আবাহন দত্ত
কলকাতা
‘এ মা, তোর গালে অমন কালো দাগ কেন?’‘ওর ওই জায়গায় কী হয়েছে?’‘দেখতে কেমন যেন লাগছে!’— এ সবই সামাজিক প্রশ্ন। শিশুর গায়ে কোনও অস্বাভাবিক দাগ থাকলে প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসে। তা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েন অভিভাবকেরা। তাতে হয়তো কখনও আসল অসুখের দিকে নজর কমই পড়ে। এই সামাজিক রোগের চিকিৎসা সুদূরপরাহত। খেয়াল রাখতে হবে, মূল চিকিৎসায় যেন অবহেলা না হয়। এ বিপদ দারুণ ভীত হওয়ার মতো না হলেও উদ্বেগের ফোকাস অন্য দিকে সরে না যাওয়াই মঙ্গল।
গোড়ায় এর বিজ্ঞানটা সহজ কথায় বুঝে নিতে হয়। মানুষের ত্বকে থাকে মেলানোসাইট কোষ, যেখান থেকে মেলানিন নামে রঞ্জক পদার্থ তৈরি হয়, যা ত্বকের স্বাভাবিক রং তৈরিতে জরুরি ভূমিকা নেয়। এই কোষের কার্যকলাপে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলে চামড়ার রং তৈরির প্রক্রিয়াতেও সমস্যা দেখা দেয়। আর মেলানোসাইটের সক্রিয়তা বাড়লে মেলানিন নিঃসরণও বাড়ে, ফলে চামড়া কালো হয়ে যায়। যদিও এটি একটি কারণ মাত্র। পেডিয়াট্রিক ডার্মাটোলজিস্ট সন্দীপন ধর স্পষ্ট করে বলেন, “ত্বক হল বড় অসুখের (সিস্টেমিক ডিজ়িজ়) আয়নার মতো।” অতএব, চামড়া কালো হয়ে যাওয়ার বিবিধ কারণ জানা জরুরি।
এফিডিলিস বা ফ্রেকেল্স: মেলানোসাইট অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে মেলানিনের ঘনত্ব বৃদ্ধি ঘটলে ছোট ছোট বাদামি বিন্দু দেখা যায়। এই দাগ সেখানেই হয়, যে সব জায়গা সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসে। যে সব শিশুদের চামড়া সাদা এবং চুল লাল বা বাদামি, তাদেরই এই ধরনের রোগ বেশি হয়। সাধারণত প্রথম শৈশবেই তা দেখা যায়, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেরেও যায়। সানস্ক্রিন অথবা কোষ থেকে বেশি মেলানিন আসা বন্ধ করতে ডিমেলানাইজ়িং ক্রিম কার্যকর।
মেলাসমা: আর এক নাম হাইপার-মেলানোসিস, রং হালকা থেকে ধূসর বাদামি, দাগটা অনেকখানি ছড়ানো। যে অংশে রোদ লাগে, সেখানেই দেখা দেওয়ার আশঙ্কা বেশি। বেশি হয় মেয়েদের, বিশেষত যাঁরা রোদে ঘোরেন। তবে বংশগত কারণ, অতিবেগুনি রশ্মি বা হরমোনের সমস্যাতেও এই রোগ হয়। হাইড্রোকুইনোন (২-৪%) ও ট্রেটিনোইন (০.০৫-০.১%) ক্রিম এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপকারী। টপিক্যাল অ্যাজেলিক অ্যাসিড (১৫-২০%)-ও কার্যকর। ডা. ধর জানান, এই অসুখে কসমেটোলজিস্টরা অনেক সময়েই কেমিক্যাল পিলিংয়ের কথা বলেন, অর্থাৎ গ্লাইকোলিক জাতীয় অ্যাসিড দিয়ে ত্বকের উপরের স্তরটি তুলে দেওয়া। এই প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট সময় অন্তর করতে হয়।
পোস্ট ইনফ্ল্যামেটরি হাইপার-পিগমেন্টেশন: অনেকটা জায়গা জুড়ে দাগ হয়, রং হালকা কালো। এর থেকে নানা অ্যালার্জি বা চুলকানি (ইরাপশন) হতে পারে, র্যাশও বেরোতে পারে, যেমন কন্ট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস। এই রোগ বেশ অনেক দিন থাকে।
ফোটো কন্ট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস: এই রোগে যেমন চামড়া ইরাপশন হয়, তেমন বাদামি রঙের হাইপার পিগমেন্টেশনও হতে পারে। এর কারণ অত্যধিক গাছপালার সংস্পর্শে থাকা, অথবা প্রখর রোদে ঘোরাফেরা করা, কখনও পারফিউমের অতিরিক্ত ব্যবহার। তবে সুগন্ধির ক্ষেত্রে তা লাগানোর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই চুলকানি শুরু হয়ে যায়। তাতে চামড়া খসখসে হয়ে যেতে পারে, রস বেরোতে পারে, ছড়েও যেতে পারে। ডা. ধরের কথায়, “এটা এক ধরনের অ্যালার্জি, তাই স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিমের দরকার হতে পারে। সঙ্গে অ্যান্টি-অ্যালার্জিক খেতে হয়। কখনও সানস্ক্রিন বা ময়শ্চারাইজ়ারও কার্যকর হতে পারে।”
এডিসন্স ডিজ়িজ়: বিরল প্রকৃতির রোগ। এর ফলে হাইপার-পিগমেন্টেশন হয় চোখের চারপাশে, হাতের তালুতে, নাভির নীচের অংশে। রোগ বাড়লে চুলের রং-ও পাল্টাতে থাকে। তা যে কোনও বয়সেই হতে পারে, ছেলেদের বা মেয়েদের। এর কারণ, এড্রোনাল গ্রন্থি থেকে স্টেরয়েডের ক্ষরণ কমে যাওয়া। প্রধান লক্ষণ হল দুর্বলতা, অথবা অবসাদ, ওজন হ্রাস, রক্তচাপ কমা ইত্যাদি, কখনও বমি। এ ক্ষেত্রে শুধু সানস্ক্রিনের কথা বলছেন ডা. ধর, কারণ এটি মেডিসিনের দৃষ্টি থেকে অনেক বেশি জটিল বলে মনে করেন তিনি। অর্থাৎ এই রোগে ছোটদের পেডিয়াট্রিশিয়ান দেখানো উচিত, কারণ এর পিছনে মূল সমস্যাটি গভীরতর হয়। যেমন, হরমোনের ক্ষরণে গন্ডগোল হতে পারে (অ্যাড্রিনালিন গ্রন্থি থেকে কর্টেসল ক্ষরণে গোলমাল)। ত্বক বিশেষজ্ঞ তাই দ্রুত ফিজ়িশিয়ানের কাছে রেফার করেন।
ফিক্সড ড্রাগ ইরাপশন: পেট খারাপ বা পেনকিলার জাতীয় ওষুধের কারণে অ্যালার্জি বা ইরাপশন। একটাই জায়গা হালকা বাদামি হয়ে ফুলে ওঠে, চুলকায়। সপ্তাহখানেক থাকলে দাগ হয়ে যেতে পারে, যা মেলাতে প্রচুর সময় লাগে। এই সমস্যা যে হেতু একই ওষুধে ফিরে ফিরে আসে, মূলত শরীরের একই জায়গায়, অতএব তা ‘ফিক্সড’। কখনও তা গোটা শরীরেও ছড়িয়ে পড়ে। এর থেকে ইরাইথেমা, ওইডিমা দেখা দিতে পারে, শেষ পর্যায় হাইপার-পিগমেন্টেশন। এ থেকে রক্ষা পেতে প্রথমেই ওই বিশেষ ওষুধ বন্ধ করা হয়। প্রয়োজনে অ্যান্টি অ্যালার্জিক বা স্টেরয়েড ক্রিমও দেন চিকিৎসক।
পিগমেন্টেড পারপিউরিক ডার্মাটোসিস: এই রোগে সাধারণ রক্তবাহী নালিগুলির সমস্যা থাকে, ফলে সামান্য রক্ত বেরিয়ে তা ত্বকে জমে কালো কালো ছোপ তৈরি করে। প্রথমে তার আভা হালকা লাল, পরে প্রকট কালো। বাচ্চাদের শরীরে এমন দাগ সৌন্দর্যহানি ঘটালেও স্বাস্থ্যের দিক থেকে কোনও বিপদ নেই। ডা. ধরের পরামর্শ, কেউ একান্ত ভাবে চাইলে হাইড্রোকুইনোন, অ্যাজেলাইক অ্যাসিড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন।
মেচেতা: মুখে কালো ছোপ। হাইড্রোকুইনোন এবং ট্রেটিনোইন স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম, লোশনই এর চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে সূর্যালোক, তৈলাক্ত প্রসাধনী এড়িয়ে চলা ভাল।
সুতরাং এ কথা বুঝে নেওয়া ভাল যে, সামাজিক সঙ্কট যা-ই থাক, তাকে চিকিৎসার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। প্রয়োজন অনুযায়ী ত্বকের অসুখের চিকিৎসা করানোটা জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy