জীবন কাটাতে কাটাতে ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী মানসিক চাপ

‘‘কখনও ভাবিনি, নিজের বাড়িতেও এমন ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকতে হবে! যেন যুদ্ধ চলছে!’’, লকডাউন মোটে এক দিন পেরতেই যেন অস্থিরতা ছিটকে এল যাদবপুরের বাসিন্দা আইটি কর্মী তনয় সেনগুপ্তের মুখে। ‘ভাইরাস’, তায় আবার অচেনা। এতেই আতঙ্ক গ্রাস করেছে আরও। তার হাত ধরে অনিশ্চয়তা, সুরক্ষা নিয়ে চিন্তা। এরই সঙ্গে যোগ হয় নতুন ভাইরাস আর কোথায় ছড়াল, ক’জন নতুন করে আক্রান্ত হলেন, ক’জন মারা গেলেন, দিন জুড়ে এ সব খবর নেওয়ার প্রবণতা। সব মিলিয়ে শুধুই করোনা নয়, এই মানসিক চাপের সঙ্গেও লড়ার রসদ চাই হাতে।

আরও পড়ুন: আপনারও কি আদৌ হাইড্রো অক্সি-ক্লোরো-কুইন দরকার? জেনে নিন বিশেষজ্ঞদের কাছে

কোথায় উদ্বেগ?

লন্ডন কিংস কলেজের ট্রান্সলেশনাল নিউরোসায়েন্স ও মনোবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও মনোবিদ সাগ্নিক ভট্টাচার্য এই উদ্বেগের উৎস হিসেবে অজানা শঙ্কাকেই দায়ী করছেন। তাঁর মতে, ‘‘এই ধরনের অসুখে মূল ভয় লুকিয়ে এর ‘অজানা’ তত্ত্বে। সাধারণ মানুষ কিন্তু এই ভাইরাসের চরিত্র কী ভাবে বদলাচ্ছে বা এটির রাসায়নিক উপাদান নিয়ে অত চিন্তিত নন, তাঁদের চিন্তার দিকগুলি খুব স্পষ্ট। এমন একটি অসুখ যাকে কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা অজানা। তাই, আমি ও পরিজনেরা নিজে সেই অসুখের শিকার হব কি না, এর কোনও ওষুধ বেরল কি না, মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা কত, এগুলোই মূল ভাবনা। যা চাপ ফেলছে মনে। রোজের রুটিন বদলে গিয়েছে। ঘরে থাকাটাও স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া নয়। তাই ‘ছুটি’-র মতো একে হালকা চালে নেওয়া অসম্ভব। সব মিলিয়ে শরীরের স্ট্রেস হরমোনগুলি অহরহ ক্ষরিত হচ্ছে। তাই রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া বা হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।’’

উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তার বশে চেনা ফেসবুক, জানা হোয়াটসঅ্যাপেও মানুষ শুধুই করোনা সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই কথা বলছেন। যদি দু’-চারটে মিম বা রসিকতা জন্মও নেয়, তা-ও করোনা সংক্রান্তই। সাগ্নিকবাবুর মতে, এই রসিকতার মধ্যেও বার বার করোনা প্রসঙ্গ উঠে আসায় তা-ও মস্তিষ্ককে খুব একটা আরাম দিতে পারছে না। সাধারণ রসিকতা বা হাসার সময় যেটুকু স্ট্রেস ঝরে যায়, তাও এই ধরনের রসিকতা থেকে পুরোটা সম্ভব হচ্ছে না।

একমুখী করোনা-চিন্তায় জীবন কাটাতে কাটাতে ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী মানসিক চাপ।

মনোচিকিৎসক জয়রঞ্জন রামও সহমত সাগ্নিকবাবুর সঙ্গে। তাঁর মতেও এই চাপিয়ে দেওয়া ঘরবন্দি অবস্থা নিতে অভ্যস্ত নয় মানুষ। আগে এমন অভিজ্ঞতা না থাকাও শরীরের স্ট্রেস হরমোনগুলিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে। ফলে টেনশন, চাপা উদ্বেগ, ভয়, আতঙ্ক এগুলোই মাথার মধ্যে দপদপ করছে। অন্য কোনও ভাবনা স্থায়ী হচ্ছে না। জানালেন, ‘‘যা নিজে কন্ট্রোল করতে পারি না, এমন ঘটনায় স্ট্রেস স্বাভাবিক ভাবে বাড়ে। অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় স্ট্রেস হরমোন তখন দ্রুত ও ঘন ঘন নিঃসৃত হয়। অন্য কিছুতে মনও বসে না। এই সময়ও চার পাশে এটাই ঘটছে। তার সঙ্গে বাড়িতে বয়স্ক, শিশু ও অসুস্থ মানুষ থাকলে তাঁদের নিয়েও বাড়তি চিন্তা দানা বাঁধছে। উত্তেজিত হচ্ছে মোটর নিউরোন। এ সব থেকেই মনের চাপ বেড়ে চলেছে।’’

উদ্বেগের লক্ষণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা নিয়ে ভাবনা থেকে যে উদ্বেগ দানা বাঁধছে, তা ছাপ রেখে যাচ্ছে আমাদের বর্তমান জীবনযাপনেই। যেমন, জয়রঞ্জনবাবুর মতে, এই যে ঘন ঘন টিভি চালিয়ে বা ইন্টারনেটে চোখ রেখে মৃতের সংখ্যা, আক্রান্তের সংখ্যা জানার ইচ্ছে, কোথাও সংবাদপত্রে চোখ রেখে খুঁটিনাটি জানতে চাওয়া, এগুলোর বাড়বাড়িও কিন্তু উদ্বেগ থেকেই হয়।

আবার সাগ্নিকবাবুর মতে, এই যে জিনিসপত্র কিনে ফেলার হিড়িক, খাবারদাবার মজুত করে রাখার প্রবণতা, এগুলোও ওই অনিশ্চয়তার উদ্বেগ থেকেই হয়। করোনা নিয়েই সারা দিন আলোচনা করে যাচ্ছেন, রসিকতা করলেও এর বাইরে বেরতে পারছেন না, অকারণে প্যানিক করছেন, নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন সব রকম কাজ থেকে, ভাল করে হাসতে ভুলেছেন— সবই এই উদ্বেগকেই বোঝায়।

আরও পড়ুন: করোনা-যুদ্ধে সাবানের চেয়ে স্যানিটাইজার কি বেশি প্রয়োজনীয়?

উদ্বেগের ফল

এই বাড়তি উদ্বেগ কতটা ক্ষতি করতে পারে? কী কী রোগ ডাকতে পারে?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামীর মতে, সারা ক্ষণ করোনার নানা ভাবনার সঙ্গে কড়া নজর, এই বুঝি একটু নাক কি চোখ চুলকালো, কি একটা হাঁচি এল বা শুরু হল খুশখুশে কাশি, গা কি একটু গরম লাগছে— এ সবও মাথার মধ্যে ঘুরছে। এই ধরনের স্ট্রেস যে সকলকেই রাতারাতি অসুস্থ করে ফেলবে তা নয়। তবে এই স্ট্রেস দিনের পর দিন চলতে থাকলে তা ক্রনিক মানসিক অসুখ তৈরি করবে। তাঁর কথায়: ‘‘মানসিক চাপ বেড়ে গেলে, শরীরে ক্ষতিকর রাসায়নিকের রমরমা এতই হয় যে তার দাপটে প্রতিরোধ যোদ্ধাটি চলে যায় ব্যাকফুটে। তার উপর দুশ্চিন্তায় ঘুম কমে, খাদ্যাখাদ্য বিচার থাকে না, আগ্রহ থাকে না ব্যায়ামে। সবে মিলে প্রতিরোধ ক্ষমতার অবনতি হয়। এ ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগীদের বেলায় অসুখ বেড়ে যাওয়ার ভয়ও বাড়ে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, আরও অস্থিরতা ও বিরক্তি বাড়ে।’’

আরও পড়ুন: কোভিড-১৯ দূর পর্যন্ত হাওয়ায় ছড়ায়! ‘হু’ এমন দাবি করেনি, জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

উদ্বেগ কাটাব কী ভাবে?

কী ভাবে ভাল থাকবেন দুশ্চিন্তার দিনেও, কী ভাবেই বা নিয়ন্ত্রণে রাখবেন উদ্বেগ? উপায় বাতলাচ্ছেন মনোবিদ সাগ্নিক ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, দুশ্চিন্তার দিনে ভয়ের আবহে সে জিনিস মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই উদ্বেগ থাকলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করার পাঠ জানতে হবে। যেমন:

• মন ভাল রাখে এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকুন। ছবি আঁকতে ভাল লাগলে, তাই করুন। গান গাইতে ভাল লাগলে তা-ই। রান্না করতে চাইলে সেটাই করুন। যার যে কাজে আনন্দ, তিনি তাতে কিছুটা সময় দিন। মন ভাল থাকবে। বাড়িতে থাকার সময় ভাল সিনেমা দেখুন, গান শুনুন, প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলুন, দেখতে দেখতে দিন কেটে যাবে।

• মন বসাতে সমস্যা হলে রোজ সকালে একটু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, বাড়িতে বসে করা যায় এমন কিছু ব্যায়াম, বিশেষ করে মন ভাল রাখার যোগা, ডিপ ব্রিদিং, মেডিটেশন করুন। এতে রক্তচাপ কমবে, শরীর ফুরফুরে হবে, সঙ্গে মনও আনন্দ পাবে।

• মনে রাখুন, যা জানি না, যা আমার হাতে নেই, তা নিয়ে অকারণ দুশ্চিন্তার কোনও মানেই নেই। ভাবলেই কেউ বিপদ এড়াতে পারবেন না। তাই অহতুক ভেবে মাথার উপর চাপ বাড়ানো থেকে দূরে থাকুন। করোনা হওয়ার আগেও মানুষ মারা যেতেন, এর পরেও মানুষ মরণশীলই থাকবেন, রাস্তাঘাটে যে কোনও দুর্ঘটনাও অকালে প্রাণ কাড়তে পারে। তাই অযথা মৃত্যুভয় পাবেন না।

• ঘুমনোর সময় হালকা কোনও গান বা বাজনা শুনুন। এতে স্নায়ু শান্ত হয়, ভাল ঘুম হয়। ঘুম মনকে অনেকটা শান্ত রাখে।

• স্ট্রেস কমাতে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া নিজের ইচ্ছেমতো ওষুধেরও কোনও প্রয়োজন নেই। ঘরে থাকাকে উপভোগ্য করে তুলতে নিজেরই মনের মতো কাজে যুক্ত থাকুন। তা হলেই অনেকটা আরাম পাবেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy