ঠাকুর চলে গেলে মনকেমন করে মৃৎশিল্পীদের? ছবি: পিটিআই।
পুজো আসতে বাকি আর সপ্তাহখানেক। বেশির ভাগ জায়গায় মণ্ডপ তৈরির কাজও শেষ। এখন শুধু সপরিবার মায়ের আসার অপেক্ষা। আর সে জন্যই যুদ্ধকালীন তৎপরতা নিয়ে কুমোরটুলির ঘুম ভাঙছে রাতের অন্ধকার থাকতেই। মূর্তি গড়ার কাজ শেষ হয়ে গেলেও তুলির টানের কাজ বাকি। কুমোরটুলিতে সব মিলিয়ে প্রায় ১৫০-১৮০টি গোডাউন আছে। সবগুলিতেই ব্যস্ততার ছবি। কোথাও প্রতিমার চোখ আঁকা হচ্ছে, কোনওটিতে আবার লক্ষ্মীর শাড়ি বাছাই নিয়ে চলছে জোর বিতর্ক। কারও পছন্দ লক্ষ্মী লালপেড়ে হলুদ বেনারসি পরুন। কমবয়সি মৃৎশিল্পীর পছন্দ ফুৎকারে উড়িয়ে বৃদ্ধ শিল্পীর নির্দেশ, লক্ষ্মী মায়ের মতো লাল বেনারসিতেই সাজবেন। মায়ের মেয়ে বলে কথা। অনেকে আবার সারা রাত ধরে কাজ করেছেন। ঘুম চোখে গণেশের শুঁড়ে আঁকিবুঁকি কাটতে গিয়ে মাঝেমাঝেই চোখটা লেগে যাচ্ছে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না, আর তো কয়েকটি দিন। তার পরেই তো কুমোরটুলি ফাঁকা করে মা চলে যাবেন অন্য কোনও খানে। কয়েক মাসের ব্যস্ততায় দাঁড়ি পড়বে আপাতত। মা তো না হয় সন্তানদের নিয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে বিরাজ করবেন, কিন্তু এতগুলি মাস দিন-রাত এক করে ঘাম ঝরিয়ে একটু একটু করে প্রতিমা গড়ে তুললেন যে শিল্পীরা, পুজোর চারটি দিন কী ভাবে কাটবে তাঁদের?
কুমোরটুলিতে প্রতিমাশিল্পীর সংখ্যা ৩৫০-র কাছাকাছি। অধিকাংশের বাড়িই কলকাতার বাইরে। এই যেমন চল্লিশোর্ধ্ব শিল্পী রঞ্জিত কুন্ডু। বাড়ি কৃষ্ণনগর। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে কুমোরটুলিতে পা রেখেছিলেন। তার পর এতগুলি বছর এখানেই কেটে গিয়েছে। তাঁর তৈরি করা মূর্তি মহালয়া থেকেই একে একে মণ্ডপে যেতে শুরু করবে। পঞ্চমীতে পুরো স্টুডিয়ো ফাঁকা। তার পর কী করবেন? রঞ্জিত বলেন, ‘‘বাড়ি চলে যাব। ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, বাবা-মায়ের সঙ্গে সে ভাবে দেখা হয় না। বাড়ি গেলেও কাজের চাপে তাড়াতাড়ি চলে আসতে হয়। বছরে এই চারটি দিন শুধু সকলের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পাই। সপ্তমীর দিন সকালের ট্রেন ধরে বাড়ি চলে যাব।’’ বাড়ির সকলের জন্য নতুন জামাকাপড় কেনেননি? রঞ্জিত বলেন, ‘‘আমি আর সময় কোথায় পেয়েছি! বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। কিনে নিয়েছে নিশ্চয়।’’
মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা বছর ২৬-এর অর্জুন পাল আবার সদ্য বিয়ে করেছেন। অর্জুন মূল প্রতিমাশিল্পী নন। তিনি সহায়ক। তাঁর বিয়ের পর এটাই প্রথম পুজো। তাই বাড়ি যাওয়ার তাড়াও খানিক বেশি। অর্জুন চান ষষ্ঠীর দিনই বাড়ি চলে যেতে। কিন্তু ঠাকুর চলে গেলেই তো কাজ মিটে গেল না। মণ্ডপে গিয়ে অনেক সময়ে ঠাকুরকে গয়না পরানো, মুকুট পরানোরও কাজ থাকে। অগত্যা এ বছর বাড়ি যেতে যেতে সপ্তমী হয়ে যাবেই বলে মনে হচ্ছে অর্জুনের। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক দিন পর বাড়ি যাব, আনন্দ তো হচ্ছেই। কিন্তু পুজো শেষ হলেই আবার চলে আসতে হবে। কালী, জগদ্ধাত্রী গড়ার কাজ আছে।’’
ঠাকুরের কাঠামোয় মাটির তাল লেপা থেকে শুরু করে মায়ের রূপদান— প্রতিটি কাজ নিজের হাতেই করেন মৃৎশিল্পীরা। এত পরিশ্রম করে মূর্তি গড়ার পর সেগুলি যখন প্লাস্টিকের মোড়কে ঢেকে অন্য কোথাও পাড়ি দেয়, মনকেমন করে না? সরস্বতীর চোখ আঁকতে আঁকতে শিল্পী খোকন পাল বলেন, ‘‘পরিশ্রম করে ঠাকুর গড়লে তা বিক্রি না হলেই বরং খারাপ লাগে। পাঁচজনে দেখে কাজের প্রশংসা করবেন, তবেই তো আমাদের পুজো শুরু হবে। না হলে আর এত পরিশ্রম করে কী লাভ!’’ একই মত মৃৎশিল্পী সমর পালের। বাড়ির ঠাকুরের গায়ে রঙের প্রলেপ দিতে দিতে সমর বলেন, ‘‘মনখারাপ কেন হবে? ঠাকুর মণ্ডপে গেলেই বরং ভাল লাগে। হাতে করে বানিয়ে তা যদি নষ্ট হয়, তা হলে তার চেয়ে কষ্টের আর কিছু নেই। পরিশ্রম জলে যায়।’’
পাশেই বসে ছিলেন পালান বিশ্বাস।সুন্দরবন থেকে এসেছেন। সঙ্গে এসেছেন স্বপন, রতন, পিন্টুরাও। দশ জনের দল। এঁরা কেউই মৃৎশিল্পী নন। বিশাল বিশাল উচ্চতার ঠাকুর কুমোরটুলি থেকে মণ্ডপে পৌঁছে দেন। তার পর যে যার বাড়ি ফিরে যান। আবার আসেন দশমীর দিন সকালে। ঠাকুর জলে ফেলে, তবেই এ বছরের মতো তাঁদের ছুটি। পালানের কথায়, ‘‘জলে পড়ার পর ঠাকুর কেমন দেখতে হয়ে যায়, তা আমরা একেবারে কাছ থেকে দেখতে পাই। ঠাকুর গড়াও দেখি। আবার মাটি গলে জলের সঙ্গে মূর্তি মিশে যেতেও দেখি। খারাপ লাগে। তবে বছরের এই সময়টা ভাল আয় হয় বলে আসি। মনখারাপ করলে পেটের ভাত তো জুটবে না।’’ নিজেদের হাতে বানানো ঠাকুর বাহারি আলো দিয়ে সাজানো মণ্ডপে কেমন শোভা পাচ্ছে, দেখতে ইচ্ছা করে না? ‘‘নিজেরাই তো বানালাম। সেটা আর দেখে কী করব। বরং বাড়ি চলে যাই। সেখানকার শিল্পীদের হাতের গড়া মূর্তি দেখি। কোনও কিছু ভাল লাগলে মনে রাখি। মূর্তি গড়ার সময়ে সেই ভাবনা কাজে লাগাই। নিজেদের গড়া ঠাকুর কোনও দিন দেখতে যাইনি।’’ ব্যস্ত হাতে মাটি মাখতে মাখতে বললেন মৃৎশিল্পী অজিত পাল।
ঠাকুর গড়তে গড়তে চুলে পাক ধরেছে শিল্পী রতন পালের। অশীতিপর রতন এখন আর তেমন তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে পারেন না। চোখেও ভাল দেখতে পারেন না। তবে কাঁপা কাঁপা হাতে হলেও ঠাকুরের চোখ আঁকেন তিনিই। বিজয়া দশমীর দিন যেমন মণ্ডপ ফাঁকা করে ঠাকুর চলে গেলে বুকের মধ্যে হু হু করে, টেম্পো গাড়িগুলি ধুলো উড়িয়ে যখন কুমোরটুলি থেকে ঠাকুর নিয়ে চলে যায়, বৃদ্ধ শিল্পীর দু’চোখ ভরে আসে জলে। শিল্পী বলেন, ‘‘তিন-চার মাস ধরে বানাতে বানাতে টান তৈরি হয়ে যায়। মেয়ের মতোই তো। আমারও তো মেয়ে আছে। আমার কাছে যে ক’দিন থাকে, আনন্দ হয়। শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেলে বুকে কেমন চিনচিনে ব্যথা করে। মূর্তি হলেও, দুর্গা তো মেয়ের মতোই। নিজের হাতে গড়া। চলে গেলে কষ্ট হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy