গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
‘সেকাল ও একাল’ শিরোনামের কোনও লেখা শুরু করতে হলে বাঙালির কর্তব্য এক বার রাজনারায়ণ বসুর আশীর্বাদ নিয়ে আসা। যিনি সেকাল ও একাল নামে লেখা একটি প্রবন্ধ-পুস্তিকাতে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার (১৮১৬) আগেকার বাঙালি সমাজের সঙ্গে তৎপরবর্তী (১৮৭০-এর দশক পর্যন্ত) বাঙালি সমাজের একটি তুলনামূলক আলোচনায় সেকালের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করেছিলেন। অনেক পরে, পার্থ চট্টোপাধ্যায় আবার ‘আমাদের আধুনিকতা’ শিরোনামের একটি লেখায় খোঁজার চেষ্টা করবেন, আধুনিক বাঙালি কেন বর্তমানের তুলনায় অতীতকে সব সময়েই শ্রেয় মনে করে?
ভোটের একাল ও সেকাল সংক্রান্ত আলোচনায় কেবলমাত্র সোনালি অতীতেরই স্মৃতিচারণ করে চলার অবশ্য কিছু সমস্যা আছে। ভোট পাওয়ার জন্য মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া, অর্থ দিয়ে ভোটারকে প্রভাবিত করা কিংবা ভোটের দিন ব্যালট বাক্সের (বা ইভিএম-এর) পাশে দাঁড়িয়ে ভোটারকে ভয় দেখানো, ইত্যকার যে সব নষ্টামির কথা আমরা আজকালকার ভোটের প্রসঙ্গে বলে থাকি, তারও একটা সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে। কত প্রাচীন? এই ধরুন আড়াই হাজার বছরের। ভোটের ইতিহাসে পাচ্ছি, রোমান অফিসার ম্যারিয়াস যীশুর জন্মের ১২০ বছর আগে এমন ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছেন, যাতে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারকে প্রার্থীদের লোকেরা এসে প্রভাবিত করতে বা ভয় দেখাতে না পারে।
তা হলে, এ কথা বলা কি বাড়াবাড়ি হবে যে, সত্যি সত্যি বদলেছে শুধু পোশাকের রং আর প্রচারের ঢং, দিন বদলায়নি কিছুই? একটু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করা যাক। বাবা ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। ১৯৭৭-এর পর শারীরিক কারণে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত নিয়মিত ভাবে ভোটের দিন দেরি করে ফিরতেন। গল্প শুনেছি, ভোট চলাকালীন দুই পক্ষের পোলিং এজেন্টদের নিজেদের মধ্যে রঙ্গ রসিকতার আদানপ্রদান হত অনেক সময়েই। বামপন্থী বাবা এবং তাঁর সহযোগীরা ভোটের দিন মুড়ি চানাচুরের লাঞ্চ করতেন। অপর পক্ষের জন্য আসত মাংসের হাঁড়ি। অফারও করতেন তাঁরা। একটি সৌজন্যের আদানপ্রদান হয়তো ছিল, অন্তত মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে।
দুর্বৃত্তায়নও নিশ্চয়ই ছিল। খুব ছোটবেলার স্মৃতিতে আছে ভোট দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে মাসির বাড়ি ফিরে বলছেন, ভোট পড়ে গিয়েছে; আর ভোট দিতে দিল না। আবার, কোনও বিশেষ সলিউশন ব্যবহার করে আঙুলের কালি তুলে ভোট দিয়ে আসা যায়— এ নিয়ে স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা শুনেছি সত্তরের দশকে। আলোচকদের বয়স তখন দশ-বারোর বেশি হবে না।
শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে ভোট নিয়ে এক রকম উত্তেজনা ছিলই। অন্তত আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সেটা লক্ষ করেছি। ভোটের কিছু দিন আগে থেকে পাড়ার গলির আকাশ— দড়ি আর কাগজের পতাকায় ছেয়ে যেত। দেওয়ালগুলি ভরে উঠত নানা ওয়ান লাইনার, টু লাইনারে। আর সন্ধ্যাগুলিতে ঘুঘনিওলা বা লড়াইয়ের চপের হাঁকের সঙ্গে যুক্ত হত নানা রকম মিছিলের আওয়াজ। অনেক পরে কংগ্রেসি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আমার এক পরিচিত বলেছিলেন, আমরা তো জানতাম ভোট একটা দিনের ব্যাপার। তার ক’দিন আগে থেকে একটু ঘুরতে হয়, প্রচার করতে হয়। অন্য সময় চাকরি আছে, ব্যবসা আছে, রোজগারের ধান্ধা আছে, অত সময় কোথায়? কিন্তু বামপন্থীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, রাজনীতি, আন্দোলন আর প্রচারটা সম্বৎসর না চালালে এদের সঙ্গে পারা যাবে না। আমরা অনেকেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম তখন।
আমার ধারণায় ভোট নিয়ে শহুরে মধ্যবিত্তের আবেগ কমতে থাকে নব্বইয়ের দশক থেকে। এই সময়ে ঘটনাচক্রে আমিও শহর ছেড়েছি। কলেজের চাকরি নিয়ে তখন কাকদ্বীপে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তখন সরকারি আমলা। পাশেই কুলপিতে পোস্টেড। এক দিন আড্ডাপ্রসঙ্গে বলল- দেখ আমাদের মতো শহরের লোকের রাজনীতি করাটা অপশনাল। সরকার যে আছে, সেটা বুঝলেও চলে, না বুঝলেও চলে। কিন্তু এখন গ্রামে এসে বুঝতে পারছি মানুষের জীবনে সরকারের অস্তিত্ব কত প্রবল। আর সরকারের কাছ থেকে কিছু পেতে গেলে রাজনীতির সঙ্গে একটা যোগও গ্রামের মানুষকে রাখতে হবেই। ভোটের আগে মিটিং মিছিল করা এখানে ঐচ্ছিক নয়, বাধ্যতামূলক।
মনে হয় এই সময় থেকেই বাঙালি ভোটের রাজনীতিতে শহর তার গুরুত্ব হারাচ্ছিল। মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক আদর্শ, গণসঙ্গীত, গণনাট্য আন্দোলন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ভিয়েতনাম, শান্তিমিছিল ইত্যাদি ইস্যুগুলি আর যেন আগের মতো প্রাসঙ্গিক রইল না। বাঙালি ভোটের সেকাল ফুরিয়ে আসছিল। গণনাট্য-গণসঙ্গীতের জায়গায় হোপ এইটটি-সিক্সের মতো জনপ্রিয় সংস্কৃতির উপর ভরসা বাড়তে শুরু করল। নব্বইয়ের দশকটাকে নানা ভাবেই যুগান্তরের সময় বলা যায়। ইতিহাস দেখছে সোভিয়েত ব্লকের ভাঙন, মনমোহন সিংহের সরকারের নতুন অর্থনীতি, একমেরু বিশ্বের সম্ভাবনা; আর আমরা দেখছি কেব্ল টিভি, মোবাইল ফোন, ফোর এইট সিক্স মাইক্রোপ্রসেসর। ভোটের ধরনধারন, প্রচারের স্টাইল, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, যেন তেন প্রকারে জয় করার ইচ্ছা- কিছুই আর ঠিক আগের মতো থাকছে না।
আমার মনে হয় বাঙালি ভোটের একালের শুরু নতুন সহস্রাব্দ থেকে। সাধারণ শহুরে মধ্যবিত্ত এতদিনে সম্পূর্ণ ভাবে রাজনীতি বিমুখ। রাজনীতি করি এটা আর গর্ব করে বলার বিষয় নয়। বরং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আর সরকারি কর্মক্ষেত্রগুলিতে রাজনীতি হয়ে উঠেছে কিছু আদায় করে নেওয়ার একটা মাধ্যম। স্বাভাবিক ভাবেই, সেকালের রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা, সব কিছু ছেড়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার উন্মাদনা আর নেই। দিন বদলের স্বপ্নটাকে একালে জাপটে ধরে থাকছে কেবল সুমনের গান। আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় রাজনীতির আদর্শগত ইস্যুগুলিও বাংলার ভোটে আর ম্যাটার করে না তেমন। ম্যাটার করে কোন কোন বুথ দখল করা যাবে? কত ঘণ্টার জন্য বুথ দখল করলে ক’টা আসন নিশ্চিত করা যাবে— এই হিসাবগুলিই। এই পরিস্থিতিতে শেষ বারের জন্য বাঙালি মধ্যবিত্তের, বাঙালি সংস্কৃতি জগতের কিছু ব্যক্তিত্বের বিবেক শেষ বারের মতো জাগ্রত হয়ে উঠেছিল নন্দীগ্রাম, সিঙুরের জমি আন্দোলনকে ঘিরে।
গত এক দশকের নির্বাচনে কিন্তু মিটিং, মিছিল স্লোগান আর দেওয়াল লিখনের তুলনায় তথ্যপ্রযুক্তি এবং সামাজিক মাধ্যমের নিখুঁত ব্যবহার বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নানা রকমের কন্সপিরেসি থিয়োরি আর পোস্ট-ট্রুথের এই বিশ্বে সত্য, অর্ধসত্য আর পুরো মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণ অসম্ভব হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের পক্ষে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর সব দুর্বলতাগুলিকে ব্যবহার করে কিছু দক্ষ মানুষ দিন-রাত বোকা বানিয়ে চলেছে আমাদের। ‘অনেক লোককে অনেক দিনের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা সম্ভব নয়,’ এই উক্তির উপরে আর কত দিন ভরসা রাখা যাবে, তা-ই নিয়ে সংশয় হয়।
বাঙালি ভোটের সেকাল আর একালের পার্থক্যকে যদি দু’-এক কথায় ধরতে চাই, তা হলে বলব, এক দিকে ভোটের রাজনীতিতে মধ্যবিত্তের গুরুত্ব কমেছে অন্য দিকে দৈনন্দিনতার অভিজ্ঞতার তুলনায় কল্পিত বাস্তবতার গুরুত্ব বেড়েছে সাধারণ মানুষের চেতনায়। ইংরেজ আমলে সাধারণ খেটে খাওয়া গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল ক্ষীণ। স্বাধীনতার পর থেকে এই সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৭১-এর গরিবী হটাও কর্মসূচি, ১৯৭৫-এর বিশদফা কর্মসূচি এবং আশির দশকে বাংলায় পঞ্চায়েতী রাজের প্রতিষ্ঠা সত্যিই সরকারকে গ্রামের মানুষের দুয়ারে নিয়ে এল। সরকারি সুযোগ-সুবিধেগুলি বুঝে নেওয়ার জন্য গ্রামের মানুষ প্রথম এক দুই দশক শহুরে নেতাদের মধ্যস্থতার উপরে অনেকটা নির্ভরশীল ছিলেন। এই নির্ভরশীলতা কালের নিয়মেই কাটতে শুরু করলে গ্রাম প্রকৃত অর্থে নিজস্ব রাজনৈতিক অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করে।
একালের দ্বিতীয় বড় পরিবর্তন ঘটেছে মনে হয় ইস্যুর ক্ষেত্রে। ভোট দেওয়াটা এক দিকে একটা খুব ব্যক্তিগত কাজ বটে কিন্তু একই সঙ্গে এটা এক জন ভোটদাতাকে আরও অনেক অনেক ভোটদাতার একটা বড় সমষ্টির সঙ্গে একাত্ম হতে প্রণোদিত করে। যে ভোট দিতে গিয়েছে, সে নিজেকে কল্পনা করে পরস্পর প্রতিদ্বন্দী দলগুলির কোনও একটির সমর্থকগোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে। এই কল্পনা দু’ভাবে হতে পারে। সে তার নিজের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বেছে নিতে পারে তার জীবনযাত্রাকে সুগম করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযোগী গোষ্ঠী কোনটি। অথবা, এই কল্পনা তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে নানা প্রক্রিয়ায়। নানা নকল বাস্তবতা তৈরি করে সমাজমাধ্যমে শেয়ার করার যে প্রবণতা, আমরা দেখতে পাই সেটা এই ধরনের উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কল্পিত গোষ্ঠী তৈরির চেষ্টা, যা আপনাকে শিখিয়ে দেয় কোন গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কথা আপনাকে গর্বের সঙ্গে বলতে হবে। কাদেরই বা চিরে দিতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, দৈনন্দিনতার অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে ভুলে যাচ্ছি। তাই নির্ভর করতে হচ্ছে শিখিয়ে দেওয়া, চাপিয়ে দেওয়া পরিচয়ের উপর। একালের ভোটের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা সম্ভবত এটাই। যে ন্যায় ও মূল্যবোধ ভারতীয় এবং বাঙালি ভোটারকে রাস্তা দেখিয়েছে ১৯৭৭-এ, হয়তো বা ২০১১ সালেও, সেই ন্যায়বোধ হারিয়ে আমরা অন্যের শেখানো বুলি-নির্ভর আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে শিখে নিচ্ছি, এটাই দুঃখের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy