মাতৃস্তন্যে ডেকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিডের উপস্থিতি বুদ্ধির বিকাশে সাহায্য করে। ছবি: শাটারস্টক।
পৃথিবীর গভীর অসুখ হয়তো এতটা মারাত্মক চেহারা নিত না, যদি প্রতিটি মা তাঁর সদ্যোজাতকে স্তন্যপান করাতেন। কোভিড ১৯ মোকাবিলার সঠিক ওষুধের সন্ধানে বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা দিন-রাত এক করে গবেষণা করে চলেছেন। সদ্যচেনা ভাইরাস আটকাতে বিশেষজ্ঞদের দাওয়াই— স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা। আর জন্মের পর ইমিউনিটি বাড়ানোর প্রথম ধাপ সদ্যোজাতকে স্তন্যপান করানো।
আজ ওয়ার্ল্ড ব্রেস্ট ফিডিং উইকের প্রথম দিনে এই কথাটাই প্রতিটি মাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্ট ফিডিং অ্যাকশন। এই মনে করানোর কাজটা হয়ে চলেছে গত ২৮ বছর ধরে। ১৯৯০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ যৌথ ভাবে মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা সম্পর্কে প্রচার শুরু করে। এদের উদ্যোগে ১৯৯২ সালের ১–৭ অগাস্ট প্রথম মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালন শুরু হয় বিশ্বজুড়ে। কোভিড অতিমারির সময়েও সদ্য মা ও তাঁদের পরিবারকে সচেতন করতে পৃথিবীজুড়ে পালন করা হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ব্রেস্ট ফিডিং উইক। বিশ্বের ১২০ টি দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশও তাতে সামিল।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ পল্লব চট্টোপাধ্যায় জানালেন যে, মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে কৃত্রিম ফর্মুলা দুধের একটা বিশেষ পার্থক্য আছে। মায়ের দুধের উপাদান শিশুর দরকার অনুযায়ী অনবরত বদলে যায়। সদ্য জন্মানো শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত মাতৃদুগ্ধের উপাদান বদলাতে থাকে। তাই প্রত্যেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ বিষয়ে একমত যে, জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস এক্সক্লুসিভলি মায়ের দুধ দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। পল্লববাবু আরও জানালেন, ব্রেস্ট মিল্কে ডেকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিড নামে একটি বিশেষ ধরনের উপাদান থাকে, যা শিশুর বুদ্ধির বিকাশে অত্যন্ত উপযোগী।
আরও পড়ুন: করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকতে কী কী প্রয়োজন? কী বললেন চিকিৎসকেরা?
মস্তিষ্কের বিভিন্ন নতুন নতুন সংযোগ রক্ষাকারী পাথওয়ের বিকাশের জন্যে প্রয়োজন ডেকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিড। এর ফলে বুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষমতা বাড়ে। এই প্রসঙ্গে পল্লববাবু জানালেন, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর ব্যাপারে আমাদের দেশ একেবারে প্রথম সারিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রত্যেক বছর অজস্র পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু মারা যায় স্রেফ ডায়ারিয়ার কারণে।
স্তন্যপান করালে জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। ছবি: শাটারস্টক
পাকিস্তান, মায়ানমার, কেনিয়ার মতো অনুন্নত দেশকে পিছনে ফেলে শিশুমৃত্যুর নিরিখে এগিয়ে আমাদের দেশ। পল্লববাবু বললেন, জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস যে শিশু শুধুমাত্র মায়ের দুধ খেয়ে বেড়ে ওঠে তাদের ডায়ারিয়া সহ অন্যান্য অসুখবিসুখের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। সর্দি, জ্বরের মতো সমস্যাও অনেক কম হয়। সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ল্যাকটেশন নার্স সায়ন্তী নাগচৌধুরী জানালেন যে, বিভিন্ন উন্নত দেশে হবু মায়েদের ব্রেস্টফিডিং সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সম্প্রতি আমাদের দেশেও সেই কাজ শুরু হয়েছে। প্রত্যেক বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মায়ের দুধের উপযোগিতা ও মায়েদের দুধ দিতে উৎসাহ দিয়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
আরও পড়ুন: করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকতে কী কী প্রয়োজন? কী বললেন চিকিৎসকেরা?
কোভিডের কারণে এ বছরের ২৮তম ব্রেস্ট ফিডিং অ্যাওয়ারনেস উইক নীরবে এলেও, মাতৃদুগ্ধ দেওয়ার ব্যাপারে আধুনিক মায়েদের মধ্যে সচেতনতা আগের থেকে কিছুটা বেড়েছে। হবু মা প্রসবের জন্যে হাসপাতালে ভর্তি হলেই সায়ন্তী তাঁদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। মায়ের দুধই যে শিশুর সেরা খাবার, তা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে দুধ দিলে ফিগার নষ্ট হওয়ার মতো ধারণা যে সম্পূর্ণ ভুল তাও জানাতে ভোলেন না তিনি। স্তন্যপান করালে জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে সেই কথা বুঝিয়ে দেন। ইদানীং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিজারিয়ান সেকশন করে বাচ্চা হয় বলে সদ্য মা ব্যথায় কাতর থাকেন।
আরও পড়ুন: জ্বর না হয়েও করোনা আক্রান্ত অনেকেই, এ সব বিষয়ে সতর্ক হতে বলছেন চিকিৎসকরা
বাচ্চাকে স্তন্যপান করানোর কষ্ট সহ্য করতে চান না। এই ব্যাপারেও তাঁদের অনবরত কাউন্সেলিং করতে হয় বলে জানালেন সায়ন্তী। তবে ইদানীং মায়েদের মধ্যে এই ব্যাপারে অনেক সচেতনতা বেড়েছে। মায়ের দুধ খাওয়ানোর সঠিক নিয়ম জানানোর পাশাপাশি কর্মরতা মায়েদের ব্রেস্ট মিল্ক সংরক্ষণ করার ব্যাপারেও পরামর্শ দেওয়া হয়। সায়ন্তী জানালেন, মায়ের দুধ খেলে শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মা ও শিশু— দু’জনের মধ্যেই একটা বন্ধন তৈরি হয়।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মৌপিয়া চক্রবর্তী বললেন, সদ্যোজাতর ডাইজেস্টিভ সিস্টেম ওদের মতোই ছোট্ট। বাইরের খাবার খাওয়া আর হজম করা বেশ মুশকিল। আর ঠিক এই কারণেই ওদের জন্যে একবারে আদর্শ খাদ্য হল কোলোস্ট্রাম, যা শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নিঃসৃত হয়। প্রোটিন, ভিটামিন এ ও সোডিয়াম ক্লোরাইড সমৃদ্ধ অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এই দুধ সামান্য খেলেই শিশুর পেট ভরে যায়। অন্যদিকে, সদ্য মায়ের এই হলদেটে দুধ গ্রোথ ফ্যাকটর ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ফ্যাক্টর সমৃদ্ধ হওয়ায় শিশুর ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রথম ধাপ তৈরি হয়। অথচ গ্রামাঞ্চলে এবং শহরের মায়েদের মধ্যেও অনেক সংস্কার আছে বলে প্রথম দুধ বাচ্চাকে দেওয়া হয় না। সদ্যোজাত শিশুর একমাত্র দাবি, সহজে ভরপেট খেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমানো।
বোতল টানলে অল্প পরিশ্রমেই বেশি দুধ পায়, তাই একবার বোতলে অভ্যস্ত হলে কষ্ট করে মায়ের দুধ টেনে খেতে চায় না। জন্মের পর পরই মায়ের দুধ টেনে খেতে শেখান, তাতে লাভ মা-শিশু দু’জনেরই। বিশ্ব মাতৃ দুগ্ধ সপ্তাহে আত্মজকে স্তন্যপান করানোর শপথ নিন প্রতিটি হবু মা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy