ছিল পুরনো বাড়ি, হল আধুনিক ক্যাফে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সাতমহলা বাড়ি। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে উঠোন পেরিয়ে লম্বা দালান। তার এক পাশে বসার ঘর, পড়ার ঘর, আড্ডাখানা। অন্য পাশে ভাঁড়ার ঘর, রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর। একেবারে যথাযথ পুরনো আমলের বাড়ি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মরচে পড়েছে লোহার শিকলে। ঝুলবারান্দা যাতে একেবারে ঝুলে না পড়ে, তাই তলা থেকে দেওয়া রয়েছে ঠেকনা। ছাদের অবস্থাও ভাল নয়। চারদিক থেকে নেমেছে বট-অশ্বত্থের ঝুরি। কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ— খোঁজ করলে ‘ইট-কাঠ-পাথরের পাঁজরে’ খাঁজে খাঁজে ইতিহাস বয়ে বেড়ানো এমন বাড়ির সংখ্যা নেহাত কম নয়। সেই সব বাড়ি ভেঙে বেশির ভাগ জায়গাতেই তৈরি হচ্ছে গগনচুম্বী অট্টালিকা। তবে, একদল মানুষ আবার চাইছেন কয়েক যুগের ইতিহাসের সাক্ষী বহন করা সেই সব পরিত্যক্ত বাড়িগুলিকে সংরক্ষণ করে রাখতে। কিন্তু পুরনো বাড়ি সংরক্ষণ করা তো মুখের কথা নয়। চাই প্রচুর মূলধন। সে ব্যবস্থা হলেও সেখানে বসবাস করার লোক কম। কারণ, শরিকি বাড়ি মালিকানা ছেড়ে তত দিনে পরিবারের বেশির ভাগই পাড়ি দিয়েছেন প্রবাসে। মেরামত করার পর বাড়িগুলি তালাবন্ধ করে ফেলে রাখাও তো কাজের কথা নয়। তাই দক্ষিণ কলকাতার পুরনো পাড়া জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন অসংখ্য সাবেক বাড়ির মধ্যেই গজিয়ে উঠছে একের পর এক ক্যাফে।
ক্যাফে সংস্কৃতি ভারতীয় নয়। বাড়ির সামনে রকে বসে চা খাওয়া, আড্ডা মারার রেওয়াজ থাকলেও তার মধ্যে কেতাদুরস্ত ব্যাপার একেবারেই ছিল না। কাপ থেকে পিরিচে গরম চা ঢেলে ‘সুড়ুৎ’ শব্দ তুলে চা খাওয়া মানুষকে ক্যাফেমুখী করতে সময় লেগেছে বিস্তর। ব্যবসায়ীরাও আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন, পুরনো বাড়ির খোলনলচে না বদলে বাঙালির আবেগ ‘সংরক্ষণ’ করে রাখতে। যাতে বছরে এক বার হলেও তাঁরা পুরনো বাড়ির গন্ধ নিতে পারেন। তেমনই একটি ক্যাফে হল ‘দ্য ভবানীপুর হাউজ়’।
সে প্রায় ৯০ বছর আগের কথা। এই ক্যাফের ঠিকানাই তখন ছিল সরকার দম্পতির বাড়ি। শ্রী নৃপেন্দ্রনাথ সরকার এবং লেডি নবনলিনী সরকার দক্ষিণ কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ভবানীপুরের বকুলতলায় পরম যত্নে তৈরি করেছিলেন তাঁদের এই আস্তানা। পরে সেই বাড়ি কিনে নেন ব্যবসায়ী দুই ভাই। নাম হয় ‘দ্য ভবানীপুর হাউজ়’। ১১ হাজার বর্গফুটের দোতলা বাড়ি। প্রবেশপথে সরকার দম্পতির বসানো আম গাছটি বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। গরমে সেই গাছ ভরে রয়েছে ফলে। চাইলেই দোতলার বারান্দায় রাখা আরামকেদারাতে শুয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন একটা দুপুর। গরমের দুপুরে স্ট্রবেরি ক্রাশে চুমুক দিতে মন্দ লাগবে না। বাংলার নতুন বছর তাই সপরিবার দুপুরের ভোজ সারতেই পারেন এখানে। দলবল নিয়ে গেলে আগে থেকে বুক করে রাখতে হবে ছাদের একটি ঘর। সিঁড়ি তো আছেই। হাঁটুর সমস্যা থাকলে লিফ্টে চড়েও ছাদে উঠতে পারেন। বিকেলে কালবৈশাখীর দৌরাত্ম্য দেখতে দেখতে সেখানে জমাটি আড্ডা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন তাঁরাই। চিন্তা নেই! চিলেকোঠা হলেও এতটুকু রোদের আঁচ লাগবে না। পুরো বাড়িটিই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। নববর্ষ উপলক্ষে মেনুতেও রয়েছে বেশ কিছু বদল। রয়েছে ক্যালকাটা ফিশ ফ্রাই, প্রন কাটলেট। গরমের দুপুরে যদি খুব রগরগে তেল-মশলা দেওয়া খাবার খেতে ইচ্ছে না করে, তা হলে চেখে দেখতে পারেন গন্ধরাজ বেক্ড ফিশ উইথ হার্ব রাইস। চাইলে ব্রাউন রাইসও পেতে পারেন। কিংবা একেবারে বাঙালি পদ্ধতিতে তৈরি বেগুনির সঙ্গে থাকতে পারে ‘লাল সাগ রিসোতো’। ইটালির রিসোতোর সঙ্গে দেশি লাল শাকের অদ্ভুত যুগলবন্দিতে তৈরি হয় এই খাবার। প্রবাসী বন্ধু পাস্তা খেতে চাইলে তাঁকে খাওয়াতে পারেন স্ক্যালোপিনি চিকেন। নতুন বছরের শুরুতে মিষ্টিমুখ হবে না? দই, সন্দেশ, রসগোল্লা নয়। ক্রিম চিজ় ডোম কিংবা কেশর মিল্ক কেকও থাকতে পারে শেষ পাতে।
ভবানীপুর থেকে হাজরার দিকে যেতে শরৎ বোস রোডের উপর রয়েছে দ্য কর্নার কোর্টইয়ার্ড। প্রায় ১০৫ বছরের পুরনো এই জমিদার বাড়িটিতে হয়েছে রেস্তরাঁ। বাড়ির রং, আসবাবের মধ্যেও রয়েছে সেই পুরনো কলকাতার সাবেকিয়ানা। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি, বারান্দায় লোহার রেলিং, সাদা-কালো শ্বেতপাথরের মেঝে দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় বাড়ির অন্দরমহলে। সেখানে রয়েছে ৭টি বড় বড় ঘর। সেগুলি আগে থেকে বুক করে রাখার ব্যবস্থাও আছে। খানাপিনার ব্যবস্থাও বিপুল। স্যুপ, স্যালাড, কেক, মাফিন, গ্রিল্ড খাবার, কী নেই এখানে? ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে খাবারের ফিউশন পরখ করে দেখতে হলে এখানে এক বার আসতেই হবে।
ভবানীপুর থেকে একটু এগিয়ে রাসবিহারী হয়ে হিন্দুস্তান পার্ক। বাসন্তীদেবী কলেজের উল্টো দিক দিয়ে হেঁটে পৌঁছে যেতে পারেন এই রকমই একটি ঐতিহ্যপূর্ণ ক্যাফেতে। ৭২, হিন্দুস্তান পার্ক, কলকাতা- ৭০০০২৯। কবি নরেন্দ্র দেব এবং রাধারাণী দেবের ‘ভালবাসা’ বাড়ি। পরবর্তী কালে সেই বাড়ির মালিকানা ছিল তাঁদের কন্যা নবনীতা দেব সেনের হাতে। এখন সেই বাড়ির এক কোণে তৈরি হয়েছে বুনাফিল ক্যাফে। বাড়ি থেকে কফি, ব্রিটিশ পাতুরি, গার্লিক বাটার প্রন কিংবা চিকেন স্টেকের গন্ধ ছড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভালবাসা বাড়ির আমেজ এতটুকু নষ্ট হতে দেননি ক্যাফের কর্ণধার সোনিকা দে। দাবার বোর্ডের মতো সাদাকালো মেঝে, পুরনো আসবাবের সঙ্গে কফির ঘ্রাণ নিতে হলে এক বার যেতেই হবে বুনাফিল ক্যাফেতে।
পুরনো দক্ষিণ কলকাতার লোকেরা এক ডাকে সাউথ কলকাতা ক্লাব বলে যে বাড়িটিকে চেনেন, সেখানেই এখন তৈরি হয়েছে রোস্টারি কফি হাউজ়। কলকাতার বুকে কফিপ্রেমীদের আদর্শ জায়গা হল এই রোস্টারি। গরম-ঠান্ডা মিলিয়ে প্রায় ৮০ রকম কফি পাওয়া যায় এখানে। পিচের রাস্তা পেরোলেই দেখতে পাবেন পুরনো একটি হলুদ রঙের বাড়ি। সেই বাড়ির উঠোনে সাজানো চেয়ার-টেবিল। বারান্দা-ঘেরা বাড়ির চারদিকে সবুজের সমাহার। সেখান থেকে গোধূলি দেখার আনন্দই আলাদা। বৈশাখের প্রথম দিনে বন্ধুদের সঙ্গে তেমন একটি ক্যাফেতে জমায়েত হতেই পারে। তবে শুধু কফি খেয়ে তো মন ভরবে না। আড্ডার সঙ্গে মুখ চালানোর মতো খাবার, যেমন স্যালাড, পেরি পেরি চিকেন উইংগ্স, চিজ় অ্যান্ড চিকেন বল, ফিশ ফিঙ্গার থাকতেই পারে। চাইলে নাচোজ়ও পাবেন। একটু বেশি খিদে পেলে অর্ডার করতে পারেন স্যান্ডউইচ। প্রায় ২০ রকমের স্যান্ডউইচ পাওয়া যায় এখানে। পাস্তা তো আছেই।
গড়িয়াহাটের দিকে যদি না যেতে চান, তা হলে কালীঘাটের কাছেও এমন একটি ক্যাফেতে ঢুঁ মারতে পারেন। ১০০ বছরের ইতিহাস বয়ে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বাড়ি। সদানন্দ রোডে সেই ঠিকানায় এখন আছে ‘দ্য রেড বাড়ি’ ক্যাফে। মূল দরজা দিয়ে ঢুকতেই লম্বা, সরু গলি। যার দু’পাশে সার বেঁধে রয়েছে ঘরগুলি। দেখলেই বোঝা যায়, অনেক ইতিবাসের সাক্ষী এই বাড়িটি। কফির জন্য বিখ্যাত হলেও ফিশফ্রাই, স্যান্ডউইচ, পাস্তা সবই পাওয়া যায়। চা বললে যদিও দার্জিলিঙের কথাই প্রথম মাথায় আসে, তবে যাঁরা আসামের চা খেতে পছন্দ করেন, তাঁরা এক বার এখানে ঘুরে আসতেই পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy