ভোগের থালা।
তখনও এ বঙ্গে দুর্গাপুজোর এত প্রচলন হয়নি। মূলত জমিদারবাড়িতে পুজো হত। পরে ‘বারো ইয়ারি’ বা বারোয়ারি পুজোর চল শুরু হয়। বন্ধুবান্ধব মিলে চাঁদা তুলে সে পুজোর শুরু। তা-ও ছিল হাতে গোনা। তবে জমিদারবাড়ির পঙ্ক্তিভোজে আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ আসত পুজো দেখতে। কাজেকর্মেও তাঁরা জুটে যেতেন। কেউ মায়ের অধিষ্ঠানের জায়গা গোছাতেন, কেউ হেঁশেলে লেগে যেতেন জোগাড়ে। পুজোশেষে ঠাকুরদালানের কোল ঘেঁষে পাত পড়ত বহু মানুষের। খিচুড়ির বালতি নিয়ে নেমে পড়ত গ্রামের ছেলেপুলেরা। সব পুজোর ভোগেই খিচুড়ির অগ্রাধিকার।
মনসামঙ্গলেও উল্লেখ পাওয়া যায় স্বয়ং মা দুর্গা ডাবের জল দিয়ে চাল-ডাল ফুটিয়ে খিচুড়ি তৈরি করে দিচ্ছেন মহাদেবকে। তাই মা যখন মর্ত্যধামে আসছেন, তখন তাঁর ভোগে খিচুড়ি থাকবে না, তা কখনও হয়? ক্রমে ক্রমে সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে পরমান্ন, পোলাও। তবে কুলাচার মেনে ভোগের পার্থক্য আছে। যেমন কিছু বাড়িতে অন্নভোগ হয়। আর যে বাড়িতে সে নিয়ম নেই, সেখানে লুচি। আবার শীতলভোগেও লুচি দেওয়া হয়। তবে অন্নভোগেরও আবার অনেক ভাগ...
অন্নভোগ
খিচুড়িভোগ দিয়ে শুরু করা যাক। পুজোর ক’দিন রোজ খিচুড়ি তৈরি হয় বেলুড় মঠে। শংকরের ‘বাঙালির খাওয়াদাওয়া’-য় উল্লেখ রয়েছে, রোজ জাহাজ-সাইজ়ের কড়াইয়ে কয়েক কুইন্টাল খিচুড়ি তৈরি হয়। সেই আনাজ কাটার জন্য নিযুক্ত থাকেন ব্রহ্মচারী ও সেবকরা। স্বয়ং স্বামীজিও শিকাগো থেকে মঠে ফেরার পরে এই কাজে ব্যাপৃত থাকতেন। এ বিষয়ে গুরুভাই স্বামী তুরীয়ানন্দের মন্তব্য, ‘‘দেখ নরেনের সব কাজ কী চট্পট্, কুটনো কোটা দেখ, পাঁচমিনিটে সব কুটনো কুটে ফেললে। আলুর খোসা ছাড়ানো দেখ, আলুকে আঙুল দিয়ে ধরলে, বঁটির গায়ে ছোঁয়াতে লাগল আর ঠিক খোসাটি উঠে গেল। আলুটা কোন জায়গায় বেঁধে গেল না বা চোকলা উঠে গেল না।’’ পুজোর ক’দিন মঠে আগত লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে এই ভোগ বিতরণ হয়।
অন্নভোগে খিচুড়ি ছাড়াও ঘি-ভাত, পোলাও, পান্তা নিবেদন করা হয়। কলকাতার আদিতে গেলে, সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বড়িশার আটচালার বাড়িতে ১৬১০ সাল থেকে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। সপ্তমীর ভোগে থাকে খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, আলুর দম, ফুলকপির তরকারি, দু’রকম মাছ, চাটনি, পাঁপড় ইত্যাদি। অষ্টমীতে ভাত, শুক্তো, এঁচোড়ের ডালনা, মোচা, দু’রকম মাছ। নবমীর ভোগে থাকে দম পোলাও। ‘‘আর সন্ধিপুজো শুরুর সময়ে শুকনো তালপাতা, নারকেল পাতার আগুনে খিচুড়ি রান্না হয় মাটির সরায়। খিচুড়ি হয়ে গেলে সেই আঁচেই ল্যাটা মাছ পোড়ানো হয়। সন্ধি পুজোয় এই খিচুড়ি ও ল্যাটা মাছ ভোগ দেওয়া হয় মাকে,’’ বললেন বাড়ির ৩৪তম প্রজন্মের বড় ছেলে পার্থ রায়চৌধুরী।
আবার চালতাবাগানের কাছে ভট্টাচার্য বাড়ির পুজোয় হয় ভুনি খিচুড়ি। ভট্টাচার্যদের আদি নিবাস ময়মনসিংহ। পূর্ববঙ্গে এখনও তাঁদের বাড়ির পুজো রাঘবরাম ভট্টাচার্যের পুজো নামে হয়ে আসছে। সেই বংশেরই একটা অংশ চলে আসে এ-পার বাংলায়। ভট্টাচার্য পরিবারের চতুর্থ প্রজন্ম ইন্দ্রাশিস ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘আমাদের ভোগের খিচুড়ির বৈশিষ্ট্য হল এটি ঝুরঝুরে পোলাওয়ের মতো তৈরি করা হয়। তার ইতিহাস আছে। স্বাধীনতার আগেই আমার পিতামহ, প্রপিতামহ চলে আসেন এ দেশে। তাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সে সময়ে একবার নেতাজি আসেন সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোয়। তাঁর জন্যই তৈরি হয়েছিল এই ভুনি খিচুড়ি। দাদা শরৎচন্দ্র বসুকে নিয়ে তিনি খেয়ে খুব প্রশংসা করেছিলেন। সেই ছবিও আছে আমাদের কাছে। তার পর থেকে সেই ধারা চলে আসছে।’’ গোবিন্দভোগ চাল ও মুগের ডাল দিয়ে তৈরি হয় এই খিচুড়ি। সাধারণত খিচুড়িতে ডাল ও চালের ভাগ সমান থাকে। কিন্তু এই খিচুড়িতে চাল ১০০ শতাংশ হলে, ডাল ৭৫ শতাংশ। নবমীতে এই খিচুড়ি নিবেদন করা হয় মাকে।
অন্নভোগে পান্তা দেওয়ার চলও আছে। দশমীতে পান্তা খাইয়ে বাড়ির মেয়েকে রওনা করা হয় শ্বশুরালয়ের উদ্দেশে। ভট্টাচার্য বাড়িতে পোস্তর বড়া, গয়না বড়ি ভাজা দিয়ে পান্তা ভোগ দেওয়া হয় সে দিন। আর রায়চৌধুরী পরিবারে দশমীতে পান্তার সঙ্গে নিবেদন করা হয় চালতার ডাল, কচুর তরকারি, কই মাছ, পরমান্ন ইত্যাদি।
তবে অন্নভোগ নিবেদনে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। সেই নিয়ম মেনে দর্জিপাড়া মিত্রবাড়ির পুজোয় মায়ের ভোগে খিচুড়ি, চচ্চড়ি সবই নিবেদন করা হয়, না রেঁধে। প্রায় ২০০ বছরের পুরনো পুজোর ভোগ বিষয়ে বাড়ির মেয়ে অনসূয়া বিশ্বাস বললেন, ‘‘আমরা যেহেতু কায়স্থ, অন্নভোগ রেঁধে দিতে পারি না। কিন্তু ভোগের সব কিছু নৈবেদ্যর মাধ্যমে মাকে দেওয়া হয়। যেমন খিচুড়ির জন্য থালায় চালের স্তরের উপরে ডাল দিই। ঘি মাখিয়ে সেই চাল রোদে দিয়ে নেওয়া হয় আগেই। তার পাশে পাঁচ ভাজার আনাজ কেটে গুছিয়ে দেওয়া হয়। চচ্চড়ির আনাজ কেটে, পাশে রান্নার মশলা ছোট খুড়িতে সাজিয়ে দিই।’’
অন্য ভোগ
অন্নভোগের রীতি যেখানে নেই, সে সব বাড়িতে লুচি, মিষ্টি, নাড়ু সাজিয়ে দেওয়া হয়। যেমন সুরুল জমিদার বাড়িতে পুজোর ক’দিন ভিয়েন বসিয়ে তৈরি হয় পান্তুয়া, মিহিদানা, লাড্ডু ও নানান মিষ্টি। সঙ্গে থাকে নারকেল নাড়ু ও সিরির নাড়ু (গুড়ে পাক দেওয়া বেসনের তৈরি)। প্রায় ৩০০ বছর আগে কৃষ্ণহরি সরকারের সময়ে শুরু হয় এই পুজো। তখন থেকে এই রীতি চলে আসছে। গড়ে প্রত্যেক দিন ৫০ থেকে ১০০টি পুষ্পথালায় ভোগ নিবেদন করা হয়। পরিবারের দশম প্রজন্ম শিবপ্রসাদ সরকারের কথায়, ‘‘প্রত্যেক থালায় মিষ্টান্ন সাজিয়ে পাঁচজন সেবক নারায়ণ মন্দির থেকে দুর্গামন্দিরে নিয়ে যান। আর পুজো শুরুর আগে পাঁচ ব্রাহ্মণ নারায়ণের মাথায় ছাতা ধরে, দু’পাশে সেজ জ্বালিয়ে, চামরের বাতাসে, নিঃশব্দে দুর্গামন্দিরে নিয়ে যান। নারায়ণ সাক্ষী রেখেই শুরু হয় পুজো। ভোগ আরতির আগে গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি, সুজির হালুয়া ও মিষ্টি নিবেদন করা হয়।’’ এই পুজোর বৈশিষ্ট্য সাবেকিয়ানায়। ঝাড়লণ্ঠনের আলোয়, সানাই ও ঢোল-কাঁসরের আবহে মাকে আবাহন করা হয়।
মিষ্টান্ন ভোগ দেওয়া হয় জোড়াসাঁকো শিবকৃষ্ণ দাঁ-বাড়িতেও। নারকেল ছাপ, চন্দ্রপুলি, বিভিন্ন ক্ষীরের মিষ্টি, রাবড়ি থাকে ভোগে। মা, তাঁর ছেলেমেয়ে, বাহনদের রোজ ৮টি করে আর সন্ধিপুজোয় ১৬টি করে সব রকমের মিষ্টি দেওয়া হয়, বলে জানালেন বাড়ির ষষ্ঠ প্রজন্মের পুত্র প্রিয়ব্রত দাঁ।
আবার বাড়ির মেয়ের মতোই মাকে আপ্যায়ন করা হয় বলে দর্জিপাড়া মিত্রবাড়িতে সারা বছর ধরে আম, কুল, তেঁতুলের আচার, বড়ি তৈরি করে নিবেদন করা হয় মাকে। লুচি ও নানা রকমের ভাজাও (নুন ছাড়া) দেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে গজা ও বিভিন্ন মিষ্টি।
আমিষ ভোগ
কিছু পরিবারে আবার আমিষ ভোগ হয়। যেমন, সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বাড়িতে ভোগে রোজ মাছ থাকে। তবে মাকে আঁশযুক্ত মাছ দেওয়ার নিয়ম। বাড়ির কুলদেবতা রাধা-গোবিন্দর মন্দিরে অবশ্য নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। আর মাকে নিবেদনের সময়ে মাছের থালা মূল ভোগের থেকে চার আঙুল দূরে রাখা হয়, যাতে ছোঁয়া না লাগে।
এ দিকে বৈষ্ণব মতে পুজো হলেও অষ্টমীতে ছাগবলি হয় সুরুল জমিদারবাড়িতে। তবে বলিদানের পূর্বে নারায়ণকে নিঃশব্দে স্বমন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়, তার সামনে বলি হয় না। আবার একই পরিবারে দু’রকম নিয়মও দেখা যায়। যেমন, চালতাবাগান ভট্টাচার্যবাড়িতে নিরামিষ ভোগ হলেও সেই পরিবারেরই নবদ্বীপের বাড়িতে (লাল দুর্গা বাড়ি) আমিষ ভোগ হয়।
এ ছাড়াও পুজোর নিয়ম মেনে দেবীর দক্ষিণ পার্শ্বে থাকে ঘৃতসহ আমান্ন অর্থাৎ কাঁচা চাল ও বাম পার্শ্বে সিদ্ধান্ন। মধুপর্ক তৈরির জন্য থাকে দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মধু ও শর্করা।
একে-একে সব সাজিয়ে শুরু হয় পুজো। পুরোহিতের মন্ত্রপাঠে, ধূপ-ধুনো-কর্পূরের গন্ধে সম্পূর্ণ হয় ভোগ নিবেদন। পুজোশেষে মায়ের প্রসাদী ভোগ বিতরণ হয়। ক্ষুধানিবারণ হয় মায়ের অজস্র সন্তানসন্ততির। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য পঞ্চাশের মন্বন্তরে বেলুড় মঠের তৎকালীন অধ্যক্ষ স্বামী বিরজানন্দজীর চিঠি। স্বামী দেবেন্দ্রানন্দর ‘বেলুড় মঠে স্বামীজীর দুর্গাপূজা’ বইয়ে এ চিঠির উল্লেখ রয়েছে। সেই দুর্ভিক্ষের বছরে তাঁর নির্দেশ, ‘‘... কেউ যেন নিরাশ হয়ে ফিরে না যায়। শুধু খিচুড়ি পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবস্থা হবে। তাতেই শাক-সবজি যা কিছু দেবে। অন্য তরকারি মিষ্টান্ন কিছু দরকার নেই। এ খিচুড়ি মায়ের সামনে হাণ্ডা হাণ্ডা করে বিরাট ভোগ দিয়ে তারপর সর্বহারা নারায়ণদের পরিবেশন করতে হবে।’’ প্রকৃত অর্থেই ‘মা শতমুখে খান’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy