খাবারে নানারকম ভেজাল মেশানোর যুগে ঠেকায় পড়েই কিছুটা স্বাস্থ্যসচেতন হচ্ছেন মানুষ। স্বাদের টানে আগে যে মিষ্টি, ভাজাভুজির দিকে নির্দ্বিধায় হাত বাড়াতেন, এখন তার সামনে পড়লে নিজেকে সামলে নিচ্ছেন। সমাজমাধ্যম নানা ক্ষেত্রের মানুষকে এক জায়গায় এনে ফেলেছে। যার দৌলতে বিশ্বের নানা প্রান্তের পুষ্টিবিদ চিকিৎসকেদের পরামর্শ শুনতে পারছেন জানতে পারছেন মানুষ। স্বাস্থ্যোদ্ধারের প্রসঙ্গে তাঁদর কেউ বলছেন চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়া কমাতে, কেউ বলছেন তেলে ভাজা খাবারে নিয়ন্ত্রণ আনতে। কিন্তু কোনটি বেশি খারাপ? কোনটি একেবারেই বন্ধ করা উচিত? না কি দু’টিই একসঙ্গে বন্ধ করলে শরীর ভাল থাকবে? এই সব প্রশ্নের জবাব এক সাক্ষাৎকারে দিয়েছেন লিভারের রোগের বিষয়ে অভিজ্ঞ দেশের এক নামী চিকিৎসক শিব কুমার সারিন। তিনি বুঝিয়ে বলেছেন, চিনি এবং তেলে ঠিক কতটা করে ক্যালোরি আছে। তা শরীরের উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে।
ক্যালোরি মিটারে তেল বনাম চিনি
তেলের দর বেশি। চিকিৎসক সারিন জানাচ্ছেন, তেলের ক্যালোরিও বেশি। ১ গ্রাম চিনিতে রয়েছে ৪ ক্যালোরি। অন্য দিকে ১ গ্রাম তেলে ক্যালোরির পরিমাণ ৯। অর্থাৎ ৫ গ্রাম তেল খেলেই ৪৫ ক্যালোরি চলে গেল আপনার শরীরে। যা প্রায় ২ চা-চামচ চিনি খাওয়ার সমান। তা হলে কোনটি বেশি খারাপ? জানতে হলে বুঝতে হবে কোনটি খেলে শরীরে কী প্রভাব পড়ে।

চিনিতে থাকা পুষ্টিহীন ক্যালোরি ওজন বৃদ্ধি করে। —ফাইল চিত্র।
চিনি শরীরে গেলে কী হয়?
স্থূলত্ব থেকে শুরু করে মধুমেহ রোগ, এমনকি, লিভারের অসুখেরও অন্যতম কারণ চিনি বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসক। তিনি বলছেন, ‘‘অতিরিক্ত চিনি খেলে তা লিভারে ফ্যাট জমায়। যা থেকে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার তৈরি হতে পারে। যা লিভারের বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে। আর লিভার খারাপ হওয়ার অর্থ গোটা শরীরে নানা রোগের প্রকোপ শুরু হওয়া। কারণ পাচন থেকে শুরু করে নানা রকমের হরমোনের ক্ষরণ সবই নিয়ন্ত্রিত হয় লিভার থেকে।’’ চিনি থেকে হওয়া যে চারটি মূল ক্ষতির কথা জানিয়েছেন চিকিৎসক, তা হল—
১। রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে ইনস্যুলিনের কাজ করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
২। চিনিতে থাকা পুষ্টিহীন ক্যালোরি ওজন বৃদ্ধি করে।
৩। ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, যা লিভারকে নষ্ট করে, শরীরে প্রদাহ বৃদ্ধি করে।
৪। রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে হার্টের স্বাস্থ্যে কুপ্রভাব ফেলে।

তেলে যদি অতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, তবে তা থেকে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে। —ফাইল চিত্র।
তেল খেলে কী কী হয়?
অতিপ্রক্রিয়াজাত এবং হাইড্রোজেনেটেড তেল স্বাস্থ্যের নানা রকম ক্ষতির আরও একটি কারণ। তবে চিনি যেমন সব দিক থেকেই খারাপ, তেল ততটা নয়। কিছু তেলে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিডও থাকে, যা মস্তিষ্ক সঞ্চালন এবং কোষের মেরামতির জন্য জরুরি। তাই কী তেল, কী ভাবে খাওয়া হচ্ছে এবং কতখানি খাওয়া হচ্ছে তার উপর পুরোটা নির্ভর করে। অস্বাস্থ্যকর ভাবে তেল খেলে যে যে ক্ষতি হতে পারে, তা হল—
১। অতিরিক্ত তেল খেলে তা থেকে ওজন বাড়তে পারে।
২। তেলে যদি অতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, তবে তা থেকে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
৩। অতিরিক্ত খেলে তেল থেকেও ফ্যাটি লিভারের সমস্যা হতে পারে।
৪। তবে জলপাইয়ের তেল, নারকেল তেল, সর্ষের তেলের মতো কিছু তেলের উপকারিতাও রয়েছে। যদি তা পরিমাণ বুঝে ব্যবহার করা হয়, তবে সেই উপকার মিলতে পারে।

কী তেল কী ভাবে খাচ্ছেন, তার উপর নির্ভর করবে ক্ষতির পরিমাণ। ছবি: সংগৃহীত।
তা হলে কোনটি বাছবেন?
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র পরামর্শ হল, রোজ যে পরিমাণে ক্যালোরি শরীরে যায় চিনি থেকে পাওয়া ক্যালোরির পরিমাণ তার ১০ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখতে। অর্থাৎ যদি রোজ ১০০০ ক্যালোরি আপনার প্রয়োজন হয়, তবে চিনি থেকে পাওয়া ক্যালোরির পরিমাণ কোনও ভাবেই ১০০ ক্যালোরির সীমা পেরোবে না। অর্থাৎ সারা দিনে চার চা-চামচের বেশি চিনি খাওয়া যাবে না।
- সুস্বাস্থ্য এবং হজমের জন্য কিছুটা তেল জরুরি। চিকিৎসক সারিন বলছেন, তবে কী তেল বাছছেন, তার উপর নির্ভর করছে পুরোটা। নিয়ন্ত্রিত মাত্রার জলপাইয়ের তেল, সর্ষের তেল এবং নারকেল তেল ব্যবহার করলে তা শরীরে পুষ্টিগ্রহণের সুবিধা করে দেয়। তবে প্রক্রিয়াজাত এবং যে কোনও হাইড্রোজেনেটেড তেল এড়িয়ে চলাই ভাল।