অফিসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, খিদে মেটাতে জাঙ্ক ফুডে ভরসাই ডেকে আনছে অসুখ। ছবি: শাটারস্টক।
সকাল সকাল ঘুম ভেঙেই অফিস বেরনোর তাড়ায় দৌড়ঝাঁপ। সকালের ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি সারার সময়টুকুও জোটে না অনেক সময়। তার পর সারা দিন অফিসে একটানা কম্পিউটারের সামনে চেয়ারে বসে কাজ। কাজের তাড়ায় কখনও কখনও বাদ যায় ব্রেকফাস্টও। অফিসেই চাকা ঘোরানো চেয়ারে বসে মাত্রাতিরিক্ত চা-কফির সঙ্গে কিছু একটা ভাজাভুজি বা জাঙ্ক ফুড দিয়ে খিদে মেটাচ্ছেন। অনেক সময় দুপুরেও খাবার আসছে বাইরে থেকে বা তেল-ঝালের অফিস ক্যান্টিনই ভরসা। দোকানবাজারও অনলাইনেই সারছেন। ফলে বাজার করার সময় যে হাঁটাটুকু হত, সেটাও প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। এত কিছু সেরে বাড়ি ফিরে আর সামর্থ্য নেই শরীরচর্চার। তখন হয় আরামের বিছানায় একটু লম্বা হওয়া। নয়তো ছেলেমেয়ের লেখাপড়া নিয়ে বসা। মাঝে বাড়ির টুকটাক কাজ।
কর্পোরেট জগত হোক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান— পেশা যা-ই হোক না কেন, এই রোজনামচায় অভ্যস্ত প্রায় সকলেই। কোনও কোনও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও রুটিন হয়ে দাঁড়ায় এই রকমই। আর এই রোজনামচার হাত ধরেই শরীরে ঢুকছে ওবেসিটি, ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক চাপ, হার্টের অসুখ, কোমরের সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যে সব পেশায় মাথার কাজ শরীরের তুলনায় বেশি, সে সব পেশার মধ্যেই অসুখের বীজ বেশি।
অফিসে মূলত ডেস্ক ওয়ার্ক করতে হয় যাঁদের, এমনকি একটানা ক্লাসে বসে বা দাঁড়িয়ে পড়ান যাঁরা, তাঁদেরও শারীরিক কসরতের জায়গাটা প্রায় শূন্য। তাই ক্রমেই ওবেসিটি, ডায়াবিটিস, ট্রাইগ্লিসারাইড, কোলেস্টেরল, অ্যানিমিয়া, হাড়ের অসুখ চোখ রাঙাচ্ছে। সময়ে না খাওয়া, ভুলভাল খাওয়া আর যথেচ্ছ চা-কফিই ডেকে আনছে বিপদ— মত চিকিৎসকদের।
আরও পড়ুন: যত্ন সত্ত্বেও রোজের এই সব ভুলেই চুল তেলতেলে ও নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে
রাশ টানুন কাজের ফাঁকের চা-কফিতে।
‘‘শরীর একটা যন্ত্রের মতো। যা সওয়াবে তা-ই সয় বলে আমরা অনেক অত্যাচার তার সঙ্গে করি। এটায় রাশ না টানতে পারলে এক সময়ের পর সে তার কলকব্জা নিয়ে প্রতিবাদ জানাবেই। অফিসে যখন কাজ করেন, যন্ত্রের কোনও অসুবিধা হলে যেমন আপনার কাজ আটকায়, শরীরও তেমনটাই। একটানা ৬ ঘণ্টার বেশি এক জায়গায় বসে কাজ করেন বা কাজের জায়গায় শারীরিক কসরত নামমাত্র এমন মানুষদের তাই কিছু বিশেষ নিয়ম মেনে চলতে হবে এখন থেকেই। সুস্থ শরীরে বাঁচতে গেলে ও সুন্দর ভবিষ্যৎ পেতে গেলে এটুকু অবদান শরীরের প্রতি থাকতেই হবে।’’ জানালেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী। একই মত পেন ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ দেবাঞ্জলি পালেরও।
ডায়াটেশিয়ান সুমেধা সিংহের মতে, ‘‘কিছু অসুখ আছে যা কখনই ওষুধ নির্ভর নয়, বরং জীবনযাপনের কায়দা নির্ভর। তাদের আয়ত্তে আনতে গেলে কিছু বিষয় যে ভাবেই হোক মানতে হবে। অগোছালো খাদ্যাভ্যাসকে কব্জা করলাম কিন্তু একটানা বসে থাকার জন্য কিছুই করলাম না, তা কিন্তু চলবে না। বরং সারা দিন নানা ব্যস্ততার মধ্যেও যে ভাবেই হোক এ সব মেনে চলতেই হবে।’’ কী কী নিয়ম প্রতি দিনের রুটিনে না প্রবেশ করালে জবাব দেবে শরীর, চিকিৎসকরা দিলেন সেই নিদান।
কোনও অবস্থাতেও প্রাতঃরাশ বাদ দেওয়া যাবে না।
প্রাতঃরাশ: কোনও ভাবেই প্রাতঃরাশ বাদ দেওয়া যাবে না। শরীরের চরিত্র গাড়ির মতো। শুরুতেই অনেকটা তেল ভরে নিতে হবে। ভারী খাবার দিয়ে শুরু করুন দিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাবারের পরিমাণ কমবে। তাই প্রাতঃরাশ হবে ভারী। ভুলভাল খাবার নয়, লুচি-পরোটার বিলাসিতা সপ্তাহে এক দিনের জন্য রাখুন। রুটি-সব্জি যেমন ভাল ব্রেকফাস্ট, তেমন দই-ওটস, মুসলি, ইডলি বা মাল্টিগ্রেন ব্রেডের ভেজ স্যান্ডুইচ, স্যালাড, সেদ্ধ ডিম এ সবও চলতে পারে। সঙ্গে অবশ্যই একটা ফল রাখুন। ফলের রস নয়। কোনও অবস্থাতেও প্রাতঃরাশ বাদ দেওয়া যাবে না। তাতে যদি পনেরো মিনিট সময় অন্য কাজ থেকে ছেঁটে দিতে হয়, তাও দিন। ভোরবেলা থেকে সকালের মধ্যে শরীরে গ্লুকোকটিকয়েড হরমোন সবচেয়ে বেশি নিঃসরণ হয়। এটি শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায়। কিন্তু ওই সময় খেতে ভুলে গেলে বা খাওয়া এড়িয়ে সময় বাঁচাতে চাইলে, হরমোন রক্তে বাড়িয়ে তোলে শর্করা। কাজেই বাঁচবে সময় কিন্তু কমবে আয়ু।
আরও পড়ুন: নাক বন্ধ হয়ে শ্বাসের সমস্যা? ড্রপের নেশা নয়, এ সব উপায়েই হবে সমাধান
কাজের মাঝে উঠতে হবে: যত ব্যস্ততার কাজই করুন না কেন, প্রতি চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট অন্তর উঠতেই হবে সিট ছেড়ে। এক ঘণ্টার বেশি সময় বসে থাকা যাবে না কিছুতেই। হাঁটু ও কোমরের পেশিকে সঞ্চালন করানোর জন্য খুব ভারী ব্যায়াম করা সম্ভব নয় ঠিকই, কিন্তু এক বার সিঁড়ি ভাঙা বা লনে কয়েক পা হেঁটে নেওয়া এগুলো সারতে মিনিট পাঁচেক লাগে। এই পাঁচ মিনিট দিতেই হবে। চেষ্টা করুন লিফট এড়াতে। অনেক উপরতলায় অফিস হলে কিছুটা লিফটে গিয়ে অন্তত তিনটে তলা হেঁটে যান। হাড়ের অসুখ থাকলে কতটুকু সিঁড়ি ভাঙবেন, কতটা হাঁটবেন এগুলো চিকিৎসকের থেকে বুঝে নিন। প্রয়োজনে তার বিকল্প কোনও শারীরিক কাজ করতে হবে। সঙ্গে অবশ্যই বাদ দিন চাকা লাগানো ঘোরানো চেয়ার। সম্ভব হলে কাঠের চেয়ারে বসুন। পা যেন মাটিতে ঠেকে থাকে। একান্তই তা না সম্ভব হলে উঠে হাঁটার সময়টা পাঁচের জায়গায় সাত মিনিট করুন। দিনে এক ঘণ্টা অন্তর অবশ্যই উঠুন। কাজের মাঝে ডেস্কে বসেই লাঞ্চ সারবেন না।
সিঁড়ি ভাঙুন সুযোগ পেলেই।
চা-কফিতে রাশ: বেল বাজালেই চা পান হাতের কাছে? অফিসের এমন সুবিধা নিয়ে বাইরে গর্ব করুন, অসুবিধা নেই। কিন্তু সময় বাঁচানোর এই ফাঁদে পা দেবেন না। ঘন ঘন চা বা কফি যেমন নানা অসুখ ডাকে, তেমনই চা খেতে উঠুন। দরকারে বাইরে কোনও চায়ের ঠেক থাকলে ভাল। কাজের তাড়া থাকলেও পাঁচ মিনিটে উঠে চা খেয়ে আসাই যায়। এতে ওঠাও হবে, আবার ঘন ঘন বাইরে যেতে হওয়ার চাপে চা-কফি কম ঢুকবে শরীরে। চেষ্টা করুন গ্রিন টি খেতে। এতে মেটাবলিজম বাড়বে।
সময়ের ফাঁকে ফাঁকে খান: অনেকটা একবারে খেয়ে পেট ভরাবেন না। অফিসের ডেস্কে রাখুন চিনি ছাড়া বিস্কুট, কিছু আমন্ড-কাজু-বাদাম। ফল রাখুন ব্যাগে। দু’-তিন ঘণ্টা অন্তর খেতে হবে কিছু। পারলে দুপুরের খাওয়ায় ভাত বাদ দিন। হালকা খান। রুটি মাছ/চিকেন/স্যালাড থাকুক পাতে। জোর দিন প্রোটিন খাওয়ায়। যাঁরা নিরামিষ পছন্দ করেন তাঁরা মুসুর ডাল সেদ্ধ, রাজমা, সয়াবিন এ সব রাখুন পাতে। দুপুরের খাবার ব্রেকফাস্টের চেয়েও হালকা হবে। ডায়াটেশিয়ান দেখিয়ে নিন সময় করে। তার দেওয়া তালিকা মেনে কমবেশি চলার চেষ্টা করুন। ক্যালোরি মেপে খেতে না পারলে ওবেসিটি রোখা অসম্ভব।
আরও পড়ুন: আর্থ্রাইটিস আটকাতে বদলান কিছু অভ্যাস, কী করে কাটবে বিপদের ভয়?
শরীরচর্চা: প্রতি দিন একটানা হাঁটতে হবে অন্তত ৩৫-৪০ মিনিট। যাঁরা ব্যায়াম বা শরীরচর্চা রোজ করতে পারেন তাঁদের ক্ষেত্রে হাঁটার সময় কমানো যায়, কিন্তু শরীরচর্চা করার সময় না পেলে হাঁটতেই হবে অতটা। কোলেস্টেরল, ওবেসিটি সরাতে ঘাম ঝরানোর কোনও বিকল্প নেই। যদি সাইক্লিং বা সাঁতার কাটতে পারেন, তাও খুবই ভাল।
রাতের খাবার সারতে হবে সময় মতো। খাবার রাখুন হালকা।
রাতের খাবারে দেরি নয়: রাত আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে সেরে ফেলুন রাতের খাবার। বাকি সময়টা কাজ সারুন, কিন্তু খাওয়া কিছুতেই সাড়ে আটটার পরে নয়। অনেকেই ভাবেন, অত তাড়াতাড়ি খেলে তো খিদে পাবে! না পাবে না। নিয়ম মেনে দু’-তিন ঘণ্টা অন্তর খেলে খিদে পাবে না। ঘুমনোর আগে এক গ্লাস চিনি ছাড়া দুধ খান। অ্যাসিটিডির সমস্যা থাকলে ঠান্ডা দুধ খান। দুধ একেবারে সহ্য না হলে ডায়াটেশিয়ানের পরামর্শ নিয়ে এর বিকল্প কোনও পানীয় খেতে পারেন।
ঘুম: নিজের খেয়াল, সন্তানের পড়াশোনা, বাড়ির কাজ সামলে ঘুমোতে যেতে দেরি হয়? যখনই ঘিমতে যান অন্তত ৬-৭ ঘণ্টা নিশ্ছিদ্র ঘুম দরকার। ঘুমের ঘাটতি হলে ওবেসিটি রোখা যাবে না কিছুতেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy